স্বামীর সম্পত্তিতে হিন্দু বিধবার অধিকার ও আশার আলো
তনুশ্রী দেবনাথ।। বৈদিক যুগে হিন্দু বিধবাদের সব ধরণের অধিকার ছিল। কালক্রমে হিন্দু বিধবাদের অবস্থা খুব সঙ্গীন হয়ে পড়ে। ইংরেজ আমলে হিন্দু বিধবাদের দুর্দশাগুলো সামনে এনে সতীদাহ প্রথা রোধ এবং বিধবা বিবাহ আইন পাস করা হয়। কিন্তু সামাজিকভাবে এই আইন প্রতিষ্ঠা পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ইংরেজরা চলে যাবার পর ভারতের আইনে যুগপোযোগী পরিবর্তন আসে এবং নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ইংরেজ আমলের আইন বর্তমান রয়েছে। আর হিন্দু বিধবা বিবাহের নজির তো হাতে গোনা।
বাংলাদেশের আইনে হিন্দু নারীরা সম্পত্তির কোনো অংশ পান না। হিন্দু নারী তার পিতার বা স্বামীর সম্পত্তির দাবিদার নন। এক্ষেত্রে হিন্দু বিধবাদের অবস্থান সুবিধের নয়। এতোদিন জীবনস্বত্ত্বের ভিত্তিতে বসতবাড়ি ভোগ দখলের অধিকার ছিল। জীবনস্বত্ত্বের অধিকার মানে হলো জীবিত থাকা অবস্থায় ভোগদখল করার অধিকার, কিন্তু হিন্দু বিধবা নারীটি সেই সম্পত্তি বিক্রি করতে বা কাউকে দান করতে পারবেন না। তবে বিশেষ কিছু কারণ দেখিয়ে, বিস্তর কাগজপত্র যোগার করে কিছু অংশ বিক্রি করার ব্যবস্থা আছে। বিশেষ কারণ হল তীর্থযাত্রা, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি।
হিন্দু বিধবা নারীটির যদি ছেলে সন্তান না থাকে তাহলে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার পায়তারা চলে। কখনো বা নামেমাত্র সম্পত্তি দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হিন্দু বিধবা নারীটির আশ্রয়স্থল হয় বাবার বাড়ি। যেই বাবার বাড়ির সম্পত্তির কোনো অংশও নারীর নয়। অনেকক্ষেত্রে তার জীবন যথেষ্ট দুর্বিষহ হতে বাকি থাকে না।
কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তানরা মায়ের চিকিৎসা বা ভরণপোষণের ভার নিতে চায় না। সেক্ষেত্রে হিন্দু বিধবা নারী যদি প্রাপ্য সম্পত্তির অধিকার পান তাহলে তার সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীরা স্বামীর বসত বাড়ির পাশাপাশি কৃষি জমির ভাগ পাবেন বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে।আইনজীবীরা বলছেন, ৮৩ বছরের পুরোনো হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইনে স্বামীর বসতভিটাতেই শুধু অধিকার দেয়া হয়েছিল। এখন হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষাপটে হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর সব সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
খুলনায় গৌরীদাসী নামের একজন বিধবা নারী স্বামীর কৃষিজমি অধিকার দাবি করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তার দেবর জ্যোতিন্দ্রনাথ মণ্ডল। বিধবারা স্বামীর কৃষিজমির ভাগ পাবেন না- এই দাবি নিয়ে বিধবার দেবর ১৯৯৬ সালে খুলনার আদালতে মামলা করেছিলেন। কিন্তু খুলনার জজ আদালতের রায়ে হিন্দু বিধবাদের স্বামীর কৃষিজমিতে অধিকার দেয়া হয়েছিল। তখন এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর কৃষিজমিতে ভাগ পাওয়ার পক্ষেই রায় এলো। ১৯৩৭ সালের হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইনে স্বামীর বসত ভিটাতেই শুধু বিধবা নারীদের অধিকার ছিল।
বিচারকের রায় আইনের অতি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়৷ তাই বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা আশার আলো দেখছেন। সামাজিকভাবে এই আইনটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে বঞ্চিত হিন্দু নারী কিছুটা হলেও সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা পাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]