November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

হাইহিল ছুড়ে ফেলে বললাম- আই অ্যাম বিউটিফুল!

দুর্দানা চৌধুরী।। একদম ছোট থেকেই হাইট কম আমার। বাবা মা দু’জনের হাইট কম, সুতরাং জেনেটিক্সের নিয়মেই বিধাতার দান। তবে আমি মনের মাঝে ক্ষীণ আশা পুষে রাখতাম, আমি বোধহয় লেইট ব্লুমার। বড় হলে হাইট বাড়বে। এই আশায় বুক বেধে হাইট নিয়ে করা সব টিটকারি হাসি মুখে ফিরিয়ে দিতাম।

ক্লাস সেভেনে ঊঠে আবিষ্কার করলাম সবাই তরতরিয়ে লম্বা হলেও আমি তিন ফুটা লিলিপুটই রয়ে গেছি। সমবয়সী কাজিন দেশে বেড়াতে আসলো। তখন পরিবারের সবার থেকে শুনলাম ও এতো লম্বা তুমি এতো ছোট কেন! ঠিকমতো খাও না, সাইকেল চালাও না, খেলাধুলা করোনা- আরও কত কি। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে এক আত্মীয় তো বলেই দিলেন- তুমি আরেকটু লম্বা হলে সুন্দর হতে। হাইট নিয়ে কথা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে ভাবলাম যে করেই হোক লম্বা হতেই হবে। অন্তত এভারেজ হাইটে পৌছানো চাই-ই চাই।

শুরু হলো আমার  লম্বা হওয়ার মিশন। দুধ খেতে একদম ভাল্লাগতো না একদমই। কষ্ট করে রোজ রাত্রিরে গেলাস ভর্তি দুধ গিলতে থাকলাম। সাইকেল চালানো শুরু হলো ঘড়ি ধরে। আর সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে কিনে আনলাম একজোড়া হাইহিল। হাস্যকর ছেলেমানুষী দেখেও বাবা মা কি আশ্চর্য নির্লিপ্ত থাকলেন যে দেখে ভারি দুঃখ হলো আমার। কেন এমনটা করছি কেউ জানতে চাইলো না। আমি বুকে পাথর চেপে লম্বা হওয়ার অদ্ভুত ছেলেমানুষী প্রচেষ্টা চালালাম। ইন্টারনেট ঘেটে এটা সেটা খাওয়া, দড়িলাফ, সাইকেল, সাঁতার কী করিনি তখন!

একদিন রাতের বেলা বাবা আরেক পিস মাছ সাধলেন। আমি না করলাম। বলতেই দোষারোপ করলেন খাওয়াদাওয়ার অভাবেই আমার এমন হাইট। ওইদিন আর আটকে রাখতে পারলাম না নিজেকে। সহজে চোখের পানি ফেলিনা আমি। কিন্তু ওইদিন ঝরঝরিয়ে চোখের পানি ফেলে বুঝিয়ে দিলাম এই ব্যাপারটা আমায় কতটা অসহায় করে রেখেছে।

বাবা মা নির্বাক,হতভম্ব এবং স্তম্ভিত। রাতটা কোনোরকম পার হলো। পরদিন সকালে আমি যখন ঘুমোতে যাচ্ছি বাবা তখন জেগে উঠলেন। দীর্ঘ দুই ঘন্টার আলাপে বোঝালেন, ‘যা অর্জন করতে চাও তুমি, তাতে তো তোমার উচ্চতা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। তবে কীসের এতো দুঃখ তোমার। আর সৌন্দর্য, সে তো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মোড়কে বাধানো ধারণামাত্র। সৌন্দর্য যেকোনো রূপে আসতে পারে।’ আর প্রতিজ্ঞা করলেন কখনোই এ নিয়ে আর কথা বলবেন না।

বাবা মেয়ে মিলে হাইহিল জোড়া ডাস্টবিনে ফেলে আসলাম। ওইদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম ঊনমানুষ নই আমি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরোটা সময় ধরে নিজের চিবুকে লেগে থাকা সবটুকু মায়া চিনে নিলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম যা আমার হাতে নেই তা নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করবো না কোনদিনও। হাইহিল ছুঁড়ে ফেলে কেডস আর শ্যু নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম নতুন সূর্য আনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। নিজের হাইট নিয়ে এমন ভয়ংকর কৌতুক শুরু করলাম যে যারা এ নিয়ে মজা করতো তারা পর্যন্ত থামতে বললো আমায়।

আমি সফল নই, বিখ্যাত কেউ নই, এখনও অর্জন করিনি কোনো কিছুই। তবুও আজ এ নিতে লিখছি যাতে বডি শেমিংয়ের শিকার আর শিকারী উভয়পক্ষই একটু হলেও বুঝতে শেখেন যে সৌন্দর্যের সীমা পরিসীমা নেই। সৃষ্টিমাত্রই  সুন্দর। নিজেকে কষ্ট দিয়ে পৃথিবীকে সৌন্দর্য দেখিয়ে কী লাভ বলুন। আপনার আসল রূপটা পৃথিবী দেখতে ভয় কীসের। দিনশেষে সবাই জানুক  ওই ডার্ক সার্কেল সাক্ষী আপনার রাগ জেগে কবিতা লেখার সংগ্রামের, উচ্চতা আপনার পূর্বপুরুষের নীলনকশার অংশ, আপনার অতিরিক্ত ওজন  হরমোনাল ইমব্যালান্সের কারণ অথবা আপনার ভোজনবিলাসের প্রতীক, আপনার শ্যামবর্ণ জানান দেয় আপনি পৃথিবীর কোন্ অঞ্চলের অধিবাসী আর আর এসব মিলিয়েই আপনি। এবং আপনি ভীষণ সুন্দর! আর কেউ না বলুক, অন্তত আয়নার সামনে একটি বার দাঁড়িয়ে বলুন-  ইয়েস, আই অ্যাম বিউটিফুল।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]