ফ্যালাস ফ্যালাসি: পুরুষাঙ্গের দম্ভ
মেহেরুন নূর রহমান।। কয়েকদিন ধরে এক কিশোরের প্যান্ট খুলে পুরুষাঙ্গ দেখানোর ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় হচ্ছে। শুরুতে বলা হয়েছিল সে প্রতিবেশীর মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দেয়ার জন্য এটা করেছে। পরবর্তীতে বলা হলো যে তা নয়, প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া চলছিলো, তার এক পর্যায়ে সে প্যান্ট খুলে তার পুরুষাঙ্গ তাদেরকে দেখিয়েছে। তা যে কারণেই হোক, কিশোরটি মূলত প্যান্ট খুলে তার পুরুষাঙ্গ প্রদর্শনের মাধ্যমে তার শক্তিমত্তা প্রকাশের চেষ্টা করেছিলো এটাই হলো আসল কথা। ছেলেটির মা এবং ভাবি ছেলেটির পেছনে ছিলো এবং ভাবা হচ্ছে যে তারা হয়তো ছেলেটিকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছিলো।
অনেকে অবাক হয়েছেন, আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন ছেলেটির এই ঔদ্ধত্যে, আমি কিন্তু হইনি। আমি ছেলেদের বা পুরুষের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। আমার শৈশবে আমাদের এক প্রতিবেশী যুবককে আমার বোনকে টিজ করার বিষয় নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে এই কর্মটি করতে দেখেছিলাম। বলা দরকার আমাদের পরিবারে আমরা ছয় বোন। একমাত্র ভাইটি তখন নিতান্তই ছোট এবং বাবা ও নিরীহ একজন মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুতরাং এমন একটি পরিবারকে পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে ভয় দেখানোর চেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি আর কী হতে পারে!
রাস্তাঘাটেও আমি দেখেছি পুরুষদের ঝগড়ার সময় লুঙ্গি উঠিয়ে পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে কিংবা দেখানোর ভঙ্গি করে অপরপক্ষকে ভয় দেখাতে। পুরুষরা নিজেদের ঝগড়ার মধ্যেও কিন্তু এটা করে, যেন দেখানো কে কার চেয়ে বেশি পুরুষ, কে কার চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
পুরুষদের পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে নিজের পৌরুষ প্রদর্শন করা বা নিজেকে অন্যের চেয়ে বেশি শক্তিশালী প্রকাশের এই ধারণাটির মূলে রয়েছে ফ্যালাস ফ্যালাসি (Phallus Fallacy)। জৈবিক বা বিবর্তনমূলক যুক্তি না থাকা সত্ত্বেও, আমাদের সমাজ প্রায়শই পুরুষাঙ্গকে শক্তি, ক্ষমতা এবং মাস্কুলনিটি বা পৌরুষের সাথে যুক্ত করে এবং এই যুক্ত করার ধারণাকেই বলা হয় ফেলাস ফ্যালাসি।
প্রথমেই আসুন জানি ফ্যালাস (Phallus) মানে কি। ফ্যালাস বলতে বুঝানো হয় এমন কোনো জিনিস যা উত্থিত পুংলিঙ্গ সদৃশ। আরো পরিস্কারভাবে বললে উত্থিত পুরুষাঙ্গের মতো দেখা যায় এমন কোন বস্তুকে ফ্যালাস হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, এবং সোজা ভাষায় এদেরকে ফ্যালিক সিম্বল বলা হয়। ফ্যালাস একটি ল্যাটিন শব্দ যা তারা মূলত ধার করেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ থেকে।
ফ্যালাস (Phallus) এর ব্যবহার আমরা দেখতে পাই মানব সভ্যতার শুরু থেকে। প্রাচীন শিল্পে উত্থিত পুরুষলিঙ্গ নিয়ে করা চিত্রকলাকে বলা হয় Ithyphallic (ইথিফ্যালিক)। প্রাচীন মিসরে ফ্যালাস অর্থাৎ পুরুষাঙ্গের সিম্বলকে ব্যবহার করা হতো উর্বরতার প্রতীক হিসেবে। সমৃদ্ধির দেবতা ‘মিন’কে ইথিফ্যালিক হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন চিত্র বা মূর্তিতে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে উত্থিত বিশাল পুরুষাঙ্গসহ। গ্রিক প্রতিপত্তি এবং উর্বরতার দেবতা ‘প্রিয়াপাস’কে ও চিত্রিত করা হয়েছে উত্থিত পুরুষাঙ্গসহ।
প্রাচীন রোমান সংস্কৃতিতে ফ্যালাস অর্থাৎ প্রতীকী পুরুষাঙ্গের ব্যবহার ছিলো সর্বব্যাপী। উদ্যানে উদ্যানে ছিলো উত্থিত পুরুষাঙ্গসহ প্রিয়াপাসের মূর্তি। এছাড়া বিভিন্ন ঘর সাজানোর জিনিস, তাবিজ, ম্যাজিক এর জন্য ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ইত্যাদির মধ্যে মধ্যে ফ্যালাস (প্রতীকী পুরুষাঙ্গ) এর ব্যবহার দেখা যায়। রোমান রাজ্যের সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত বস্তুগুলির মধ্যেও ফ্যালাস দেখতে পাওয়া যায়। এসব কারণেই কখনো কখনো প্রাচীন রোমের রাজনীতি এবং যৌনতাকে ফ্যালোসেন্ট্রিক বা পুরুষাঙ্গ-কেন্দ্রিক বলা হয়।
হিন্দুধর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ দেবতা শিব। শিব দুষ্ট, ধ্বংসের দেবতা, শক্তির দেবতা। তাকে বলা হয় দেবতাদের দেবতা- মহাদেব। এই মহাদেবের পূজা কিভাবে হয় আমরা সবাই জানি। শিবের পূজা বলতে মূলত শিবের লিঙ্গের পূজা করা হয়। শিব-লিঙ্গ হচ্ছে পৌরুষ, ক্ষমতা এবং শক্তিমত্তার প্রতীক। এখানেও আমরা ফ্যালাসের ব্যবহার দেখি।
ফ্যালাস বা ফ্যালিক সিম্বল (প্রতীকী পুরুষাঙ্গ) নিয়ে কোন সমস্যা নাই, কিন্তু সমস্যা তখনি যখন একে ভুলভাবে উপলব্ধি করা হয়- যাকে আমরা বলছি ফ্যালাস ফ্যালিসি (Phullus Fallacy)। ফ্যালাস ফ্যালিসির কারণে পুরুষাঙ্গকে শক্তির, ক্ষমতার প্রতিপত্তির সিম্বল হিসেবে প্রকাশ করা হয়। আমরা দেখতে পাই ফ্যালাস ফ্যালিসির প্রভাব বা পুরুষাঙ্গ নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই যে গর্ব এবং দম্ভ তা অতি প্রাচীন। পুরুষাঙ্গকে ক্ষমতার, উর্বরতার, শক্তির প্রতীক হিসেবে যুগে যুগে সিম্বলের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে পুরুষাঙ্গকে পৌরুষের প্রতীক হিসেবে ভাবা হয়েছে। পুরুষাঙ্গকে ভাবা হয়েছে শৌর্যবীর্যের প্রতীক।
এরই ধারাবাহিকতায় আজকেও আমরা দেখি পুরুষাঙ্গ নিয়ে পুরুষদের অহংকার। পুরুষাঙ্গ তাদের দুই পায়ের মাঝখানে নয়, ঢুকে গিয়েছে তাদের মগজে। পুরুষাঙ্গকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে এমন সব বস্তুর সাথে সংযুক্ত করে যেসব বস্তু শক্তি বা ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে, যেমন বন্দুক, তরোয়াল, কুড়াল, ছুরি ইত্যাদি। তাই পুরুষরা পুরুষাঙ্গকে ব্যবহার ক’রে নিজেদের মাস্কুলিনিটি প্রদর্শন করবে তা ধর্ষণ করেই হোক বা কাউকে দেখিয়ে হোক, এটাই স্বভাবিক। শুধু পুরুষদের কথাই বলব কেন, পুরুষতান্ত্রিকতা বহন করা প্রচুর নারীও রয়েছে এসব পুরুষাঙ্গসর্বস্ব পুরুষদের সঙ্গী হিসেবে।
তাদের কে বোঝাবে পৌরুষ, শক্তিমত্তা, শৌর্যবীর্য দুই পায়ের মাঝখানে ঝোলানো দণ্ডটির উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে মগজে, মননে, বুদ্ধিমত্তায়। নির্ভর করে আপনার আচার-আচরণ, শিক্ষা, ভদ্রতা, সততা, মায়া-দয়া, লিঙ্গ ভেদে যেকোনো মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদির উপর। আপনার লিঙ্গ নয়, আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে মানুষ হিসাবে আপনি কতটুকু শক্তিশালী এবং কতটুকু পৌরুষ আপনি ধারণ করেন। জানি না কবে এই বোধ আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বড় হওয়া নারী-পুরুষদের মাথায় আসবে। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক সবার মাঝে, ফ্যালাস ফ্যালিসির প্রভাব মুক্ত হোক সমাজ, লিঙ্গভিত্তিক সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্ত হোক আমাদের সমাজ, এই স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]