September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

সমতাযুদ্ধের যোদ্ধা কেবল নারী আর পুরুষই নয়…

কানিজ ফাতেমা।।  হিজড়া/বৃহন্নলা/ট্রান্সজেন্ডার যে যত্ত নামই দেই না কেন সবচেয়ে সহজ, সত্য এবং বড় পরিচয় তারা মানুষ। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ বৃহন্নলা পরিচয়টা তার মানুষ পরিচয়কে ছাপিয়ে যেতে পারে না, কখনোই না। সমতা সমতা বলে আমরা গলা ফাটাই, লড়াই করি সমতার জন্য। আর এই সমতা যুদ্ধের যোদ্ধা বলতে কেবল নারী পুরুষই মাথায় আসে আমাদের। কিন্তু সমতা তা তো সবার জন্য, সকল মানুষের জন্য। তা একরকম ইচ্ছে করেই ভুলে থাকি আমরা।

সেই যুগ যুগ ধরে ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবহেলা, টিটকারি আর টিপ্পনী খেয়ে এই ছোট জনগোষ্ঠীটি সমাজে বেঁচে আছে। এদের প্রতি  সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো সুদৃষ্টি নেই, নেই কোনো অর্থ বরাদ্দ। তবুও টিকে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে দিব্যি; তাহলে যোদ্ধা কারা?  দুমড়ে মুচড়ে গিয়েও বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে দিব্যি, তবুও ভেঙ্গে যাচ্ছে না। ট্রেনে, বাসে অথবা নবজাতকের বাড়িতে এদের দ্বারা হেনস্তা হবার কথা আমাদের সবারই হয়তো জানা। টাকা না পেলে তারা যে আচরণ করে তা অসভ্যতা বলেই গন্য করে আমাদের সমাজ, সমাজের মানুষজন। কিন্তু সভ্যতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা প্রাণিরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত যে অসভ্যতার সীমা লঙ্ঘন করে বেড়াচ্ছে, প্রয়োজনের চেয়ে শতগুণ সুবিধা তারা ভোগ করে যাচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকারটুকু, তবুও এই সমাজ তাকে সভ্য বলে, এই সমাজের মানুষ তাকে মানুষ বলে চিনবে। আর যারা শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য লড়ে যাচ্ছে তাদের আমরা অসভ্য বলছি? তারা যে মানুষ কখনো কখনো তাও আমরা ভুলে যাই। কিন্তু তারা কী করবে? তথাকথিত সভ্য মানুষের পেটের জ্বালার চেয়ে তাদের পেটের জ্বালা কি কোনো অংশে কম?

এই যে আমি বললাম পেটের জ্বালার কথা, এখন অনেক মুখোশধারীই বলবে ‘‘পেট চালানোর জন্য ভদ্রভাবে কাজ করলেই পারে, কোথাও চাকরি করুক,ছোটখাটো কাজ করুক তাহলেই তো হয়।” কিন্তু আমরা কোথায় দিচ্ছি তাদের এই সুযোগটা? কোথায় দিচ্ছি তাদের নায্য অধিকার? পড়ালেখা করার সুযোগটুকু পর্যন্ত আমরা ঠিকভাবে দিচ্ছি না তাদের। এই সমাজের মানুষের নানাধরণের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের কাছে তারা বাধ্য হয় ঝরে পরতে। বাধ্য হয় পরিবার থেকে বিছিন্ন হতে। এই সমাজ নানাভাবে তাকে বাধ্য  করে অসভ্য আচরণ করতে, আবার এই সমাজই তাকে বলে অসভ্য আচরণ না করে সভ্যতার সাথে কাজ করতে।

আরে বাহ! সমাজ তুমি তো দুর্দান্ত হিপোক্রেট! বলতে পারি সমাজের এই পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী আমাদের জন্য আয়না। কেননা কাল আপনার আমার সন্তান যে বৃহন্নলা হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং ভিকটিমের জায়গায় নিজেকে রেখে একটু ভেবে দেখবেন। জানেন তো এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সমাজকে, বাবা-মাকে, তথাকথিত আপনজনদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে যা হয়তো আমরা পাই নি। মানুষ চিনেছে তারা।

মাঝেমধ্যে ভাবি, মায়ের কোলে বসে সেই শিশুকালের গল্প শুনতে কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাথে বসে চায়ের আড্ডা দিতে তাদের কি ইচ্ছে করে না? স্বপ্নগুলোকে ছুঁতে ইচ্ছে করে না তাদের? ইচ্ছে করে না বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়তে? করে অবশ্যই, করে। কারণ মন তাদেরও আছে, তারা মানুষ।

শুধু কাগজে কলমে উদ্যোগ নয় প্রকৃত অর্থে যেদিন আমাদের হৃদয়ের গহিন থেকে এই পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর জন্য সম্মান জন্মাবে, লিঙ্গভেদে নয়, যেদিন মানুষ হিসেবে তাদের মূল্যায়ন হবে, যেদিন সন্তানের পিতা-মাতা লিঙ্গভেদে নয় মানুষ হিসেবে তার সন্তানকে মানুষ করবে, হাসিমুখে মেনে নিতে শিখবে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে, সেদিনই এই পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী এগোতে পারবে। উপলব্ধি করতে হবে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই ’- এর চেয়ে আর সুন্দর সত্য নেই। মানতে হবে সমতা সবার জন্য।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]