September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ধর্ষণের দায় কি সমাজ এড়াতে পারে?

তৌকির ইসলাম।। আমার এই কথাটি দেখে অনেকের চোখ হয়তো এখন কপালে উঠেছে। তা উঠতেই পারে কিন্তু ধর্ষণের দায় আমার দৃষ্টিতে সমাজ কোনভাবেই এড়াতে পারে না। ধর্ষণ হচ্ছে মানুষের ভেতরকার জৈবিক চাহিদার এক দানবীয় বহিঃপ্রকাশ। আমি মানছি আইন ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি ধর্ষণের জন্য দায়ী কিন্তু ধর্ষণের জন্য যে সমাজের দায়ও কম নয়।

আমাদের সমাজে যখন একজন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয় খুবই অদ্ভুতভাবে সমাজ মেয়েটির নানাবিধ চারিত্রিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত জীবন বিশ্লেষণ করা শুরু করে। বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল ধর্ষণ কেন হল? কে করেছে? ধর্ষক আইনের আওতায় এসেছে কিনা? কিন্তু সমাজ তখন বিশ্লেষণ করছে মেয়েটি কী পরে ছিল? মেয়েটি কেন একা সেখানে গিয়েছিল? মেয়েটির চরিত্র কেমন? ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও একটা অদ্ভুত বিষয় হলো মানুষ ধর্ষিতাকে দেখতে বাসায় ভিড় করছে কিন্তু ভিড় করা দরকার ছিল ধর্ষকের বাড়িতে অন্তত তার বাবা-মা’র অনুধাবন যাতে হয়, তাদের সন্তান একজন অপরাধী। সমাজের এই অমূলক আচরণের কারণেই ধর্ষক নিজের পক্ষে কিছু সাফাই যুক্তি পেয়ে যায়।

ধর্ষিতার চরিত্রের দোষ দেওয়া সমাজের জন্য এক অনবদ্য কাজ। একটা ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার পরপরই সমাজের একটি অংশ জোর গলায় বলে বসবে মেয়ের চরিত্র ভালো না। চরিত্রের সংজ্ঞা আসলে কী? আর আপনাদের সংজ্ঞানুযায়ী মেয়ের চরিত্র ভালো না বলে ছেলে ধর্ষণ করে ফেলবে এমন আইন আপনি পেলেন কোথায়! একজন মেয়ে  যদি সেক্স ওয়ার্কারও হয় তবে তাকে ধর্ষণের অনুমতি ছেলে কোথায় পেল! মেয়েটি সেক্স ওয়ার্কার হোক কি না হোক, মেয়েটি যেমন পোশাকই পরুক, মেয়েটি যখনই বাইরে বের হোক- এসব বিবেচনায় ধর্ষণ তো বৈধতা পেতে পারে না, কিন্তু সমাজ এসব নিয়েই পড়ে থাকতে ভালবাসে। কারণ যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে সমাজের কামাতুর দৃষ্টি তার উপরে আগে থেকেই ছিল।

আমি আমাদের সমাজ ব্যবস্থার আরেকটা বিষয় দেখে অবাক হই, আর তা হলো ধর্ষণের পর নামকাওয়াস্তে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় ধর্ষিতাকে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দিয়ে ধর্ষিতার ক্ষতি আদৌ পূরণীয় নাকি টাকার অঙ্কে ধর্ষকের অপরাধ মার্জনীয়। আসলে কোনটিই নয়! এটি শুধুমাত্র একটি আইওয়াশ। ধর্ষণের দায় সমাজ আরও এড়াতে পারে না এই জন্য যে, সমাজ ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াতে পারে না, ধর্ষিতার পক্ষে প্রতিবাদ করতে পারে না। যখনই কেউ ধর্ষিতার পক্ষে কথা বলে সমাজ ধরে নেয় প্রতিবাদকারী নিজেও চরিত্রহীন।

অদ্ভুত একটা সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ধর্ষিণের শিকার মেয়েটি ধর্ষণে যতটা না যন্ত্রণা পেয়ে থাকে ধর্ষণ পরবর্তী ব্যাপারগুলো তার জন্য আরও ভয়াবহ কেননা সমাজ তার দিকে আঙ্গুল তুলেছে, তার ভুল খুঁজে বের করতে চাইছে, তাকে দোষী করতে চাইছে। ফলশ্রুতিতে ধর্ষিতার মানসিক শক্তি নেমে আসে শূন্যের কোঠায়, সে তার প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে চুপ হয়ে যায় আর তার এই চুপ হয়ে যাওয়াতেই সমাজ আরো ধরে নেয় সে দোষী। বরং সমাজের উচিত ছিল মেয়েটির প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠা।

আসলে ধর্ষণের জন্য কোন দিনই কোন মেয়ের দোষ থাকে না, থাকতে পারে না। তা সে যে কোন মেয়ে হোক; যে পেশার মেয়ে হোক। আমাদের সমাজে যৌন শিক্ষার যে অভাব, ধর্ষণের পেছনের কারণের এটি একটি। মেয়ে মানেই যে যোনী আর বক্ষসর্বস্ব জীব নয় তা আমাদের সমাজ বুঝতে আর বুঝাতে অক্ষম। তিন বছরের শিশুর বক্ষ গড়ে ওঠে না আর সত্তর বছরের বৃদ্ধার অর্গাজমও হয় না। কিন্তু আমাদের এই সাউথ এশিয়ান সমাজে তিন থেকে তেহাত্তর বছরের নারীর ধর্ষণের উদাহরণ রয়েছে। এর দায় কি সমাজ এড়িয়ে যেতে পারে!

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]