নেকড়ে
মৃদু জামান।। সন্ধ্যার পর নাকি রাস্তায় নেকড়ে নামে। আর তারপর জ্যান্ত মানুষ গিলে খায়। ছেলে বেলায় এমন অনেক গল্প শুনতাম মায়ের কাছ থেকে। আর শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝেই জানালার পাশে বসে খুব কৌতুহল নিয়ে চেয়ে থাকতাম, নেকড়ে দেখবো বলে। কিন্তু কোনদিনও চোখে দেখতে পাই নি। শৈশব কেটে গেল। কিন্তু নেকড়ের দেখা মিললো না। কিন্তু কৈশোরে এসে ভুল ভাঙল। এতদিন গল্পে যে পশুর কথা শুনে এসেছি তা আসলে পশু নয়, বরং পশুত্ব, যা কিছু অসুস্থ মানুষের ভেতর বাস করে। সময় অসময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তবে এই পাশবিক আচরন সব মানুষের জন্য নয়। বরং কিছু বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য। তাদের জন্য, যারা নারী নামে পরিচিত। সেই নেকড়ের দল সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপর। তারপর সেই নারীকে খুবলে খায় আমাদের সমাজ।
অত্যাচার চলছে বাংলার জন্মের আদিলগ্ন থেকে। নারীদের এই আতঙ্ক বহু পুরাতন আর তারই সাক্ষী বাংলার ইতিহাস। যেখানে যুদ্ধ চলাকালীন শোষিত নারীরা বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত হলেও সমাজ তাঁদের মেনে নেয় নি। তেমনি একজন হলেন মরিয়ম। নববিবাহিত তরুণী। দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। মরিয়ম যখন গর্ভবতী তখনি দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। পুকুরে গোসল করার সময় পাক বাহিনীর কাছে বন্দী হলেন তিনি। তাকে নিয়ে আসা হয় রেপ ক্যাম্পে। সেখানে তাকে দিনের পর দিন অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। স্বাধীনতার পর সে রেপ ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেলেও ছাড়া পায় নি সমাজের কারাগার থেকে। তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়। তার সন্তান বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে নি। যুদ্ধের পর থেকে তাকে এবং তার সন্তানদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যুদ্ধে নিজের সর্বস্ব বিলীন করে দিয়েও আজ তাকে ভাবতে হয়, তার জানাজায় কেউ শরিক হবেন কি?
যুদ্ধ শেষ। দেশটা এখন স্বাধীন। ইতিহাসকে অনেক দূরে ফেলে যদি আধুনিকতায় ফিরে যাই, তবুও অত্যাচার ও নৃশংসতার নজির মিলবে অহরহ। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে সময় পেরিয়ে গেলেও মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে নি খুব একটা। আজো পুরুষের মন মানসিকতা সেই কুয়োর ব্যাঙ এর মতই রয়ে গেছে। শিক্ষা, পেশা, কোন কিছুই নারীর প্রতি তাদের হীন মানসিকতার অবসান ঘটাতে পারে নি। তারই এক জলন্ত উদাহরন সোহাগী জাহান তনু। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এর বাসিন্দা ১৯ বছরের তরুণী তনুকে ধর্ষণ করে খুন করা হয় তারই এলাকায়। রাস্তার পাশে ফেলে যায় তার নগ্ন মৃত দেহটিকে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও সমানতালে এই দুর্ঘটনা নিয়ে চলে প্রতিবাদের জোয়ার। তবে পাশাপাশি ”তনু ধর্ষণ” নিয়ে কিছু মানুষের মন্তব্য অবাক নয়, লজ্জিত করে দেয়। এমন অনেকগুলো মন্তব্বের একটি হল, ‘নাট্য কর্মীরা পুরুষদের খোরাক। সুতরাং সে তার কর্মেরই ফল ভোগ করছে’। এই কথাগুলোই জানান দিয়ে যায় যে স্বাধীন দেশে থেকে নারীদের দাসত্ব থেকে মুক্তি এখনো অনেক দূরে। এ লং ওয়ে টু গো…
নারীদের জন্য নিরাপদ, এমন কোন স্থান হয়ত আর অবশিষ্ট নেই। হোক তা ঘরে কিংবা বাইরে। পরিবার কিংবা বন্ধুর সাথে। ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখ ঠিক এমনি এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। যেখানে সপরিবারে উৎসব পালন করতে গিয়েও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে অনেক নারীকে। যেখানে এক দল পুরুষ কিছু নারীকে ঘিরে তাদের গায়ের কাপড় টেনে হিঁচড়ে খুলে ফেলে। তাদেরকে ঢাকার টিএসসি চত্বরে দাঁড়িয়ে হ্যারাস করা হয় শত শত লোকের সামনে। এই অপরাধের ন্যায্য বিচার হয় নি। রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকায় বেরিয়ে যায় এমন হাজারো অপরাধী। বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক উদাসিনতার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া হয় না অসংখ্য নাম না জানা তনুদের।
খুঁজে দেখলে এমন ভিকটিম পাওয়া যাবে অসংখ্য। কিন্তু বিচার পেয়েছে এমন সংখ্যা ঠিক গুটিকয়েকই মিলবে। এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে এমন দিন আর দূরে নয় যেখানে নারী সঙ্গী কিংবা তার আশ্রয় হিসেবে কোন পুরুষের চেয়ে বেশি কুকুরকে যোগ্য ভাববে। নারীর জন্য নিরাপদ দেশ চাই যেখানে ভয় নয় থাকবে স্বাধীনতা। থাকবে বন্ধুত্ব।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]