November 24, 2024
নারীবাদ আলোচনাসাহিত্যফিচার ৩

গর্ভপাতের বৈধতা: নিজের শরীরে নিজের সিদ্ধান্তের অধিকার

নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব-১৩

শারমিন শামস্।। জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য মুখে খাওয়ার পিল আবিস্কার নারীর সামাজিক মুক্তি ও যৌনতার স্বাধীনতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল। এই অর্জনটির সময় নারীবাদী আন্দোলন প্রবেশ করে এর দ্বিতীয় তরঙ্গে। ১৯৬০ সালে আমেরিয়ায় সিন্থেটিক হরমোনসমৃদ্ধ পিল আবিস্কারের আগে যেসব জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় বের হয়েছিল তার চেয়ে এই পিল অনেক বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হল। আবিস্কারের দুই বছরের মধ্যে প্রায় ১.২ মিলিয়ন মার্কিন নারীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এই পিল। ব্রিটেনে এটি ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস দ্বারা প্রেসক্রাইবড হওয়ার নিয়ম চালু হল, যদিও ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র বিবাহিত মেয়েরাই পিল ব্যবহার করতে পারতো। তখনও বহু লোক মনে করতো পিল যৌন স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স দিচ্ছে। নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্টরা তখনো কাজ করে যাচ্ছিলেন লোকের মগজে প্রকৃত সত্যটি ঢুকিয়ে দেবার লক্ষ্যে আর সেটি হল পিল নারীকে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে সাহায্য করে, পরিবারের আকার সীমিত রাখে, নারীর কর্মক্ষেত্রে বিকশিত হবার পথ সহজ করে এবং একই সাথে নারীস্বাস্থ্য দেখভাল করে।

১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এই সময়কালটিতে গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলনও তুঙ্গে ওঠে। কারণ দেশে দেশে ধর্মীয় ও সামাজিক নৈতিকতাবোধের দোহাই দিয়ে আইন করে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এমনকি ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ করলেও নারী সেই সন্তান রাখতে বাধ্য ছিল। এদিকে গর্ভপাতকে বেআইনী ও অবৈধ করে রাখার কারণে গোপনে যেসব হাতুড়ে পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে আসছিল, তা নারীস্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছিল, এমনকি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছিল হরহামেশা। গর্ভপাত ইস্যুটিকে নৈতিকতার চেয়ে মানবাধিকার হিসেবে দেখছিলেন নারীবাদীরা। নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম মূল কথা ছিল নিজের শরীরের উপর নারীর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ফলে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ ঘটে গেলে তা সরিয়ে নেবার অধিকারটিও নারীরই, কারণ গর্ভটি তার, আর গর্ভপাতের অধিকার পাওয়াও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।

উনিশ ও বিশ শতকের শুরুতে গর্ভপাত ইস্যুতে নারীবাদীরা মতবিভক্ত ছিলেন। গত পর্বে যেমন বলেছি মার্গারেট স্যাংগারের কথা। তিনি গর্ভপাতবিরোধী ছিলেন, একই সাথে তিনি মনে করতেন সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেবার সুযোগ ও অধিকার থাকলে নারীর গর্ভপাতের প্রয়োজনই হয় না।

নারীবাদের একটি ধারা গর্ভপাতের বিরোধিতা করেই গড়ে উঠেছিল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এই অ্যান্টি অ্যাবরশন ফেমিনিজমকে ‘Pro-life feminism’ও বলা হত। কারণ গর্ভপাতবিরোধী নারীবাদীরা মনে করতেন গর্ভপাত আসলে নারীর জীবনের প্রতি হুমকি হিসেবে আসে এবং মৃত্যুর আশংকা বাড়ায়। তারা এক্ষেত্রে ‘right to life’ এর কথা উল্লেখ করতেন, যা গর্ভপাতের কারণে হুমকির মুখে পড়ে। অন্যদিকে বেটি ফ্রিড্যানের মত খ্যাতিমান নারীবাদীরা গর্ভপাতের অধিকারকে নারীর সার্বিক মুক্তির অন্যতম অংশ হিসেবে এর পক্ষে আন্দোলন করছিলেন। এই নারীবাদীরা ছিলেন Pro-choice feminists। তারা বলছিলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো সবসময় শতভাগ কার্যকর হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। অন্যদিকে নিজের শরীর ও প্রজনন বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবে নারী নিজে, সমাজ বা রাষ্ট্র নয়। তাই নারী যদি গর্ভপাত চায়, তবে সে অধিকার নারীর থাকতে হবে। গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকালে একটি স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সেটি হল- ‘My body, my choice’।

আমেরিকায় ফেডারেল পর্যায়ে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের আগে, যে নারীরা গোপনে গর্ভপাত ঘটাতে চাইতেন, তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল কয়েকটি দল, যারা নিরাপদ গর্ভপাতের ব্যবস্থা করছিল। শিকাগো শহরে ১৯৬৫ সালে গড়ে ওঠা Jane collective ছিল তেমনই একটি দল। দলের সদস্যরা নিরাপদে গর্ভপাতের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তারা কোন বিজ্ঞাপন দিতে পারতেন না যেহেতু গর্ভপাত ছিল বেআইনী, লোকের মুখে মুখে তাদের নাম ছড়িয়েছিল, নারীরা তাদের ফোন করে সাহায্য চাইলে তারা গর্ভপাত করে দিতেন। এজন্য চার্জ ছিল একশ ডলার। সব নারীর পক্ষে এটি দেয়া সম্ভব হত না। জেন কালেক্টিভ তখন তাদের শর্তহীন ঋণ দিতেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত, মানে যতদিন পর্যন্ত আমেরিকায় গর্ভপাত আইনসিদ্ধ না হয়েছে, জেন কালেক্টিভ প্রায় এগারো হাজার গর্ভপাত নিরাপদে করেছিল এবং কোনো মৃত্যুর ঘটনা ছাড়াই।

১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ডে দ্য অ্যাবরশন ল রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে গর্ভধারণে কোনো নারীর মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলে তাকে গর্ভপাতের অধিকার দেয়া হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে আলেক্সান্ডার কোলোন্তাইয়ের মত নারীবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯২০ সালেই সোভিয়েত ইউনিয়ন গর্ভপাতকে বৈধতা দিয়েছিল।

ইউরোপ ও আমেরিকায় গর্ভপাতের অধিকার দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এটাতেও শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। সেটি হল যে দুজন চিকিৎসককে একমত হতে হবে যে নারীটির গর্ভধারণ তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়েছে। (এই ২৮ সপ্তাহের শর্ত ১৯৯০ সালে ১৪ সপ্তাহে নামিয়ে আনা হয়।) সিমন দ্য বেভ্যয়ার ১৯৭১ সালে একটি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন যেখানে ৩৪৩ জন ফরাসি নারীর কথা উল্লেখ করা হয়, যারা অবৈধভাবে গর্ভপাত করার কথা স্বীকার করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আসে আরেক সিমনের নাম। তিনি সিমন ভেইল। ১৯৭৪ সালে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের প্রথম নারী মন্ত্রী, দায়িত্বে ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। সেই সময় ফরাসি নারীরা গর্ভপাতের দাবি তুলছিল। বেভ্যয়ারের প্রকাশিত ম্যানিফেস্টোর পর ৩৩১ জন চিকিৎসকের সাক্ষর সম্বলিত আরেকটি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ হয় সেই সময়, যে চিকিৎসকরা গর্ভপাতের ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারের প্রতি তাদের সমর্থণ জানিয়ে দেন। অবশেষে ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সে The Veil Law অনুসারে গর্ভপাতের অধিকার পান নারীরা, তবে শর্ত থাকে যে গর্ভধারণের প্রথম ট্রাইমেস্টারের মধ্যেই সেটি করতে পারা যাবে, যদিও বহু উগ্রপন্থী এর বিরোধিতা করে এবং সহিংস আক্রমনও চালায়।

ব্রিটেনে ১৮০২ সালে যখন গর্ভপাতকে অবৈধ করা হয়েছিল, তার পরপরই ১৮২১ সালে আমেরিকাতেও তাই করা হয়। আবার ১৯৬৭ তে ইংল্যান্ডে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হলে আমেরিকাতেও এর প্রভাব পড়ে। ১৯৬৪ সালে কানেকটিকাটে একজন নারী একটি হোটেল রুমে নিজের গর্ভপাত নিজে করতে যান, এতে তার করুণ মৃত্যু হয়। এই নারীর মৃতদেহের ছবিটি গর্ভপাত আন্দোলনের আগুন তীব্রতর করে। অবশেষে ১৯৬৭ সালে আমেরিকার কলোরাডো স্টেটে ধর্ষণ, ইনসেস্ট অথবা মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশংকার ক্ষেত্রে প্রথম গর্ভপাতের স্বীকৃতি দেয়া হয়। আমেরিকায় গর্ভপাতের দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে রেডস্টকিংস এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট শ্যুলামিথ ফায়ারস্টোন এবং এলিন উইলিস এটি গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগঠনের কাজের একটা কৌশল ছিল, যেটিকে বলা হত ‘Zaps’, যেমন রাস্তায় নেমে সরাসরি প্রতিবাদ জানানো এবং স্ট্রিট থিয়েটার। মূলত নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক হলেও এই সংগঠনের শাখা ছিল ফ্লোরিডাতেও। আর সানফ্রান্সিসকোতে রেডস্টকিংস ওয়েস্ট  স্বাধীনভাবে কাজ করতো। এই সংগঠন নিউইয়র্কে একটি ইভেন্ট করে যেখানে ১২ জন নারী তাদের অবৈধভাবে নেয়া গর্ভপাতের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন।

অবশেষে ১৯৭০ সালে হাওয়াইতেই প্রথম নারীদের পছন্দ ও সিদ্ধান্ত অনুসারে গর্ভপাত করতে দেবার বৈধতা দেওয়া হয়। এরপর ওয়াশিংটনে গণভোটের মাধ্যমে গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৩ সালের মধ্যে আমেরিকার ২০টি প্রদেশে গর্ভপাত বৈধ হয়।

আমেরিকা জুড়ে এখনও এই প্রো লাইফ ও প্রো চয়েস বিতর্ক রয়ে গেছে এবং সাধারণ জনগনের ভেতরে এখনও গর্ভপাত আইন বিরোধী মনোভাব রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্র অনুমোদিত স্বাস্থ্য বীমাগুলোতে গর্ভপাত অন্তর্ভূক্ত ছিল, ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বিলের মাধ্যমে তা বাতিল করেন।

এদিকে মাত্র সেদিন, ২০১৮ সালে, বহু বছরের নারীবাদী আন্দোলনের পর আয়ারল্যান্ডে বিপুল গণভোটের মাধ্যমে গর্ভপাতবিরোধী আইন বাতিল করা হয়েছে। আর অন্যদিকে পৃথিবীর ৬০টি দেশে এখনও গর্ভপাত বেআইনী রয়ে গেছে।

 

[চলবে]