November 21, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

কোভিড আমাকে উদ্যোক্তা বানালো, এবার নিজের মত বাঁচতে চাই

দেশের অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তারা বড় ভূমিকা রাখছেন বর্তমানে। বিশেষ করে অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাদের সপ্রতিভ বিচরণ ও সফলতা আমাদের মনে আশা জাগায়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর নারী উদ্যোক্তাদের সংগ্রাম, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, ত্যাগ ও আনন্দ-বেদনার গল্পগুলো তুলে ধরতে চায়। এই গল্পগুলোই আরো হাজার নারীকে উজ্জীবিত করবে, পথ দেখাবে। আজ রইলো জান্নাতুল ফেরদৌস ফাতেমা‘র গল্প।।

আমি বরাবরই স্বাধীনভাবে চলতে পছন্দ করি। কেউ কোনো কাজে বাধা দিলে প্রচণ্ড মেজাজ গরম হতো। এখনো হয়। আর হুটহাট করে একেকটা কাজ করে বসি। কোনো রকম চিন্তাভাবনা না করেই। যদিও করার পরে ভাবি আসলে এটা করা ঠিক হয়নি। তবুও আফসোসটা কম হয়। কেননা নিজের দোষে ফকির হতেও কষ্ট নেই। আমি প্রচণ্ড জেদী,রাগী। এই আমিই এখন একজন শিক্ষক আবার বিজনেস উওম্যানও, আবার সন্তানের মা-ও।

একটা সময় ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো। কিন্তু রেজাল্ট তা হতে দিলো না। তারপর ভাবলাম, এইবার আর কোনো লক্ষ্যই থাকবে না। একজীবনে এইম ইন লাইফ রচনায় কম তো লিখিনি ডাক্তার হবো। কিন্তু জানেন, কখনো ভুলেও ভাবিনি আমি বিজনেস করবো। হিসাববিজ্ঞানকে এখনো ভয় পাই। বিজনেসের ব টাও বুঝি না।

কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো?

আমি ফেইসবুক চালানো শুরু করি ২০১২/২০১৩’র দিকে। প্রচণ্ড রকম নেশায় পড়ে যাই। নাওয়া, খাওয়া বাদ দিয়ে সারা দিন রাত অনলাইনে।
সবার প্রশ্ন কী করি এতো মোবাইলে? তারপর অর্নাসে ভর্তি হয়েও একই কাজ। স্টুডেন্ট অবস্থায় বিয়ে করা। তারপর থেকে টানাটানির সংসার। টিউশনি, কোচিং, স্কুলের ক্লাস নেয়া কোনোটাই বাদ যায়নি। কিন্তু মনে হতো নিজের স্বাধীনতা নেই এখানে। নিজের মন মত কিছু করবো। এক বান্ধবী নক করে বললো, চল বিজনেস করি অনলাইনে। তখন রাজি হইনি, টাকা কোথায় পাবো? বিজনেস মানেই তো অনেক টাকা লাগবে। এখানেই থেমে যাই। বিয়ের পরপরই কনসিভ করি। মা হই, বাচ্চা সামলে টিউশন, নিজের ক্লাস, সব ঠিক রাখাটা ছিল আমার জন্য বড় অনেক বড় একটা বাধা। আবার ভাবতে শুরু করলাম, এমন কী করা যায় যার মাধ্যমে আমি আমার আয়াতকে সময় দিতে পারবো, এমন কি ইনকামও করতে পারবো। এভাবেই কিছু করতে করতে অর্নাস শেষ করলাম।

২০১৮ সালের আগস্টে শেষ হয় অর্নাস। সবার এক প্রশ্ন অর্নাস তো শেষ, জব কর না? আবার অনেকেই বলা শুরু করলো মেয়েদের এতো দূর পড়াশোনা করানোই উচিত নয়। চাকরি বাকরি করে সব জামাইয়ের সংসারে নেবে। আমি তাদের কথা শুনি, আশেপাশের মানুষের হয়তো কোনো কাজ থাকে না, তাই অন্যের আলোচনা, সমালোচনা করতে ব্যস্ত। অথচ নিজের সন্তান কী করে তা ভাবে না। এসএসসি শেষ করে যখন ঢাকায় ভর্তি হই, হোস্টেলে থাকা শুরু করলাম। গ্রামে সবাই এমন ভাবা শুরু করলো যে হোস্টেলে মেয়েদের থাকা মানেই অনেক খারাপ। তারপর যখন আবার গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করলাম, তখনো আবার বলা শুরু মেয়েদের এতো পড়াতে নেই, বিয়ে দাও।

যখন বিয়ে করলাম তখন বলা শুরু হলো, ‘‘পড়াশোনা করে কী হবে? সেই তো চুলোর পাশে যেতেই হবে?’’ পড়াশোনা শেষে- ‘‘পড়াশোনা তো শেষ, জব করো না?”

তারা কখনোই চুপ নেই। অর্নাস শেষ হওয়ার পর পরই আয়াত প্রচণ্ড রকম অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওর জন্মগতভাবে মলদ্বারের নার্ভ প্যারালাইজড ছিলো। সেটার অপারেশন করাতে গিয়েই আবার ব্লাডের সমস্যা দেখা দেয়। প্লাটিলেট কমে যায়। আর জব করা হয়নি। টানা দুই বছর ছেলেকে নিয়ে হসপিটালে দৌঁড়াচ্ছি। ২০১৯টা পুরো ডিপ্রেশনে কেটেছে আমার, আমাদের। ২০২০ সালে এসে মনে হলো আবার শুরু করি। পুরো জানুয়ারি জুড়ে কয়েকটা স্কুলে ট্রাই করলাম। এক স্কুলে জানালো মাস্টার্স করে আসেন। আরেক স্কুলে জানালো আমাদের এখানে আপনাকে দেয়ার মত স্যালারি হবে না, আপনার ইংলিশে অর্নাস। আমি জানতে চাইলাম এখানে কে ইংলিশ পড়ায় নবম দশম শ্রেণির। সে একজন স্যারের নাম বললো। নাম শুনেই তাকে চিনলাম। সে আমারই স্কুল ফ্রেন্ড। যে কিনা ইংলিশে ৩৩ই তুলতে পারতো না। এমন কি এইচএসসি পরীক্ষা দেয় নি। বুঝতে বাকি রইলো না, মামা চাচার জোরটা খুব দরকার। আমার আবার মামা চাচা নাই। আমি আরেক স্কুলে গেলাম। সিভি দিলাম ।তারা ডাকলো। তারা জানালো, তারা কোনো স্যালারি দিবে না, তবে নুন্যতম একটা সম্মানী দিবেন। আর বাকিটা নিজের ব্যাচ পড়িয়ে নিতে হবে। আমি তাদের বললাম, তাহলে আমি কী পড়াবো ক্লাসে বাচ্চাদের যদি আগেই বলে দেন ব্যাচ পড়াতে।

তারা চুপ। ফেব্রুয়ারিতে জয়েন করি। কিছু ছাত্রছাত্রী পড়তে চায়। আমিও রাজি হই। ৩/৪ দিন পড়ানোর পর ছেলে অসুস্থ হয়ে যায়। আবার ঢাকায় চলে আসি। কয়েকদিন পর স্কুলে গিয়ে দেখি আমি যাদের পড়ানো শুরু করলাম তাদেরকে আরেক শিক্ষক পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। আমি আবারো চুপ হয়ে যাই। ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পুরোটা না দিতেই মার্চে লকডাউন শুরু। মার্চ-আগষ্ট কোনো বেতন দেয়নি, এমন কি কোনো খবর রাখেনি। উল্টো কল করলে জানিয়ে দেয়, যে কয় মাস বন্ধ ছিলো, তার কোনো বেতন দেয়া হবে না।নেই স্কুল, টিউশন, কোচিং। আবার ডিপ্রেশন শুরু। পাগলের মত হয়ে গেলাম। কয়েকদিন পর পর ছেলের প্লাটিলেট কমে যায়। এখনো আগের মতোই অনলাইনে থাকি। তবে মনে মনে ভাবলাম, যা শুরু করি এই বার অনলাইনেই কিছু করবো। তবে খুব ইচ্ছে ছিল ফ্রিল্যান্সার হওয়ার, কিন্তু সেটার জন্যও প্রশিক্ষণের দরকার। টাকার দরকার। সেটা ছিল না।

একদিন এক আপুর অনলাইনে ড্রেস সেলের পোস্ট দেখি। তার আইডি ঘুরে উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপের সন্ধান পাই। ওখানে নিয়মিত পোস্ট পড়া শুরু করি। নিজে পোস্ট করি।একটু একটু করে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। একরাতে এক বন্ধুকে জানাই আমার দশ হাজার টাকা লাগবে। সে দিতে রাজি হয়, বলে ১০ তারিখের পর পাঠাবে। কিন্তু আমি ওই রাতেই ভাবা শুরু করি দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করবো। তাঁতের শাড়ি, থ্রি পিস, ব্লক বাটিক ইত্যাদি নিয়ে। আমিও পাইকারি কেনা যায় এমন পেইজে নক দেয়া শুরু করলাম। প্রথমে ৫০০০ টাকার থ্রি পিস কিনে পোস্ট করি। একবান্ধবী দেখে ১৩টা ড্রেস অর্ডার করে এবং ১৩০০০ টাকা অ্যাডভান্স করে। সেই টাকা দিয়ে আমি আরো ড্রেস অর্ডার করি। এভাবে ত্রিশ হাজার টাকার অর্ডার করি। পুরো দুই মাসে আমার সেল প্রায়ই ৭০ হাজার টাকা।

সবার অনেক সাপোর্ট ছিলো। তবে এর পিছনে ছিল হাজারও সমালোচনার পাহাড়। কেন ইংরেজিতে অর্নাস করে শাড়ি সেল করি। শেষ পর্যন্ত শাড়ি বেচি? এগুলো ভাবতে ভাবতে অনেকেরই ঘুম হারাম। মাও এগুলি শুনে বিরক্ত। আমাকে বলে, ‘‘তোর আর এই কাজ করা লাগবে না।”

কিন্তু কেন করছি কাজটা? কেনো আমি উদ্যোক্তা?

এখন সারাদিনে আমি ছেলের কাছে। তাকে সময় দিতে পারি। ছেলেকে খাওয়াই আর অনলাইনে কাজ করি। ছেলেকে ঘুম পাড়াই আর অনলাইনে কাজ করি। ঢাকা যাই, হসপিটালে যাই, নিজের মত করে কাজ করি। যখন খুশি অর্ডার নেয়া যায়৷ কেউ এখানে বলে না- ‘‘কেন লেটে আসছো? তোমার বেতন কাটা।’’ কেউ বলে না- ‘‘৯-৫ টা ডিউটি করো।”

সম্পূর্ণ নিজের জগৎ। নিজের স্বাধীনতা। তবে সমালোচকরা আর কী করতে পারে সেটারও আমি শেষ দেখতে চাই। জীবনটা নিজের, নিজের মত করে বাঁচতে চাই। আর হ্যাঁ, আমি উদ্যোক্তা,আবার আমিই মা। এখন ছেলেকে সময় দিতে সমস্যা হয় না। এমন কি নিজের সব ডেলিভারি নিজেই দেই। এই কোভিড মহামারী না হলে আমি উদ্যোক্তা হতে পারতাম না। কোভিড আমাকে বানালো উদ্যোক্তা। জানি না, সফল হতে পেরেছি কিনা, তবে অনেক ব্যর্থতার গল্প পেরিয়ে এখন আমি Owner of Ayat’s Attire. আর আমাকে ২৪ ঘণ্টায় যে মানুষটা সাপোর্ট করেছে, আমার সমস্ত ড্রেস এনে দেয়া, ডেলিভারি দেয়া, সব কাজে যে আমার পাশে ছিল, ১০০% সাপোর্ট করে, পেইজ মেইনটেইন করে, পোস্ট করে- সে আর কেউ নয়, আয়াতের বাবা।

আমার আয়াতের মত করেই বেড়ে উঠুক আমার উদ্যোগ। আমার Ayat’s Attire. দেশি পণ্য পৌঁছাতে চাই সবার কাছে।