November 2, 2024
কলামফিচার ২

আদিবাসী নারী ও আমাদের নারীবাদ   

ইমতিয়াজ মাহমুদ।। ঢাকা শহরে এক রকম একটা নারীবাদী জাগরণ তো হয়েছে। খুব সমন্বিত নয়, রাজনৈতিক দর্শন খুব স্পষ্ট নয়, এমনকি নারীর অধিকার প্রশ্নেও সকলের সুস্পষ্ট একক কোন মতবাদ ওদের মধ্যে পাওয়া মুশকিল। এরপরও বলতেই হয়, বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে নারী অধিকার নিয়ে একটা লড়াকু জাগরণ ঘটেছে তো বটেই। এই জাগরণটাকে আমি নারীবাদী আন্দোলন বলতে চাই- কেননা আমাদের এই নারীবাদীরা একসাথে মিলে একটা রাজনৈতিক ঐক্যমত্য বা প্রস্তাবনা তৈরি করেননি বটে, কিন্তু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে যে প্রচলিত সমাজ ও পুরনো সব প্রথা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ভাঙতে হবে এই ব্যাপারে মোটামুটি সকলেই একমত। এরা প্রায় সকলেই নারীর বঞ্চনা ও শোষণের জন্যে পুরুষতন্ত্রের ভূমিকাটাও ঠিকই চিহ্নিত করেন এবং নারীর অধিকারের প্রশ্নটা যে একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন সেটাও অনুধাবন করেন। তাইলে এদেরকে আপনি নারীবাদী না বলে কী বলবেন?

জাগরণটা হয়েছে মূলত ঢাকা শহরে। নিশ্চয়ই ঢাকার বাইরেও এই জাগরণ ছড়িয়েছে। বিশেষ করে বড় বড় মেট্রোপলিটান শহরগুলিতে তো বটেই। খুঁজলেই আপনি চট্টগ্রাম সিলেট বা খুলনায় কিংবা ময়মনসিংহে দেখবেন মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ক্যাম্পাসে বা অন্যত্র নারীবাদ চর্চাটা ঠিকই করেন। পড়েন, আলোচনা করেন, ফেসবুকে নিজেদের মতামতটা প্রকাশ করেন, ব্যক্তিগত জীবনে যতটুকু সম্ভব নিজের মতামতটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। শুধু বড় শহরগুলিতেই নয়, একদম মফস্বলে বা অজ পাড়াগাঁয়েও মেয়েরা রয়েছেন যারা সচেতনভাবে বুঝে শুনে নিজেকে নারীবাদী বলতে পছন্দ করেন। বছর তিনেক আগে একবার একটা অনুষ্ঠানে গেছি- তসলিমা নাসরিনের জন্মদিন উপলক্ষে তসলিমা পক্ষ নামে একটা সংগঠনের অনুষ্ঠান। খুব বেশি মানুষ নেই, সব মিলিয়ে শ খানেক হবে। মেয়েরাই সব, পাঁচ ছয়জন পুরুষও রয়েছে। দেখি কি, দর্শকদের সারির একদম শেষ দিকে বাচ্চা বাচ্চা কয়েকটা মেয়ে- ইশকুলের শেষ দিকে পড়ে বা কলেজে হয়তো উঠেছে মাত্র। অনুষ্ঠান শেষে একজন পরিচয় করিয়ে দেয় ওদের একজনের সাথে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসেছে। না, আয়োজকরা উদ্যোগ নিয়ে নিয়ে আসেননি ওদেরকে। ফেসবুকে অনুষ্ঠানের খবর দেখে নিজেরাই চলে এসেছে। ভোরবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গাড়িতে উঠেছে, অনুষ্ঠানে বক্তৃতা শুনে পড়ে আবার সন্ধ্যার আগে আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে যাবে।

দূর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দিনে দিনে ঢাকা এসে অনুষ্ঠান শেষে আবার সেখানে ফিরে যাওয়া একটা কিশোরীর জন্যে খুব সহজ কাজ না। কেন এই কষ্টটা করতে গেছে মেয়েগুলি? শুধুমাত্র তসলিমা নাসরিনকে ইন অ্যাবসেনশিয়া একটা হ্যাপি বার্থডে বলে কেক ফেক খাওয়ার জন্যে? না, সে তো হবার কথা নয় আরকি। ওদের সাথে কথা হয় এটা সেটা। ওরা বেশ করে তসলিমা নাসরিন পাঠ করেছে। তসলিমা ওদের কাছে পথ প্রদর্শক, তসলিমার প্রতি ওদের বিপুল ভালোবাসা। কিশোরীরা আমাকে জানায় তসলিমা নাসরিনের লেখায় ওরা দেখে ওদের নিজেদের জীবনের কথা। নিজেদের ছোট জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই ওরা জানে তসলিমার প্রতিটা প্রতিবাদ প্রতিটা কথাই বাঙালি নারীর প্রাণের কথা। সেই সাথে ওরা জানায় শুধু তসলিমা নাসরিনের বই পড়ার কারণেই ওদেরকে কী রকম নিগ্রহ সহ্য করতে হয়। পরিবারে, স্কুলে কলেজে ওদের সমবয়সী ছেলেরা, বয়স্ক লোকেরা এমনকি মেয়েরাও ওদেরকে চিহ্নিত করে বেয়াদব নাস্তিক ফাজিল মেয়ে হিসাবে। ওদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এইরকম কত কি!

তার মানে ঢাকার বাইরেও মেয়েদের মধ্যে একটা জাগরণের মত যে হয়েছে সেকথা তো বলতেই হয়। কিন্তু ছোট শহর বা গ্রামের অসুবিধা হচ্ছে একেকটা এলাকায় একজন বা দুইজন মেয়ে হয়তো নারীবাদী চিন্তা করে বা নারীবাদীদের লেখা ইত্যাদি পড়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অনলাইনে শহুরে নারীবাদীদের সাথে একরকম যোগাযোগও হয় ওদের, কিন্তু মফস্বলের বিপুল পিতৃতান্ত্রিক জগদ্দল থেকে নিজের পরিমণ্ডলে নারী অধিকার নিয়ে নিজেদের চিন্তা স্পষ্ট করে বলা বা দল বেঁধে আলোচনা করা সেটা আর ওদের পক্ষে হয়ে ওঠে না। এই জন্যে জাগরণটা ঢাকায় যেরকম দৃশ্যমান, অন্যত্র সেরকম নয়। কিন্তু আপনি যদি নারীদের মধ্যে নারীবাদী চিন্তার বিকাশের কথা বলেন, তাইলে বলতেই হবে যে বিকাশটা ঢাকায় যেরকম হয়েছে, ঢাকার বাইরেও হয়েছে। নানা মত নানা পথ আছে, কিন্তু নিজেকে নারীবাদী মনে করেন এরকম নারীর উপস্থিতি আপনি সর্বত্রই দেখতে পাবেন।

এটা হচ্ছে আমাদের বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্তের নারী ও নারীবাদ চর্চার একটা চিত্র। কৌতূহল জাগানিয়া ব্যাপার হচ্ছে যে আমাদের এই নারীবাদী চর্চার মধ্যে আদিবাসী নারীদের অধিকার আর ওদের বঞ্চনার কথা খুব একটা আসে না। এমনিতে সাধারণভাবে দেশের সকল নারীর যেসব সমস্যা সেগুলি প্রসঙ্গ এলে দেশের অন্যান্য সমস্যার মত আদিবাসী নারীর সমস্যা নিয়েও ওরা বলেন বটে। কিন্তু বিশেষভাবে কেবল আদিবাসী হওয়ার কারণেই নারীকে যেসব সমস্যা ও বঞ্চনার শিকার হতে হয় সেগুলি নিয়ে বিশেষভাবে ওদেরকে কিছু বলতে দেখিনি। এমনকি উচ্চশিক্ষিতা আদিবাসী নারীরাও, একজন দুইজন ছাড়া, নারীবাদ বা নারী অধিকারের প্রশ্নটিকে দেশের সকল নারীর জন্যে একটি সাধারণ প্রশ্ন হিসাবেই দেখেন। আদিবাসী নারীর সমস্যা যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর নারীর সমস্যার চেয়ে ভিন্ন সেটা কাউকে চিহ্নিত করতে দেখিনি।

একটা উদাহরণ দিই। মনে করেন একজন পাহাড়ের আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হলো। ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সকলেই প্রতিবাদ করবেন, এই ক্ষেত্রেও করবেন। নারীবাদীরা একটু বেশি করবেন। এইটুকু ঠিক আছে, এইটা আমাদের এখানে হয়। কিন্তু একজন সমতলের বাঙালি নারীর ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হওয়া আর পাহাড়ের একজন নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই একটা পার্থক্য থাকে। (সবসময় হয়তো নয়।) যখন পাহাড়ের একজন আদিবাসী নারী তাঁর আদিবাসী পরিচয়ের জন্যে ধর্ষণের শিকার হয়, তখন সেটা আর কেবল সাধারণ একটি ধর্ষণ থাকে না, সেটা হয় একটা জাতিগত নির্যাতনের বহিঃপ্রকাশ। নারীবাদী এবং অন্যান্যরা যখন এইসব নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন তখন কিন্তু কেবল ধর্ষণটা বা নির্যাতনটার প্রতিবাদ করেন মাত্র- ধর্ষণটার বা নির্যাতনটার পেছনে যে জাতিগত নির্যাতনের প্রেক্ষাপট সেটা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেন না।

অনেককেই বলতে শুনেছি, ভাই ধর্ষণ তো ধর্ষণই, ভিক্টিমের জাতিগত পরিচয়ের জন্যে একটা অপরাধ থেকে আরেকটাকে আলাদা করার কী আছে ইত্যাদি। ওরা যে ভুলটা করেন, ধর্ষণ সবসময় শুধুমাত্র ধর্ষণ কেবল নয়। জাতিগত নির্যাতন বা ধর্মীয় বা বর্ণবাদী বা গোত্রীয় নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ধর্ষণের ব্যবহার অতি পুরনো। পিতৃতন্ত্র চালু হওয়ার পর থেকেই যুগে যুগে শত্রুপক্ষের নারীদেরকে ধর্ষণ করা যুদ্ধের একটি অনিবার্য অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ইতিহাসে এর অজস্র উদাহরণ পাবেন, কিন্তু আমাদের জন্যে তো এটা বুঝার জন্যে পৃথিবীর ইতিহাসের খুব বেশি পাতা ঘাঁটতে হয় না। আমাদের নারীদের উপর পাকিস্তানী বাহিনী যে নির্যাতনটা করেছে সেটা তো আমরা এখনো ভুলে যাইনি আরকি। পাকিস্তানী মিলিটারিরা কি বাঙালি মেয়েদেরকে ধর্ষণ করেছেন কেবল শারীরিক তৃপ্তির জন্যে? তা তো নয়। এটা ছিল ওদের সামরিক কর্মকাণ্ড বা যুদ্ধেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেইসব অত্যাচারকে তো আপনি ‘ধর্ষণ তো ধর্ষণই’ বলে পিনাল কোডের অধীনে একটা সাধারণ অপরাধের কাতারে ফেলতে পারেন না। সেটা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। একইভাবে আপনি যখন পাহাড়ের একজন আদিবাসী নারীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন, সেটাকে কেবল আরেকটি ধর্ষণ বলে দেখবেন তাইলে তো হবে না।

ধর্ষণ বা নির্যাতনের কথাই কেবল নয়। নারী অধিকার সংক্রান্ত প্রায় সকল প্রশ্নেই আদিবাসী নারীর অবস্থান আলাদা করে বিবেচনা করতে হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাই মধ্যবিত্ত নারীর সমস্যা আর আদিবাসী নারীর সমস্যা এক নয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর সমস্যার সমাধান হলেই যে আদিবাসী নারীর সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে সেটারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আদিবাসী নারীর অর্থনীতি আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা সুতরাং ওর রাজনীতি এবং ওর নারীবাদও যে ভিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। না, নারীর যে বিশ্বজনীন লড়াই, যেসব প্রশ্নে লড়াই, সেগুলির সাথে এমনিতে আদিবাসী নারীর অধিকার ও বঞ্চনার প্রশ্নটি খুব বেশি আলাদা বা বিপরীত নয়। কেননা নারীর প্রতি বৈষম্য সে তো একটা বিশ্বজনীন বা ইউনিভার্সাল প্রপঞ্চ। কিন্তু আদিবাসী নারীর ক্ষেত্রে শোষণ ও বঞ্চনার মাত্রা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাই মধ্যবিত্ত নারীর চেয়ে একটু বেশি- একজন সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত নারী যেসব শোষণ বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয় একজন আদিবাসী নারীকেও সেই একই শোষণ বৈষম্য ও বঞ্চনা সহ্য করতে হয়, সেইসাথে তাকে কেবল আদিবাসী বলেই এক মাত্রা বাড়তি শোষণ বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়।

মূলধারার নারীবাদের এই সীমাবদ্ধতা- আদিবাসী নারীর বিশেষ বাস্তবতাকে বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়া, এটা কেবল আমাদের দেশের নারীবাদীদের ক্ষেত্রেই যে ঘটছে সেটা কিন্তু নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এইরকম ঘটে। এইজন্যে দেখবেন যে আমেরিকাতে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ইন্ডিজেনাস ফেমিনিজম নামে ফেমিনিস্টদের মধ্যেই একটু স্বতন্ত্র একটা চিন্তাধারা তৈরি হচ্ছে। এইরকম স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বতন্ত্র নারীবাদী ধারা তৈরিটা হয়তো অবাস্তব বা অপ্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের যে মূলধারার নারীবাদ সেই ধারার নারীবাদীদের জন্যেও স্বতন্ত্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নারীর অধিকারের প্রশ্নটি নিজেদের চিন্তা ও আলোচনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া জরুরি। কেননা আপনি যদি সেটা না করতে পারেন তাইলে কোনো না কোনোভাবে হয়তো আপনি নির্যাতকের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে ফেলবেন। ঐ যে ধর্ষণের উদাহরণ যেটা দিয়েছি, কেবল আদিবাসী পরিচয়ের কারণে একজন পাহাড়ি আদিবাসী নারীর ধর্ষণের ক্ষেত্রে আপনি যদি সেটাকে কেবল আরেকটা ধর্ষণ হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেন, তাইলে সম্ভবত আপনি অন্তত একটা মাত্রা পর্যন্ত নির্যাতকের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছেন।

এখন তো আমাদের দেশের নারীবাদী চেতনার চর্চা মোটামুটি একটা বিকশিত পর্যায়ের কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়। আমাদের ঢাকার শীর্ষস্থানীয় নারীবাদী লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট যারা আছেন, ওরা তো অনেকদিন থেকেই নারীবাদ চর্চা করছেন। আর তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলামকে যদি আমরা বাংলাদেশের নারীবাদের বর্তমান ধারাটির সূচনা বিবেচনা করি তাইলে তো এই আন্দোলনটি তিন দশকের মত সময় পার করেছে বলতে হয়। সকলেরই পরিপূর্ণতা এসেছে, প্রজ্ঞা তো আছেই। আপনারা একটু চিন্তা করে দেখেন- বাংলাদেশের আদিবাসী নারীর অধিকার কি আমাদের মূলধারার নারীবাদী চিন্তায় রয়েছে?

 

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]