এমন নির্দয় ঘটনা আর যেন না ঘটে!
শেখ আবু তালহা।। বর্বরতার কথা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মধ্যযুগের কথা। যে যুগে মানুষ এতটাই বর্বর আর পাষন্ড ছিল, যা আজও পৃথিবীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সে যুগে মানুষের মাঝে সস্পৃতি, সৌহার্দ্য একেবারেই ছিলনা বললেই চলে। সামান্য বিষয়ে তারা গোত্রে, গোত্রে হানাহানি, মারামারিতে লিপ্ত হত। সামান্য অপরাধেও তারা মানুষকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি প্রদান করত। সে যুগে সব থেকে নির্মম শাস্তির বলি হতো নারী, শিশু। নারীদেরকে তারা কুলক্ষ্মী মনে করত। কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করাকে তারা পিতার জন্য, বংশের জন্য পাপ মনে করত। যার ফলে তারা নির্দয়ভাবে কন্যা শিশুকে হত্যা করত। জীবন্ত শিশুকে মাটি চাপা দিত। দাহিয়া কালভির ঘটনা- যে তার কন্যা জামিলাকে নিজ হাতে মাটি চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। যুগে যুগে এভাবেই নারীর প্রতি সহিংসতা আর নির্মম আচারণ করা হয়েছে। হিন্দু সমাজেও ছিল নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মমতা। সতীদাহ প্রথার কথা আমরা সকলেই জানি। যেখানে একজন জীবন্ত নারীকে মৃত স্বামীর চিতায় একসাথে পুড়িয়ে মারা হত। ইউরোপে নারীকে দাস বানিয়ে বাজারে, বাজারে বিক্রি করা হত। তাদের সাথে নির্মম আচারণ করা হত। সে সব যুগের ভয়াবহতা আজও হৃদয়-মনে দাগ কেটে যায়।
মধ্যযুগের সে বর্বরতাকে পায়ে মাড়িয়ে আজ আমরা আধুনিক সমাজে বসবাস করছি। আজ পৃথিবীবাসী মানুষ আমরা নিজেদেরকে শিক্ষাদীক্ষায়, কর্মে, মননে, সৃষ্টিশীলতায় উন্নত মনে করি। নিজেদেরকে অগ্রগামী মনে করি। কারণ মানুষের মাঝে আছে মনুষ্যত্ব। মানুষের মাঝে আছে বিবেক নামের সর্বোচ্চ আদালত। যার মাধ্যমে আমরা ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু আসলেই কি আমরা উন্নত বিবেকের অধিকারী হতে পেরেছি? আমাদের মাঝে কি রয়েছে প্রকৃত মনুষ্যত্ব? আমি বলব- নেই। বিবেক আজ হৃদয় থেকে বিলীন হয়ে গেছে। র বর্বরতায় ছেয়ে গেছে আমাদের অন্তর। আমাদের আধুনিক সমাজেও এমন কিছু ঘটনার জন্ম হচ্ছে, যা স্মরণ করিয়ে দেয় মধ্যযুগকে।
প্রতিনিয়ত ঘটছে নির্মম সব ঘটনা। নুসরাতের ঘটনা আজও হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। যেখানে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের লালসার শিকার হয় সে। যার ফলশ্রুতিতে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তাকে। নোয়াখালির সুবর্ণচরের ঘটনা, বগুড়ায় মা-মেয়ের ঘটনার মত অহরহ ঘটছে সব নির্দয় ঘটনা। নতুন করে আবার কক্সবাজারের চকরিয়ায় মা-মেয়ের ঘটনা পুনরায় মধ্যযুগের বর্বরতাকে জানান দিল। কতটা বর্বর আর নির্মম হলে ঘটতে পারে এসব ঘটনা। সভ্য এ যুগের দাবিদার হয়েও মধ্যযুগের বর্বরতা কেন আমাদের সমাজে? প্রকাশ্যে, জনগনের চোখের সামনে কীভাবে ঘটছে এসব নেক্কারজনক ঘটনা! নীরব দর্শক হয়ে আর কতদিন?
চকরিয়ার ঘটনায় গরু চুরির মিথ্যা অভিযোগে যেভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে মা আর মেয়েকে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে নতুন করে সামনে এনেছে। আসলে আমাদের মন-মস্তিষ্ক এখনও উৎকর্ষ লাভ করেনি, এখনও সভ্য হতে পারেনি। জাতি হিসেবে এখনও আমরা নির্মমতাকে লালন করছি। যার ফলে ঘটছে এসব ঘটনা। তাছাড়া নারীর প্রতি পুরুষের পেশি শক্তি প্রদর্শণ আজও রয়ে গেছে সবখানে, যেখান থেকে আজও আমরা বের হতে পারেনি। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা থেকে মুক্তির জন্য জোর আন্দোলন করতে হবে। ঘরে-বাইরে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে। সেক্ষেত্রে নারীরও ঘরে-বাইরে নিজেদেরকে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় আওয়াজ তুলতে হবে। নারী অধিকার আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নে সোচ্চার হতে হবে। তাহলেই নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে। আমাদের এ ঘুনে ধরা সমাজে নারীর অধিকার রক্ষার্থে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে। আজও আমরা দেখতে পাই, আমাদের পিতৃশাসিত পরিবারে নারী কতটা অবহেলিত, উপেক্ষিত। আজও তারা পুরুষের শাসন আর নির্মমতার স্বীকার। আজও তারা পুরুষের দাসী হয়ে আছে। এ হীনমন্যতার অবসান ঘটাতে হবে। তাহলেই পৃথিবী সুন্দর হবে।
অতএব শাস্তি চাই ইউপি চেয়াম্যানের। সর্বস্তরে আন্দোলন হোক। যে কুলাঙ্গারের নেতৃত্বে ঘটেছে এমন ঘটনা অতি দ্রুত তাকে শাস্তির আওতায় আনা হোক। পৃথিবীবাসী জানুক আমরা এখনও সভ্য। বিচার হোক অপরাধীদের। জয় হোক নারীর, প্রতিষ্ঠা হোক নারীর অধিকার। আবার যেন পৃথিবীবাসীর এমন নির্দয় ঘটনা দেখতে না হয়!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]