নারীর প্রতি আক্রোশের বাজার বুঝে শিপ্রার ছবি শেয়ার ও পৌরুষের টেবিল নাচ
মাসকাওয়াথ আহসান।। চকিতে চোখে পড়লো কিছু ছবি; একটি তরুণীর ব্যাক্তিগত কিছু ছবি। ভাবলাম আবার হয়তো সাবরিনা-সাবরিনা খেলার সাধ জেগেছে বিনোদনবঞ্চিত সমাজের। তরুণীর কিছু ছবি শেয়ার করে, ‘‘এমন করে আরো আসছে লেখা” যে; পোস্টদাতা যেন এমেরিকা আবিষ্কারকারী কলম্বাস; বিরাট কিছু একটা আবিষ্কার করেছেন।
মেজর সিনহাকে হত্যাকারী প্রদীপ-লিয়াকতের কোন সহকর্মী তার পুলিশ-সমাজের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে; সিনহার ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রকল্পের অন্যতম সহকর্মী শিপ্রা যেহেতু নারী; তার ছবির ফেসবুক প্রতিক্রিয়া বেশি পাওয়া যাবে; তাই শিপ্রার ছবি ছড়িয়ে দিয়েছে; এটা খোলা চোখে দেখা গেলো। সাবরিনা বা অন্য নারীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে; ফেসবুকে কলঙ্কিনী নারীকে অভিশাপ দেয়ার ব্যাপক ‘ঘৃণা উদগীরণ বাজার’ আছে পুরুষ সমাজে।
একটি আপোষকামী অমেরুদণ্ডী সমাজ; যেখানে সবাই শক্তের ভক্ত নরমের যম; কাজেই ‘নারী’-কে এখানে পাওয়া গেছে খুব নরম এক টার্গেট হিসেবে। নারী কী পরবে কী খাবে কীভাবে হাঁটবে এইসব নিয়ে ঘরে ঘরে গবেষণাগার; সেইখানে বসে সব তাবড় মূল্যবোধ বিজ্ঞানী।
পশ্চিমের দেশে দেশে যেখানে বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করেন নতুন জিনিস উদ্ভাবনে যা মানব সভ্যতাকে উপকৃত করবে; সেইখানে দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যবোধ বিজ্ঞানীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে ধর্ম-দেশপ্রেম নিয়ে গবেষণা করে; আর বিনোদন গবেষণার একটাই বিষয়, নারী-তার শরীর-মূল্যবোধ ইত্যাদি।
ধর্ম-রাজনীতির দোকান করে বলিবর্দ চর্বিসর্বস্ব পুরুষেরা এখানে ‘ও’-তে ওড়না ছাড়াই ঘুরতে পারে; তাদের জন্য বক্ষবন্ধনী তৈরির উদ্যোগও কোন উদ্যোক্তা নেন না; অথচ একজন নারীর ‘ও’-তে ওড়না ছাড়া ছবি দেখে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মাতমে দিশেহারা হয় পুরুষ সমাজ।
যৌন অবদমনের দক্ষিণ এশিয়ায়; অনেক পুরুষের মস্তিষ্কটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ লিবিডো গবেষণাগার। সামনে দিয়ে কোন নারী হেঁটে গেলে তাকে এক্সরে করে দেহাবয়বের ধারণা পেয়েই বুনো উল্লাসে ফেটে পড়ে এরা।
এইটাই দক্ষিণ এশিয়ার সমাজের আত্মপরিচয়; এইখানে অধিকাংশ পুরুষ অবসরে কেবল নারী শরীর নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দেয় আঁশটে জীবন।
কিছু শিক্ষা সার্টিফিকেট পাওয়া লোক রেগে গেলে ভেতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে তার চিন্তার বাঁশঝাড়। সাবরিনা কিংবা শিপ্রার ছবি নিয়ে লোফালুফির ‘লা গোবরিনা ফেস্টে’ বেশ কিছু তথাকথিত শিক্ষিত লোক তার মনের প্রাতঃক্রিয়ার বাঁশঝাড় উন্মুক্ত করেছে।
এইতো কয়েক দশক আগে দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ মানুষ রেললাইনের ধারে কিংবা বাঁশঝাড়ে প্রাতঃক্রিয়া সারতো। সময়ের বিবর্তনে এখন তারা টাইলস বাঁধানো আরাম ঘরের উচ্চ কমোডে বসে বেশ ‘ওয়াশরুম’ ব্যবহার শিখলেও; ফেসবুকে এলেই ভেতর থেকে মরার কোকিলার মতো ডাক দেয় রেললাইন ও বাঁশঝাড়ের ধারের প্রাতঃক্রিয়া।
শিপ্রা কেন ধূমপান করলো; নারী কেন ধূমপান করলো; এই প্রশ্ন করে যে ধর্ম মামা; তার দাদি যে দাদার সঙ্গে বসে হুঁকোয় টান দিতো; কিংবা দক্ষিণ এশিয়ায় সুদীর্ঘকাল ধরে নারী বিড়ি ধরিয়ে অবসর কাটাতো; সেসব তো মনে নেই কারো। বিরাট জোব্বা জাব্বা পরে এক একজন মূল্যবোধ গবেষক; নারীকে তেঁতুল ভেবে ফেসবুকের দেয়াল চাটতে চাটতে মালয় দ্বীপের বোকা শেয়ালের মতো মূল্যবোধের হুক্কাহুয়া তোলে।
শিপ্রা শুধু নারী নয়; সে হিন্দু ধর্মাবলম্বী; সুতরাং ফেসবুকে সে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার হয়। আর দুই ছটাক বুদ্ধির লোকেরা হিন্দু শব্দের সঙ্গে ভারতকে কল্পনা করে। দুই ছটাক বুদ্ধির লোক অ-আওয়ামী লীগ মুসলমান শব্দের সঙ্গে যেমন পাকিস্তানকে কল্পনা করে। বাংলাদেশ সাধুসন্তে খুব গিজগিজ করছে তো; তাই নিজ গ্রামের কেউ অপরাধ করলে তাকে ভারত কিংবা পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কইয়া দিলেই যেন, বাংলাদেশের ঘাড় থেকে অপরাধের বোঝা হালকা হয়।
এটা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে; সেই অপারেশান ক্লিন হার্ট থেকে অপারেশান ক্লিন হেডের উন্নয়নমুখী ক্রসফায়ারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সরকারের আইন রক্ষী বাহিনী। সেই রক্ষী বাহিনীর লিয়াকত গুলি করে হত্যা করেছে মেজর সিনহাকে; তার কমান্ডিং অফিসার প্রদীপের নির্দেশে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন ক্রসফায়ারবিরোধী জনমত বিস্ফারিত; তখন একবার বাংলা ফিল্মের কোবরাকে বের করে এনে একবার স্কেপ গোট বানানোর চেষ্টা চললো ভাটিয়ালী গুজবে। কোন কোন গু’জবের মস্তিষ্ক মেজর সিনহাকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে যন্ত্র ঐ একটাই ‘ষড়যন্ত্র’ নাড়াচাড়া করতেও চেষ্টা করেছে। প্রায় তিন দশক ধরে পুলিশে কর্মরত ওসি প্রদীপকে হিন্দু বলে ভারতের এজেন্ট বানানোর চেষ্টা চলেছে; আবার ডিপ ফেইক ছবি বানিয়ে মরিয়া সহমত ভাইয়েরা তাকে হিন্দু হইলেও পাকিস্তানের এজেন্ট হইতারে টাইপের যন্ত্র ঐ একটাই ‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে ক’দিন ঘুরপাক খেয়েছে। অত্যন্ত প্রগতিশীল সহমত ভাই পুলিশ লিয়াকত শিবির কর্মী ছিলো প্রমাণের সংকল্প নিয়ে ঘুরেছে। কিছুতেই হালে পানি না পেয়ে দুর্বল টার্গেট শিপ্রার ওপর চড়াও হয়েছে। ঢাকার কোন শিবসেনা সহমত ভাইয়ের সঙ্গে শিপ্রার একটা কার্টেসি কলের ছবি দিয়ে রীতিমত ভাটিয়ালি ‘নেসেসারি ইলিউশান দিয়েছে’; যেন গদ গদ হয়ে সবাই দুয়ে দুয়ে চার করে, শিপ্রাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেটিভ বানিয়ে ফেলে।
গোয়েন্দা গল্প-চলচ্চিত্র দেখা ভালো; কিন্তু ওসব দেখে যা চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে; সেইখানে যন্ত্র ঐ একটাই ‘ষড়যন্ত্র’ এনে এনে চিন্তাভাবনার ক্ল্যারিটিই নষ্ট হয়ে গেছে অনেক লোকের।
যে কোন ঘটনা ঘটলে তার সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। তদন্ত কাজের জন্য রাষ্ট্র বেতন দিয়ে লোক রাখে । ফেসবুক ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফ বি আই) দিয়ে হত্যা তদন্তের কাজ যে সম্ভব নয়; এই কমনসেন্সটিই অনুপস্থিত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
বিচার কাজের জন্য রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ আছে; আইন-আদালত আছে। ফেসবুক ট্রায়ালের মাঝ দিয়ে অসংখ্য বিচারকের সমাবর্তনের যে দৃশ্য আমরা দেখি; এটাও শৈশব স্মৃতির পাতকুয়ার ধারে পঞ্চায়েতের সালিশের জীনগত আশ্লেষ। সাহেদ-সাবরিনাকে দোররা মেরে বাংলাদেশের দুইমাত্র দুর্নীতিবাজকে শাস্তি দিয়ে তৃষ্ণার্ত ভাওয়াইয়া ট্রায়াল সমাজ; শিপ্রাকে পেয়ে যেন হুরমতীকে পেলো; যার কপালে কলংকের ছ্যাঁকা দেয়া যাবে।
প্রদীপ-লিয়াকতের কুকীর্তির জনসমালোচনার ওপর দিয়ে শিপ্রার ব্যক্তিগত ছবির একটা নহর বইয়ে দিয়ে যে ফেসবুক ‘প্রদীপ’ এই অনৈতিক কাজ করেছে; ওর কালচারাল লেভেলটা চিন্তা করেন। এর যে ডিনাইয়াল বা অস্বীকার রোগ; সেইখানে নারীর ওপর আক্রোশের বাজার বুঝে শিপ্রার ব্যাক্তিগত ছবি শেয়ার করে যে ঘৃণ্য ডিফেমেশান বা মানহানিকর বক্তব্য দেয়া হয়েছে; এর জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন; তা সে যতবড় তালগাছই হোক না কেন।
‘লা গোবরিনা ফেস্ট’ বা অন্যের চরিত্রহননের নেশা বিষাক্ত এক মাদক। এই মাদকাসক্তিতে ভুগছে সমাজের বড় একটি অংশ। অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার বা এরিয়া অফ প্রাইভেসিতে নাক গলানোর যে ‘ফুচকি মারা স্বভাব’ আর ‘কুঁচকুঁচ করে আ-কথা-কুকথা বলার কু-অভ্যাস’ এগুলো এতো আদিম ব্যাপার যে; চিন্তার আদিম স্তরে থাকা লোকেদের কিছুতেই যেন এটা বোঝানো সম্ভব নয়, অন্যের ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করা আর সেই পোস্টে লা গোবরিনা ফেস্টে মেতে ওঠা সাইবার অপরাধ। এগুলো মানহানির ফৌজদারি অপরাধ; এটা বোঝার ক্ষমতা ‘অষ্টাদশ শতকের জঙ্গলমনগুলো’-তে অনুপস্থিত।
যারা শিপ্রার মূল্যবোধের অবক্ষয়ে পেরেশান; তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন যে ছবিতে প্রদর্শনযোগ্য নয়; তা বলাই বাহুল্য। কোন ছবিতে বা অবজেক্টে কোন অশ্লীলতা বা অবক্ষয় থাকেনা। যে দেখছে তার মনে অশ্লীলতা থাকলে; তবেই ছবিটির ওপরে অশ্লীলতা আরোপিত হয়।
ফেসবুকে দুইদিন পর পর ঝাঁপ দিয়ে ওঠে অনেকে; এতো দেশে কোভিড নাইনটিন ভাইরাস প্রতিষেধক ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের গবেষণা চলছে; বাংলাদেশে এমন গবেষণা নাই কেন! এর উত্তর খুব সহজ, সারাজীবন কোন কাজের কাজ করতে না পেরে তবুও পৌরুষের টেবিল নাচ দেখাতে; এই যে উচ্চস্বরে তেঁতুল গবেষণা; তা ঢাইকা রাখার ধন্বন্তরী পদ্ধতি ও দফা আবিষ্কার; বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়ে সারাক্ষণ নারীর দেহবল্লরী নিয়ে গবেষণার যে ব্যস্ততা; এইসবেই সময় কাটছে। নারীর মালিকানা দাবি করার এই ফ্রড ও ফ্রয়েডের সমাজে; মস্তিষ্কজুড়ে যৌন অবদমন আর বাস্তবে, সম্ভব না হলে যে ভার্চুয়াল ধর্ষণাকাঙ্ক্ষা; এইরকম বর্জ্যচিন্তার সমাজে কোভিড নাইনটিন ভ্যাকসিন গবেষণার অবকাশ কোথায়!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]