নারীর ইচ্ছার স্বাধীনতায় ধর্ম মামা-সংস্কৃতি মামাদের টানাটানি
মাসকাওয়াথ আহসান।। জগতকে বুঝতে কখনো কখনো এ থেকে দূরে থাকতে হয়। লেখক আলবেয়ার ক্যামুর এই উপদেশ মেনে মাঝে মাঝে জগত থেকে দূরে চলে যাই। সে যাওয়াটা ইমাম গাজ্জালির উপদেশ মেনে জনারণ্যে একা থাকার মতো।
কারণ কখনো কখনো জগতকে খুব দুর্বোধ্য ঠেকে। জগতের ঘটনাপ্রবাহ ‘‘মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং” বা অযথা হৈ চৈ; নাকি এ হৈ চৈ-এর কোন অর্থ আছে; এটা বুঝতে না পারাটাই দুর্বোধ্য লাগা।
ফেসবুকে নানারকম দুর্বোধ্যতা “ভাইরাল” হবার তোড়ে; করোনাভাইরাসের বিদায় ঘোষিত হলে; ফেসবুকে একটি মেয়ের ‘‘গায়ে হলুদে বাইক চেপে শোডাউন” আলোচনা বা ডিসকোর্সে এলে; জগত থেকে আমার চিন্তার দূরত্ব সূচিত হয়।
ধর্ম-মামারা এই গায়ে হলুদের নারীকে দোজখে পাঠানোর ফতোয়া দেয়; আর সংস্কৃতি মামারা একে নারী জাগরণের প্রতীক হিসেবে ফতোয়া দেয়। একটা নির্দোষ ছবিকে ঘিরে এই যে দুটি চিন্তার দ্বন্দ্ব; ঠিক এখান থেকে ইজম বা নানারকম বাদের সূত্রপাত।
একটা নির্দোষ ছবিকে ঘিরে এই যে বাদের টানাটানি; সেটা আবার মিডিয়ার সংবাদ। যে দুটো পক্ষ একটা গায়ে হলুদের ছবি নিয়ে ২৪ ঘন্টা বাদানুবাদ করছে; এরা আবার খুব রেগে রেগে কাজটা করছে; তাদের চিন্তার বিমূর্ততা সত্যিই বিস্মিত করে।
করোনাকালের জীবনের স্থবিরতা; দেশমানচিত্রে উত্তরণের বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা-নামার অংকে কোন হিসাব মিলাতে না পেরে হয়তো সবারই জীবনে উদ্দেশ্যহীনতা বেড়েছে। সবসময় জগতের ঘটনা প্রবাহের ডগায় বসে থাকায়; এ থেকে দূরে গিয়ে একে না দেখায়; চিন্তার দ্বন্দ্বটি সংগীত শিল্পী মাহফুজুরের গানের মতোই দুর্বোধ্য শোনাচ্ছে যেন।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে পুরুষের ‘‘নারীচিন্তা’’ আর নারীর ‘‘বিয়ে চিন্তা’’; এই দুটোর কারণে; করোনাকালে ভ্যাকসিন গবেষণার সামর্থ্য এতোদঞ্চলে গড়ে ওঠেনি। ঐ দুটি চিন্তার তোড়ে তাদের চিন্তার দ্বন্দ্বটি যাপিত জীবনে আজকাল এতোটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে; যে এটা কোন গ্রহের এলিয়েনের চিন্তার দ্বন্দ্ব; তা বুঝতে অসুবিধা হয়।
এরকম দুর্বোধ্য আর বিমূর্ত সমাজ দেখে স্যামুয়েল বেকেটের জটিল অবোধ্য নাটকগুলো আজকাল খুব সহজ লাগে। ফেসবুকে একটি গায়ে হলুদের ছবি নিয়ে চিন্তাপীর ও চিন্তাগণ যদি এতোক্ষণ সংলাপ আওড়াতে পারে; তাহলে ‘‘ওয়েটিং ফর গোডো’’ নাটকের দুটি চরিত্র এস্ত্রাগন ও ভ্লাদিমির কেন লম্বা সময় ধরে তাদের উদ্দেশ্যহীন বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে পারবে না!
শিল্পবিপ্লবের পর যে সময়টিতে ইউরোপে বিমূর্ত নাটকের চর্চা শুরু হয়; দুর্নীতি বিপ্লবের পর দক্ষিণ এশিয়া ঠিক ঐ জায়গাটিতে থাকায়; এখানে ফেসবুকগণেরা বিমূর্ত তর্ক চর্চা শুরু করেছে; এমনটাই মনে হয়।
ধর্ম মামা ও সংস্কৃতি মামা; উভয়েরই লাইফ স্টাইলে বা জীবন চর্চায় কিছুটা টাকা-পয়সা হাজির হয়েছে; ফলে দামি স্মার্ট ফোন উভয়ের হাতে রয়েছে। টাকা-পয়সা হয়ে গেলে মানুষের ক্রোধ বেড়ে যায়। মাথার মাঝ দিয়ে একটা তালগাছ জন্মায়। ফলে ফেসবুক স্ট্যাটাস না পড়েই পূর্ব সংস্কার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুটি পক্ষ।
ফেসবুক স্ট্যাটাসের কি-ওয়ার্ডস পড়ে ধারণা করে; লোকটা আমার চিন্তার পক্ষে-নাকি বিপক্ষে বলছে! সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করে পাঞ্চিং ব্যাগ ভেবে তারা নেমে পড়ে যে কোন ফেসবুক চিন্তার মন্তব্য ঘরে। ব্যাপারটা যেন এমন, অর্থ দিয়া কাম নাই; হুইনা যান।
বিয়ের পর শখ করে আবার বিয়ের গায়ে হলুদ আয়োজন; ব্যক্তির ইচ্ছার স্বাধীনতা। ইচ্ছার স্বাধীনতাকে মূল্য দেবে, এমন চিন্তার ক্ষমতা ধর্মমামার নেই। ধর্মমামা হচ্ছে পুরুষ-রাজা, সে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে শাসন করতে চায়। এ কারণে ধর্ম মামারা ধীরে ধীরে নারীর অপছন্দের হয়ে উঠেছে। আরেকজন মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে গুরুত্ব না দিলে; সে কোন দুঃখে আর বন্ধুত্ব করবে। স্বৈরপ্রভুত্ব নয় বন্ধুত্ব; এ হচ্ছে প্রতিটি মানুষের চাওয়া। এই ধর্ম মামারা যদি জগতের ঢেউ থেকে একটু দূরে গিয়ে খানিকটা ভাবে; আমি তো পুরুষ; কিন্তু আমার জন্ম হয়েছে নারীগর্ভ থেকে। যেখান থেকে আমি এসেছি তার প্রভু কী করে আমি হই! ধর্ম মামাদের এই নারীর ওপর প্রভুত্বের চিন্তা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনরোর মতো আত্মঘাতী; যে স্বৈরাচারি বলসোনরো আমাজন অরণ্য পুড়িয়ে ধরিত্রীর প্রভু হবার অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায়।
ধর্ম-মামাকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে; কেন নারী তাকে অপছন্দ করে! স্বৈরাচারকে যে কারণে প্রতিটি নাগরিক অপছন্দ করে; পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বা মেলশভিনিজমকে ঠিক সেই কারণে নারীরা অপছন্দ করে।
স্বৈরপুরুষতন্ত্রী ধর্ম-মামারাই কিন্তু তার কন্যা যখন আরেক পুরুষের নিগ্রহের শিকার হয়; তখন অসহায় বোধ করে। সে তার কন্যার নিপীড়ক পুরুষটিকে শায়েস্তা করতে চায়। আসলে অপরাধী নয়; অপরাধকে শায়েস্তা করতে হয়। এই প্রাচীন প্রবাদটি এজন্যই প্রচলিত। নিজেকে প্রভু ভাবার অপরাধটিকে শায়েস্তা করতে পারলেই; প্রভুগিরির অপরাধ শাস্তি পায়।
একটা মেয়ে কী পরবে; সাইকেলে চড়বে না বাইকে চড়বে; এগুলো তার ইচ্ছার স্বাধীনতা। এ নিয়ে চিন্তা না করে ধর্মমামারা যদি নিজেদের চিন্তার ক্ষমতা বাড়ানোর পিছে সময় ব্যয় করে; তাহলে জীবনটা এতো বৈচিত্র্যহীন রাগের সমাহার হয়ে দাঁড়ায় না। ক্রোধ এতোটা দখল নিয়ে নিতে পারে না আত্মার।
ধর্ম মামা মাদ্রাসা বা টোলের দিকে যখন শিশুকালে হেঁটে গিয়েছিলো; ঠিক তখন কুসুমকলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে হেঁটে গিয়েছিলো সংস্কৃতি মামা। সেই থেকে সংস্কৃতি মামা প্রগতির চাকার মালিক হয়ে পড়ে। আমসিপারা শিক্ষক ও গানের মাস্টারদের তাদের ছাত্রীদের হেনস্থার রেকর্ড দেখে; এদের মৌল চিন্তা বা সংস্কৃতির পার্থক্য খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।
সে কারণে সংস্কৃতি মামার চিন্তাও একটা সুনির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ। করোনার সময় দলবল নিয়ে শখের গায়ে হলুদ করতে নামা মেয়েটি এরকম করে গায়ে হলুদ করা দেখেছে ঢাকায়। ঢাকা যেহেতু সংস্কৃতির রাজধানী; সুতরাং মেয়েটি একে অনুকরণ করবে সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েটি একটি নির্দোষ মজা করেছে; ধর্ম মামারা তাকে গালাগাল দেয়ায় সংস্কৃতি মামারা নেমে এসেছে প্রতি গালাগালের সঙ্গে ‘‘নারী প্রগতি’’র সার্টিফিকেটখানি বগলদাবা করে। চিন্তায় অনগ্রসরের গালাগালের প্রতিউত্তরে গালাগাল দিয়ে কেউ কোন সমাজে অগ্রসরতা ও সুরুচি আনতে পারেনি কখনো। যে শিক্ষক ধমক ও গালি দেয়; তার কাছ থেকে দূরে থাকে ছাত্রেরা। অতিরিক্ত ক্রোধই আমাদের অনগ্রসরতা ও অপ্রগতির মূল কারণ।
সংস্কৃতির মামার কাজ হচ্ছে একটা পরমতসহিষ্ণু যৌক্তিক সমাজের স্বপ্ন বুনন করা। যে স্বপ্নের দৈর্ঘ্য মহাকাশচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভার স্বপ্নের সমান; একই বিবাহ শৃংখল দু’বার পরতে করোনাকালে গায়ে হলুদের শোডাউন করার স্বপ্ন তো কোনভাবেই নয়। সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স আর কমনসেন্স থাকলে করোনাকালে কেউ শখের গায়ে হলুদ করে না। নির্দোষ গায়ে হলুদের ছবিটি ভাইরাল হলে; তা মূলধারার মিডিয়ায় জায়গা করে নিলে; তখন একটি নির্দোষ ইচ্ছার স্বাধীনতার ওপর মন্তব্য করা অধিকার জন্মে। সে কারণেই একটি হালকা বুদ্ধির কাজকে প্রগতির প্রতীক বলে অতিশয়োক্তিতে আমার আপত্তি আছে।
নিও অ্যাফলুয়েন্স আর ফিলিস্টাইন্স শব্দদুটি শিল্পবিপ্লবোত্তর বিশ্ব-সাহিত্যে যে কারণে জায়গা করে নিয়েছিলো; একই কারণে দুর্নীতি বিপ্লবোত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন টাকা বা নব্যধনী শব্দবন্ধ আমাদের লেখালেখিতে জায়গা করে নেবে। প্রদর্শনবাদিতা স্থান-কাল-পাত্রের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হলে; এর মাথায় প্রশংসার মুকুট পরানোর কাজটি সংস্কৃতি চর্চা নয়। ধর্ম মামা তার মেল শভিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন কিছুকে গালি দিলেই; আমি সেই বিষয়টিকে বাহবা দেবো; এইভাবে কমনসেন্স বর্জিত কোন কাজে মহত্ব আরোপের জেদটি কাবাডির মাঠে মানিয়ে যায়; কিন্তু প্রগতিচিন্তায় নয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]