আমার শরীরের একচ্ছত্র ঈশ্বর আমি নিজে
প্রিয়া দেব।। বয়স তখন এগারো ছুঁই ছুঁই। আমাকে শেখানো হলো এখন আমি একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে বিকেলে খেলার মাঠে যেতে পারবো না। কারন আমার শরীর বদলাচ্ছে, আমার এই হঠাৎ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শরীর নিয়ে বাইরে গেলে পাড়ার ছেলেমেয়েদের, পাড়ার মাঝবয়সী পুরুষ মহিলাদের, কিংবা অবিবাহিত যুবক যুবতীদের চোখে সেটা অশ্লীল লাগতে পারে। যে আস্ত শরীরের মালিক হয়ে আমি জন্মালাম সে শরীর যখন বদলাচ্ছে, তখন তাকে পরম মমতায় পর্যবেক্ষনের বয়সে আমি শিখলাম শরীরের পরিবর্তন বড় নোংরা বস্তু। শরীরকে লুকাতে হয়, শরীরের সৌন্দর্যের কোনো পবিত্র সংজ্ঞা হয়না।
মা বরাবর চাকরীজীবী, মুক্তচোখে পৃথিবীকে দেখেন। তিনি ভাবেন তিনি যে ভদ্রতার সংজ্ঞাতে পৃথিবীকে মাপেন, সবাই বোধহয় সেভাবেই মাপে। সেজন্য এগারো-বারো বছরের মেয়েকে বিশাল ওড়নায় আবৃত করার চিন্তা তার মাথায় আসেনি। আমি স্কুলে যাই অন্য মেয়েদের মতো বড়ো ওড়না, বোরখা কিংবা হিজাব ছাড়া। একদিন একজন মাডাম ডেকে বললেন “শোনো তোমার ওড়না ভালো করে পরে আসা উচিত, তোমার বুকটা বড়ো বিশ্রী দেখায়।”
আমার বুকটা ভেঙ্গে গেলো কষ্টে, সে বয়সটাই এমন ছিল। শরীর নিয়ে কোনো কথা শুনলেই খারাপ লাগে। আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীরা আমার শরীর নিয়ে আড়ালে ফিসফাস করে, আমি কেন ভালো করে ওড়না পরিনা তা নিয়ে হাসাহাসি করে, আমার পাজামার ফিতে সামান্য বের হয়ে থাকলে তারা হাসির ফোয়ারা ছোটায়। আমি তখন জাফর ইকবালের বইয়ে বন্ধুত্ব শিখে আসা মানুষ। না পারি তাদের হাসির মমার্থ বুঝতে, না পারি আমার শরীরের কোনো অংশ যদি বৃদ্ধি পায় তাকে কেন এভাবে লুকাতে হবে তার সদুত্তর। তারপর একদিন গ্রামেরই এক অনুষ্ঠানে আমার মা গেলেন, সেখানে একজন বড় দিদি আমার মাকে চুপিচুপি ডেকে বললেন আমার বান্ধবীর মায়েরা নাকি বলাবলি করছেন আমার ভালো করে ওড়না পরা উচিত এসব নিয়ে। আমার শরীরের বৃদ্ধি নিয়ে এসব শুনে আমার বিবেচনাবোধসম্পন্ন মা বাড়িতে আসলেন, আমি তখন গুড আর্থ বইটা শেষ করে সেটা কী ভীষন ভালো লেগেছে তা মাকে বোঝাবো বলে হাসি মুখে এগোতেই আমার মায়ের হাতে একটা চড় খেলাম। তারপর অনেকক্ষন কিছু তিরস্কার, যেন এসব কিছুর দায় আমার!
আমার মা একবারো বুঝতে পারেননি এ চড়টা ওই মহিলাগুলোর মুখে মেরে আসা উচিত ছিলো। এ শরীরটা আমার, এ শরীরকে আমি কীভাবে রাখবো এ সিদ্ধান্ত একমাত্র আমার। আজকে বুঝতে পারি শরীর নিয়ে কোনো স্বাধীন স্বিদ্ধান্ত নিয়ে কেন এ দেশের মেয়েরা ভাবতে পারে না। কারণ আমরা তো সেই ছোটবেলা থেকে শিখে বড় হই, এ শরীরকে আমরা কীভাবে প্রদর্শন করবো, কীভাবে লুকিয়ে হাঁটবো তার সিদ্ধান্ত নেবে এ সমাজের মা, চাচা চাচী, মধ্যবয়স্ক পুরুষ মহিলা, সেই পুরুষ মহিলাদের থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েরা। আমরা প্রথম বুক স্ফীত হওয়ার সময়েই জানতে শিখি এখন নিজের বুককে সমাজের নির্দেশেই গাদাখানিক কাপড়ের মধ্যে লুকাতে হবে। নাহলে সমাজের মানুষের জাত যায়।
সমাজ বুঝতে পারে না তাদের নিজের ভুলটা, এ সমাজের মা, চাচী আর বান্ধবীর মায়েরা বুঝতে পারেন না, যে পুরুষেরা একটা এগারো বছরের বাচ্চার শরীরের বৃদ্ধি দেখে কামার্ত হয়, প্রতিনিয়ত সেসব পুরুষদের নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করা উচিত, সেই এগারো বছরের বাচ্চাটা কেন ভালো করে কাপড় পরে না সেটা নিয়ে আলোচনা না। বরং সেই বাচ্চাটাকে নিয়ে আলোচনা ভীষনরকম অশ্লীল, ভীষনরকম নোংরা।
তো এভাবেই শুরু হয় আমাদের শরীর নিয়ে এ সমাজের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার গল্প।
তারপর আমি বড় হই, তেরো বছরে জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো হয়রানির শিকার হই, মা বাবা মলেস্টকারী কাছের আত্মীয় বলে প্রতিবাদ না করে বিষয়টা সামলানোর চেষ্টা করেন, দিনশেষে তারা আমাকেই তীব্র বকাঝকা করেন।
তারা মনে করেন দোষটা আমার, কারন শরীরটা আমার। তারা তখনো বুঝেন নি এ শরীরটা আমার। আমি এ শরীরটা নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরলে যদি কোনো পুরুষের লালা ঝরে, তবে ওই পুরুষের উচিত মুখ সামলানো। আমার কোনো দায় নেই শরীরটাকে লুকিয়ে হাঁটার।
এ উনিশ বছরের জীবনে প্রচুর নারী পুরুষকে দেখেছি যারা কম বয়সের মেয়েদের শরীরকে কী রকম ক’রে লুকাতে হয় তা নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার মহান দায়িত্ব খুব মনোযোগ সহকারে পালন করেন। প্রতিনিয়ত তারা শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া মেয়েগুলোকে উপদেশ দিতে দিতে তাদের একসময় বুঝাতে সক্ষম হন যে শরীর বস্তুটা মেয়েদের নিজস্ব না, এ শরীরকে পুত পবিত্র রাখতে হবে সমাজের জন্য। আমি এসব পরামর্শ ফ্রিতে প্রচুর মেয়েকে পেতে দেখলেও আজ পর্যন্ত কোনো পুরুষকে পেতে দেখিনি।
কারণ দিনশেষে সবকিছুর পর মেয়েদের শরীরটাকে মেয়েরা পছন্দমতো প্রকাশ করতে পারবে না। পৃথিবী এগিয়ে গেছে কিন্তু এখনো এই দেশের কোনো সোস্যাল মিডিয়াতে কোনো মেয়ে সাহস করে বলতে পারবে না “আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত”। কারণ কমেন্টে তাকে বারোভাতারী, বেশ্যা শব্দগুলো শুনতে হবে। শর্টস পরে ছবি তোলা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটার নামের সামনে অভদ্র ট্যাগ লাগতে বেশি সময় লাগে না এ দেশে। আমাদের এ দেশের কোনো মিডিয়ার আজ পর্যন্ত এরকম সাহস হবেনা যে তারা কোনো অ্যাডে একটি প্রগতীশীল মেয়ের মুখ দিয়ে সমাজকে বলাবেন যে এ “মেয়েটার শরীরের মালিক একমাত্র এই মেয়েটা”, এ সমাজের কারো কোনো অধিকার নেই এ মেয়েটার শরীর নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করার। কিন্তু দিনশেষে এসব মিডিয়া নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে ঠিকই ব্যবহার করবে।
ইদানীং আবার সোস্যাল মিডিয়ায় নতুন ট্রেন্ডের সূচনা ঘটেছে। সে ট্রেন্ডের খেলায় জীবনে মদ না ছুঁলে পাঁচ পয়েন্ট, পর্ন দেখলে পাঁচ পয়েন্ট এবং অনেকগুলো খারাপ বদঅভ্যাস না থাকার এ খেলায় উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট হচ্ছে ভার্জিনিটি!
মানে কতটা অদ্ভুত হলে একটা সোসাইটি ভার্জিনিটিকে মহান করার স্বার্থে ভার্জিন না থাকা অবস্থাকে মদ খাওয়া,পর্ন দেখার মতো অভ্যাসে ফেলে কাউন্ট করতে যায়!
যেন ভার্জিনিটি বস্তুটা খুব মহান কিছু। আমার সবসময় মনে হয় এ সমাজ মেয়েদেরকে ভার্জিনিটি নামক ভিত্তিহীন পবিত্রতার বাঁধনে বাধছে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে। স্ত্রী হিসেবে কুমারী মেয়ে পাওয়ার জন্য, ভদ্র সভ্য ট্যাগ লাগিয়ে মেয়ে নামক পৃথিবীর একটি বৃহৎ সংখ্যাকে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করবার জন্য, মেয়েকে ঘরে ইচ্ছেমতো ভোগ বিলাসের পণ্য বানানোর জন্য এ সমাজ প্রতিনিয়ত তাদের ইচ্ছেমতো পবিত্রতার সংজ্ঞা বানাচ্ছে।
ব্যাপার সেটা না ব্যাপার হচ্ছে এতযুগ পরেও এ ধারনাগুলো বদলাচ্ছে না, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রূপে বুঝিয়ে যাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। প্রতিনিয়ত এ সমাজ নতুন নতুন রূপে সেই এক নিয়মে বুঝিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের শরীরটা মেয়েদের নিজস্ব সম্পদ না।
এর প্রমান যখন এ দেশে কোনো পুরুষ দুর্নীতিবাজ বের হয় তখন তার চরিত্র বিশ্লেষন করতে এ সমাজ বসে না, কিন্তু যখনই একটা মেয়ের কোনো দুর্নীতি প্রকাশ হয় তখন তার ট্যাগ লাগে বারোভাতারী, বিভিন্ন পর্নসাইটের ছবি এডিট করে ওই মেয়েটির ছবি বসিয়ে মিম বানানো হয়, তাতে হা হা রিয়েক্টের বন্যা বইয়ে দেয় লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতী। আর এ যুবক যুবতীরাই আমাদের ভবিষ্যত। ভাবতেও অবাক লাগে, ভয়ও লাগে যে একটা জাতি এখনো কোনো মেয়েকে ভোগ্যপন্য ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেনা। আর আমরা মেয়েরাও ভাবতে পারিনা যে এ শরীরটা আমার সম্পদ কারো ভোগের পণ্য না। আসলে যতদিন প্রতিটা মেয়ে চেঁচিয়ে এ কথা বলবে না ততোদিন পরিস্থিতি খুব একটা বদলাবে না।
আমার ভীষন কষ্ট হয় যখন কোনো মেয়ের খোলামেলা পোশাকে ছবি দেখলে অন্য আরেকটা মেয়ে গিয়ে ওই মেয়েটার চরিত্র বিশ্লেষন করতে বসে। এ বিষয়টা আজো অদ্ভুত। আমাদের শারীরিক স্বাধীনতাটা আসার রাস্তাটাই পায়না কারন আমরাই তাকে আসতে দেই না।
স্বাধীনতা তবু আসুক, একদিন তীব্র গলায় মেয়েরা বলুক আমার শরীরের মালিক আমি, আর কেউ না। এমনকি বিয়ে করলেই কোনো পতি পরমেশ্বর এ শরীরের ঈশ্বর হয়ে বসেন না। প্রতিটা মেয়ে বিশ্বাস করতে শিখুক, তাদের শরীরের একচ্ছত্র ঈশ্বর তারা নিজে,তারা নিজে বাঁচুক অন্যদেরও বাঁচতে শিখতে শেখাক।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]