November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

শরীরের স্বাধীনতায় নারী পুরুষ সমান হোক

তৌকির ইসলাম।। আজকের লেখাটা যখন শুরু করি তখন মাথায় আসছিলো কোন বিষয়টার প্রতি আলোকপাত করব, কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ভোগবাদী চিন্তা ভাবনার এক বড় অংশ জুড়েই নারীর শরীর আর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতেও রয়েছে অসঙ্গতি। আমার মনে হয় “আমার শরীর, আমার স্বাধীনতা” এই শিরোনামটি দেখে যদি আপনার মনে হয় যে এখানে নারীর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের স্বাধীনতা বুঝানো হয়েছে তাহলে আপনি ভুল পথে হাঁটছেন। প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে? আসছি, একটু সময় দিন।

আমাদের সমাজে একটি মেয়ে যখন জন্মগ্রহণ করে, তার শরীরের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় ঠিক জন্মমুহূর্ত থেকে। ‘বাচ্চা মেয়েটার গায়ের রঙ কালো কিছুটা’, ‘ওর ঠোঁটটা উচু/নিচু’, ‘চুলগুলো কোঁকড়া/সোজা’ ইত্যাদি। এবার আপনিই বলুন একটি ছেলে জন্মানোর পর আপনি কতটুকু এই ধরনের কথা শুনেছেন! আপনি হয়তো মনেও করতে পারবেন না কবে শুনেছেন বা আদৌ শুনেছেন কিনা! একটি মেয়ে শিশুর বড় হওয়ার শুরুতেই তার পোশাক নির্ধারণ করে পরিবার বা সমাজ। আপনি ট্র্যাডিশনের কথা বলতে পারেন যে পোশাক সমাজ নির্ধারণ করে ট্র্যাডিশন অনুযায়ী। কথাটা আংশিক সত্য আমার কাছে। ধরুন ৬-৭ বছরের একটি মেয়ে শিশুর স্বাস্থ্য যদি একটু ভালো হয় তখন পরিবার চায় সে যেন আর হাফ প্যান্ট না পরে, গেঞ্জি না পরে। কেন? তাকে নাকি খারাপ দেখায়। একটু শুকনো হলে সুন্দর লাগত। মেয়ে শিশুটির শরীরের স্বাধীনতা রক্ষিত হল কোথায় এখানে! আসলে মেয়ে শিশুটিকে খারাপ দেখায় না বরং বলা উচিত সমাজের অসুস্থ যৌনতা শিশুটির দিকে তির্যক দৃষ্টি দিয়ে বীর্যস্খলন করছে। এর মানে এই নয় যে শুকনো অথবা চিকন মেয়ে শিশুটি এই ভাবনার বাইরে। পরিবার তখন তার স্বাস্থ্য ভালো করা নিয়ে ভাবা শুরু করে। সুস্বাস্থ্যের কথা হলে ভাবনাটা অতি উত্তম। কিন্তু চিন্তাটা যদি এমন হয় যে এই রোগা মেয়ের বিয়ে হবে ভবিষ্যতে কেমনে, তাহলে ভাবনাটা অমূলক ও আপত্তিকর।

একটি মেয়ে শিশুর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত তার সুস্বাস্থ্য, তার পুষ্টি, তার শারীরিক বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয় শুধুমাত্র বিয়ের জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। অধিকাংশ পরিবার এটা ভাবেই না যে তার মেয়ের শারীরিক বিকাশ জরুরি। আমার কথা অবিশ্বাস হতে পারে কিন্তু সমাজে যদি একটু খেয়াল করেন তবে দেখতে পাবেন একজন শ্যাম বর্ণের মেয়ের পরিবারের কি চিন্তা! আর এরপরেও যদি মনে করেন যে, মেয়ের শরীরের স্বাধীনতা এতে খর্ব হচ্ছে না, তাহলে এই সমাজের যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব তা আপনাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে বলে আমার মনে হয়।

এরপর আসি আমাদের সমাজের বিয়ের ব্যবস্থা নিয়ে। বিয়ের সময় সমাজে যেভাবে পাত্রী দেখা হয় তা মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকে চরম অপমান করা ছাড়া আমার কাছে আর কিছু মনে হয় না। আপনি বলতে পারেন পাত্রী অথবা পাত্র দেখে বিয়ে করব না! অবশ্যই করবেন। কিন্তু পাত্রী নির্বাচনের সময় পাত্রীর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত যেভাবে দেখা হয় ঠিক সেভাবে কি পাত্রকে দেখা হয়? এমনকি পাত্রীর নিজ পরিবারের মানুষজনের মধ্যেও দেখতে পাবেন একটা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। বুঝিয়ে বলছি বিষয়টা। পাত্রপক্ষ একজন পাত্রীর শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তা কি পাত্রী নিজে কিংবা পাত্রীপক্ষ করতে পারে? মোটেও না। পাত্র খাটো, মোটা, কালো বলে কয়টা বিয়ের প্রস্তাব ফেরত যেতে দেখেছেন? কিন্তু আমি পাত্রীর দাঁত দেখার মত ঘটনার কথাও শুনতে পাই এবং পাত্রীকে ভালো লাগে নি এটাও বুঝতে পারি। এখানে একজন নারীর শরীরের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়। একজন মেয়ের শরীর নয়, মানসিকভাবেও তাকে হ্যারাস করা হয় তথাকথিত এই পাত্রী দেখার নাম করে। স্বাধীনতা হবে তখন যখন একজন মেয়ে নিজে এবং তার পরিবার স্পষ্ট করে নিজেদের পছন্দ অপছন্দের কথা জানাতে পারবে। শুধু পাত্রের আয়-পদবী দিয়ে আর পাত্রীর শরীরের সৌন্দর্য দিয়ে স্বাধীনতা শব্দের মূল্যায়ন হবে না।

আমি লেখার শুরুর অংশেই বলেছি যে একজন মেয়ের শারীরিক স্বাধীনতা খর্ব হয় তার জন্মের পর থেকে এবং তা আমি একটু একটু করে দেখানোর চেষ্টা করেছি জন্ম থেকে একজন মেয়ের বড় হওয়া পর্যন্ত। একজন মেয়ে যখন কিশোর বয়সে পদার্পণ করে তখন তার শরীরের এক বড় পরিবর্তন পিরিয়ড। শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে স্বাধীনতা ব্যাহত হয়ে চরমভাবে। তাকে বুঝানো হয় এটা গোপন। এটা লজ্জার। একটা মেয়ে পিরিয়ডিকালে যত কষ্ট পাক তাকে পরিবার, সমাজ শিক্ষা দেয় এটা লুকিয়ে রাখতে, শুধুমাত্র মা, বোন, বড়জোর তার মাসি-পিসি’র কাছে শেয়ার করতে। এবার সে ব্যাথায় মরুক কিংবা ব্লিডিংয়ে সে দুর্বল হোক না কেন সে তার বাবাকে বলার (সাহসই বলুন আর স্বাধীনতাই বলুন) সুযোগ পায় না একটা প্যাড কিংবা ব্যাথার ট্যাবলেট তাকে এনে দেওয়ার জন্য। একজন মেয়ের প্রজনন স্বাস্থ্যের স্বাধীনতাও খর্ব হয় সামাজিক ট্যাবু আর মিথ্যে লজ্জার মোড়কে।

যৌন জীবন তথা জৈবিক চাহিদা সকল প্রাণির মধ্যেই বিদ্যমান। আর নারীর শরীরের স্বাধীনতাকে চরম আকারে ধ্বংস করা হয়েছে এই যৌন জীবনের ব্যাপারগুলোতে। নারীর যৌন জীবন নিয়ে আমাদের পরিবারগুলো আর সমাজ বেশ হিপোক্র্যাট। একজন মেয়েকে তার ভার্জিনিটি রক্ষার তাগিদ দেওয়া হয় কিশোর বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত; কিন্তু সেই একই পরিবারের ছেলে যৌনতার জন্য কয়জন মেয়ের সাথে প্রতারণা করলো বা অভব্য আচরণ করলো, সেই ব্যাপারে নির্বিকার। যৌন জীবন নিয়ে কথা বললে সমাজ মেয়েদের চরিত্রহীন নষ্ট হিসেবে আখ্যা দেয় কিন্তু সেই একই বিষয়ে ছেলেদের কথা বলাকে ধরে নেওয়া হয় বীরত্ব! এমনকি একটি স্বাভাবিক সম্পর্কেও নারীর শরীরের স্বাধীনতা থাকে না। একজন পুরুষ সঙ্গী তার নিজের যৌন তৃপ্তির কথা যেভাবে ভাবেন, একজন নারী সঙ্গী সেভাবে ভাবলেই তাকে খারাপ মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুরুষ সঙ্গী নারীর তুলনায় দুর্বল হতে পারে কিন্তু এই কথা কি একজন নারী মন খুলে তার পুরুষ সঙ্গীকে বলতে পারে! মোটেও না। বরং পুরুষ সঙ্গী তার আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকেন। নারীর যৌন জীবন, যৌনতা, যৌন সুখ, যৌন তৃপ্তি নিয়ে কথা বলতে সমাজ, পরিবার, সঙ্গী তাকে বাধা দেয়; তাকে চরিত্রহীন নষ্ট মেয়ে আখ্যা দেয়। একজন নারীর শরীরেরও যে পুরুষের মতো চাহিদা আছে তা এই সমাজ আর পরিবার মানতে নারাজ। আর এভাবেই নারীর শরীরের স্বাধীনতাকে শেকল পরানো হয়।

পরিবার ও সমাজ যদি একটি মেয়ের বিয়েবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কে বাঁধা দিতে পারে তবে একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও একই হওয়া উচিত। পুরুষ শরীর নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবে আর নারী পুতুলের মত থাকবে, তাহলে এমন সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থার কী দরকার আমি বুঝতে পারি না। যদি আপনি সামাজিক অনুশাসন মানতে চান তাহলে নারী-পুরুষ সবার জন্যই মানুন। ধর্মীয় অনুশাসন মানতে চান তাহলে নারী পুরুষ সকলের জন্যই মানুন। একজন পুরুষ শরীরের স্বাধীনতা যেমন রয়েছে, একজন নারীরও শরীরের স্বাধীনতা রয়েছে। নারীর শরীরের স্বাধীনতা মানেই শুধুমাত্র  শারীরিক সম্পর্কের স্বাধীনতা নয় বরং নারীর শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের, নারীর শারীরিক সৌন্দর্যের, শারীরিক বিকাশের এবং সুস্বাস্থ্যের স্বাধীনতাই নারীর শরীরের স্বাধীনতা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]