শরীরের ওপর চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত যেন মেনে নিতে না হয়
প্রতিমা সরকার।। বেশ কয়েক বছর আগে ফ্যামিলি ডাক্তার দেখাতে ঘরের পাশের হেলথ ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। বেশ একটু রাত করেই ছিল আমার সিরিয়াল। অল্প ক’জন রোগী বসে আছে। আর আমার ডাক্তার বেশ সময় নেয় একেকজন রোগী দেখতে। তাই সব কাজ সেরে রাত করেই যাওয়া।
যাই হোক, একটা চেয়ার খালি পেয়ে বসলাম। কিছুক্ষন পরে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলো অল্প বয়সী এশিয়ান (পরে কথা বলে জেনেছিলাম ভারতীয় ও মুসলিম) একজন রোগী, একটা ঢাউশ স্ট্রলার নিয়ে। সাথে একটা তিন, সাড়ে তিন বছরের মেয়ে। উঁকি দিয়ে দেখি স্ট্রলারে আরেকটা বাচ্চা ঘুমাচ্ছে, ছেলে না মেয়ে বুঝা যাচ্ছে না। আর মহিলার পেটে আরেকজন, কামিং সুন। সময় কাটানোর জন্য কথা বলা শুরু করলাম কয় মাস চলছে, স্ট্রলারের বাচ্চার বয়স কত? কোন বিল্ডিংয়ে থাকে ইত্যাদি দিয়ে (আমার বাসা একটা কমপ্লেক্সে, যেখানে দুই তিনটা বিল্ডিংয়ে প্রচুর বাংলাদেশি, ভারতীয়, শ্রীলংকান,পাকিস্থানীর বাস)। বলল, ওমুক বিল্ডিংয়ে থাকে। আট মাস চলছে, ডাক্তার ডেকেছেন কী এক টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে কথা বলবেন বলে।
আট মাস বলাতে একটু অবাকই হলাম, কারন মেয়েটির পেট দেখে মনেই হচ্ছিল না আট মাস চলছে। বলেও ফেললাম সে কথা। জবাবে বলল যে ডাক্তারও নাকি তাই বলেছে আর বাচ্চার ওয়েট বাড়ছে না এই জন্য আল্ট্রাসনো করতে দিয়েছিল। মেয়েটিকে আমার কাছে বেশ অসুস্থ মনে হলো। বয়স বেশি না কিন্তু কেমন যেন ফ্যাকাসে, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বুঝলাম রাতে ঠিক মত ঘুমাতে পারে না মেজ বাচ্চাটার জন্য। বয়স নাকি ১৮ মাস। বড়টার বয়স তিন, মেজটা ১৮ আর এখন আরেকটা। মনে মনে ভাবলাম, কী দরকার বাপু এত ঘন,ঘন বাচ্চা নেয়ার! জানি না সে আমার মন পড়তে পারলো কিনা। হঠাৎ বলল, তার হাসব্যান্ডের নাকি বাচ্চা পছন্দ, তাছাড়া আগের দুটোই মেয়ে, তাই এবার একটা ছেলের আশা করছে তারা। জিজ্ঞাসা করলাম, তা আল্ট্রাসাউন্ডে জেনেছে কিনা মেয়ে না ছেলে? বলল, ডাক্তার বলেনি। এখানে শুনেছি এমনই হয়, আগে যদি মেয়ে থাকে পরের বাচ্চার জেন্ডার বলে না ইচ্ছে করেই। মা বাবার মন খারাপ হতে পারে ভেবে।
এভাবেই কথাবার্তা চলছিল, মাঝে গিয়ে সে ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছ থেকে ঘুরে এলো। এরপর ডাক্তার ডাকবে। আবার অপেক্ষা। বড় বাচ্চাটি খুব বিরক্ত করছিল মাকে। একবার চেয়ারে বসছে তো আবার নামছে। এর মধ্যে স্ট্রলারেরটাও উঠে কান্না জুড়ে দিল। মা ব্যাগ থেকে দুধের বোতল বের করে বাচ্চার মুখে দিয়ে বড় টিকে কোলে নিয়ে বসলো। বললাম, এই অবস্থায় একা কেন এলো, বাচ্চাদের বাবা কোথায়? বলে, বাবা রাতে ট্যাক্সি চালায়। ভোরে আসবে। একপর্যায়ে বলব না বলব না করেও বলেই ফেললাম যে, তার হাসব্যান্ডের বাচ্চা পছন্দ ঠিক আছে, কিন্তু আরেকটু গ্যাপ দিয়ে তো নিতে পারত। সময় তো চলে যাচ্ছে না। আমার কথা বললাম, আমার ছেলের ছয় বছর পরে আমার মেয়ে হয়েছে। শুনে মেয়েটি বলল, তার হাসব্যান্ড কোনরকম প্রটেকশন নেয়া পছন্দ করে না। এমনকি মহিলাকেও কোনরকম ব্যবস্থা নিতে দেয় না। এটা নাকি ধর্মবিরোধী। আমি আর কিছু বলিনি। ধর্মে না থাকলে কিইবা বলার আছে? তবে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল যে, ধর্মে নেই কিন্তু কষ্ট তো ধর্ম করছে না, বাবাটিও করছে না। করছে মেয়েটি। তাছাড়া মেয়েটি নাহয় ধর্মের কারনে কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না। বাবাটি কেন নেবে না? নেবে না, কারণ তার পছন্দ নয়। বাহ! বেশ। উনি পুরুষ, তাই তার পছন্দ অপছন্দ আছে, কিন্তু নারী? তার কোন পছন্দ থাকবে না, থাকতে পারবে না। নারীর চাওয়া,পাওয়া,পছন্দ,অপছন্দ বলে কিছু নেই। এমনকি তার নিজের শরীরের উপরও কোন অধিকার নেই।
আমার এক প্রতিবেশি ভাবী মেয়েকে স্কুলে দিতে নিতে আসতেন। আমিও যেতাম মেয়ের জন্য। বাইরে অপেক্ষা করতে করতে অনেক কথা হতো উনার সাথে। উনারও দুটো মেয়ে।কিন্তু একদিন কথায় কথায় বললেন, উনার স্বামী নাকি উনাকে চাপ দিচ্ছেন আরেকটি বাচ্চা নেয়ার জন্য। উনার ছেলে লাগবে। কিন্তু ভাবীর মোটেও ইচ্ছে নেই আরেকটা বাচ্চা নেবার। কারন ভাবীর স্বাস্থ্যটা একটু মোটার দিকে আর উনি খুব অসুস্থ হয়ে যান প্রেগনেন্ট অবস্থায়। উনার প্রেশারও আছে। আমি বললাম, ভাই কি জানে না আপনার এই অবস্থা! উনি বললেন, জানে তারপরও প্রতিদিন ঘ্যানঘ্যান করে। আমি মজা করে বললাম, ভাইকে লিখিত দিতে বলেন, বাচ্চা হওয়ার আগে থেকে শুরু করে বাচ্চা হবার পরেও সব কাজ উনি করবেন। তাহলে দেখবেন, উনি আর ঘ্যানঘ্যান করবেন না। ভাবী খুব হাসলেন আবার বললেন, আরে বউদি এসব পুরুষদের আপনি চেনেন না। এরা সব পারে। লিখিত দিতে বললেও দেবে কিন্তু পরে সব ভুলে যাবে। ঝগড়া করেও লাভ হবে না। আমি কোন রিস্ক নিতে চাইনা। তখন আমি বললাম, তাহলে উনাকে বলেন যে, আপনি চাননা। কারণ শরীরটা আপনার। সব কষ্টও আপনার উপর দিয়েই যাবে। ভাবী বল্লেন, ঠিক বলেছেন বউদি। আমিও ভাবছি বলব।
আমার মেয়ে হওয়ার আগে দিয়ে দোকানে গেলে ছোট ছোট মেয়ে বাচ্চার জামা জুতা দেখে মনে মনে খুব চাইতাম আমার একটা মেয়ে হলে ওকে এরকম জামা পরাবো। এরপর যখন মেয়ে হলো তাকে সুন্দর সুন্দর জামা পরিয়েছি মন ভরে। আমার মেয়ের বয়স এখন বারো। গত কয়েক বছর ধরে সে আর মেয়েদের সালোয়ার স্যুট ফ্রক জাতীয় কোন জামা পরতে চায়না। হয় শার্ট না হয় টি-শার্ট পরে। মাঝে মাঝে দোকানে গিয়ে বয় সেকশন থেকে যখন ছেলেদের শার্ট বেছে নেয় আমি যদি বলি, মা এটা তো ছেলেদের। বলে, তো? কোথাও কি লেখা আছে আমি ছেলেদের শার্ট পরতে পারব না? আমি আমতা আমতা করে বলি, না মানে, তুমি তো মেয়ে। সে বলে, তাতে কী? এটা আমার বডি, আমি ঠিক করব আমি কী পরবো না পরবো। শুনে মনে মনে বলি, তাই করিস মা। কোনো চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত যেন তোকে স্পর্শ করতে না পারে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]