পায়ের তলায় মন খারাপেরা
সায়মা আরজু।।
প্রচন্ড গরম পড়েছে। গনগনে আগুন ঝরছে চারদিকে, ডলির মনের ভিতরটা যেন সেই আগুনের তাপে জলন্ত তন্দুরের মত ঝলসাচ্ছে। হাজার তিনেক টাকা আর একটা ক্রেডিট কার্ড ব্যাগে ঢুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নেয় ডলি। রিক্সা সাইন্সল্যাব সিগনালে আটকে থাকে অনেকক্ষন। এবার রাগের সাথে বিরক্তি যোগ হয়। ভাড়া দিয়ে রিক্সা থেকে নামতে যাবে, সাপুরেরা ঘিরে ধরে,”নাগ নাগিনীর বিয়া হইব, বড় লোকের বেটি দিয়া যা কিছু”। দশ টাকার একটা নোট বের করতেই একজন বলে ওঠে, “পঞ্চাশ টাকা দে লো বেটি”, ডলি কথা না বাড়িয়ে হাঁটা দেয়। সামনেই ছোট্ট একটা ছেলে কাঁঠালচাঁপা ফুল বিক্রি করছে। সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ায় ছেলেটি দৌড়ে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াল। ডলিকে দেখে এগিয়ে আসে, “সবটি পঞ্চাশ টাকা আপা, লইয়া যান, কয়ডা ভাত খামু।” কাঁঠালচাঁপা ডলির পছন্দ না, সে পছন্দ করে লতাচাঁপা তবুও সে ফুলগুলো কিনে নিয়ে সামনে আগায়। ধানমন্ডি চার নম্বরে এসে কী মনে করে দোয়েল সিল্কের শোরুমে ঢুকে পড়ে। এটা ওটা নাড়তে নাড়তে একটা অফহোয়াইট কালারের শাড়িতে চোখ আটকে যায়। বলাকা সিল্কের জমিনে শুধু কুচির নীচের দিকটাতে আর আঁচলে দুটো করে মোট চারটা সবুজ পদ্মপাতার এপ্লিক। সবুজের উপরে সোনালী সূতার কারুকাজ আরো মোহনীয় করেছে শাড়িটিকে। ডলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাখন রঙা শাড়ির জমিনে, জড়ির কারুকাজে। সেলসম্যান এগিয়ে আসে বলে “আপা, দুটো পিস এসছিল, একটা কাল বিক্রি হয়ে গেছে, খুবই আনকমন কাজ, আপা”। আনকমন বলেই তো মাথা খারাপ করে দিচ্ছে, মনে মনে বলে ডলি, প্রাইজ ট্যাগ খুঁজে চোখ বুলায়, ষোল হাজার। সেলসম্যানের দিকে তাকিয়ে বলে, “একটু বেশি না!” সেলসম্যান মাথা চুলকায়। ডলি শাড়ি রেখে বেড়িয়ে যায়। কিছু খাওয়া দরকার ভেবে প্রিমিয়াম মিষ্টির শোরুমে গিয়ে বসে। এক প্যাকেট বেবি বান আর একটা মালাই চপ দিতে বলে। কাল দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। সেদিন বিকেলে শান্ত’র সাথে ঝামেলাটা হবার পর থেকেই ডিপ্রেশনে ডলি। তিনদিন ধরে অফিসেও যায়নি।
শান্ত আর ডলি একই অফিসে কাজ করত। মোটামুটি ইম্প্রেসিভ দেখতে আর খুব চটপটে স্বভাবের ডলি তার অফিসে বেশ প্রিয় মুখ। শান্ত মুখচোরা কিন্তু কাজে বেশ সিরিয়াস। একই প্রজেক্টে কাজ করে বলে পাশাপাশি টেবিল। ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনা। কেমন কেমন করে হয়তো প্রেমও হয়ে যায়। ডলি স্বপ্ন বুনতে শুরু করে।
ডলির অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট যেমন ভাল তেমনি খুব অল্পতেই কাজের ধরন বুঝে ফেলে। এজন্য ম্যানেজমেন্টের সুনজরেও আছে সে। তবে ডলি চায় আর একটু পড়াশুনা করতে, ভাবে বিদেশ থেকে একটা ডিগ্রি করে আসতে পারলে বেশ হত। ইদানিং শান্ত অফিসে তার থেকে পিছিয়ে পড়ছে এটা আঁচ করতে পারে ডলি। এ নিয়ে অফিসে একটু আধটু কানাঘুষাও শোনা যাচ্ছে, ডালিয়া, রাবেয়া, সাদেক চান্স পেলেই এ নিয়ে টিপ্পনি কাটছে। ব্যাপারটা খুব একটা ভাল লাগেনা ডলির তাই অল্প সময়ের সিদ্ধান্তে চাকুরি পাল্টায় সে। যদিও শান্তকে এ বিষয়ে কিছু বলেনা। তবে ডলির নতুন অফিস আর পুরানো অফিস পাশাপাশি দুটো গলিতে, এজন্য শান্তর সাথে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। বেশ কিছু দিন ধরেই ডলি খেয়াল করছে শান্ত খুব খবরদারি করছে তার উপর। কয়েক মাস আগে ডলি একটা ল্যাঙ্গুয়েজ প্রফেসিয়েন্সি পরীক্ষা দিয়েছে বলে ছুটিতে ছিল। এটা নিয়ে একদিন লাঞ্চের সময় শান্ত শুনিয়ে দিয়ে গেছে, “দেশে পড়াশুনা যা আছে যত পার কর, বিদেশ যাওয়ার দরকার কী?” ডলি হেসে বলেছে “জীবনে বিদেশ দেখি নাই, সাধ আর কি!”
অফিসের পরে ও ডলি এটা নিয়ে ভেবেছে অনেক। কিন্তু সেদিন যা ঘটলো তা ছিল একেবারেই বিনা মেঘে বজ্রপাত। অফিস শেষে বাসায় ফিরবে এমন সময় নতুন অফিসের কলিগ নীনা বলল, “চল একসাথে ফুচকা খাই”, এমনটা নীনা আর ও প্রায়ই করে। মেইন রাস্তার পাশেই একটা ফাষ্ট ফুডের দোকান আছে, বরাবরের মত সেটাতেই ঢুকলো ওরা। এমন সময় শান্ত এল সেখানে। তাদের টেবিলেই বসে পড়ল। ভাবখানা এমন যে সে জানে ওদের এইখানেই থাকার কথা। নীনা শান্তকে খুব একটা পছন্দ করেনা, ডলিকে আগে বলেছেও কয়েকবার। এর মধ্যেই নীনার বাসা থেকে কি একটা ফোন এলে নীনা বের হয়ে গেল। ডলি কফির অর্ডার করে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শান্তই শুরু করে, “কাল রাতে মা আর আমার বোনেরা মিতুকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছে”।
ডলি জিজ্ঞেস করে, “মিতু কে”?
– আম্মা যাকে পছন্দ করেছে আমার জন্য
– তা বাসায় নিয়ে এসেছে মানে?
– মানে ছোট একটা অনুষ্ঠান করে। আমাদের ফ্যামিলির ষ্ট্যান্ডার্ড অনুসারে বেশ ছোট।
– ভালো , কনগ্রাচুলেশন
ডলির আর বুঝতে বাকি থাকেনা কী অনুষ্ঠান। তার মনে হল ভিতরটা কোথাও ফাঁকা হয়ে গেছে। দলা পাকানো কান্নারা বাইরে বের হয়ে আসতে চাইল, কিন্তু সামলে নিল, উঠে গিয়ে কফির বিলটা দিল। ফের শান্তর কাছে এসে বলল আমার তাড়া আছে, বাই। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। একটা সিএনজি ভাড়া করল বেইলি রোড যাবে বলে। বেইলি রোড পৌঁছে সিএনজিওয়ালা জিজ্ঞেস করল, “আপা কই নামবেন?” ডলির মনে হল সে বেইলি রোড কেন এসেছে, তার বাসা তো আজিমপুর! সে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে শাড়ির দোকানে নেমে গেল। খানিক্ষণ এদিক ওদিক হেঁটে একটা রিক্সা নিল। ডলি ভাবতে চাইল, শান্ত তার সাথে এমন কেন করল? নাকি পুরোটাই তার বোঝার ভুল। রাস্তায় বিলবোর্ডে জয়া আহসানের হাসি মুখ, কিসের বিজ্ঞাপন এটা? অক্ষরগুলো সব ঝাপসা লাগে, কিছু ভাবতে পারেনা ডলি।
একজন সেলস গার্ল প্লেটে করে মালাই চপ সামনের টেবিলে রাখে। ডলি বেবি বানের প্যাকেট খুলে মিষ্টির রসে ডুবাতে যাবে এমন সময় দরজা ঠেলে ছয় সাত বছরের একটা পুঁচকে মেয়ে আর শাড়ি পড়া বেশ পরিপাটি এক তরুনী দোকানে ঢোকে। পুঁচকেটা সোজা ডলির সামনের চেয়ারে এসে বসল। ডলি আগেও দেখেছে ওর সাথে বাচ্চাদের বেশ ভাব জমে যায় অল্পতেই। সেলস গার্লটি টুথপিকে একটা মিষ্টি গেথে ললিপপ বানিয়ে পুঁচকেটার হাতে ধরিয়ে দেয়। নিজের হাতের মিষ্টি হাতে রেখেই সে ডলির দিকে তাকিয়ে থাকে। ডলি ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘নাম কি তোমার”?
– রোদ
– স্কুলে পড়?
– হ্যাঁ। ক্লাস ওয়ান। তুমি কি খাচ্ছ?
– অমৃত, খাবে?
রোদ ঘাড় করে হ্যাঁ বলে। ডলি রোদের সাথে আসা তরুনীর দিকে সম্মতির জন্য তাকিয়ে দেখে সে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। ডলি রোদকে জিজ্ঞেস করে,
– কোথায় বাসা তোমাদের
– ধানমন্ডি সাত
এরই মধ্যে তরুনীটি পাশের টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে ডলির পাশে বসতে বসতে বলে
– আমি সোনিয়া, রোদের মা।
– ডলি
সেলস গার্লটি দুটো মালাই চপ টেবিলে পরিবেশন করে। সোনিয়া বেশ আলাপী, ডলির সাথে খেতে খেতে অনেক কথা হয়। মিষ্টির শো রুম থেকে বের হয়ে আসার সময় সোনিয়াকে কাঁঠালচাঁপার তোড়াটা উপহার দেয়। সোনিয়া প্রথমে নিতে চায়না বলে,
– আপনি শখ করে কিনেছেন
– এখনও শখ করেই আপনাকে উপহার দিচ্ছি। তবে লতাচাঁপা আমার খুব পছন্দ, কোথাও পেলে উপহার দিতে পারেন।
দু’জনেই হেসে ওঠে।
রোদ আর সোনিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডলি সোজা চলে যায় পানের দোকানে। মোঘল আমলের সিপাহীদের আদলে বানানো রঙিন ইউনিফর্ম পড়া কর্মচারী দরজা খুলে দেয়। ডলি একশ বিশ টাকা দিয়ে একটা মশলাদার পান কিনে মুখে পুরে দিয়ে বেরিয়ে আসে রাস্তায়।
ফোন বাজছে, অনেকক্ষন পর খেয়াল হয় ডলির। ব্যাগে হাত চালিয়ে ফোনটা বের করে এনে দেখে ডালিয়ার ফোন। ফোন ধরতেই ডালিয়া বলে-
– কোথায় তুমি
– বাইরে
– আচ্ছা, তোমার অফিসে ফোন দিয়েছিলাম, শুনলাম তুমি ছুটিতে, কোনও প্রবলেম না তো?
ডালিয়া তার ব্যাপারে হঠাৎ এত কনসার্নড হল কবে থেকে ভাবল ডলি, মুখে বলল,
– না তেমন কিছু না। তা খোঁজ করছিলে কেন?
– না মানে শান্ত, তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে, তুমি নাকি ওর ফোন ধরছ না। কি নাকি ফান করে বলেছে তাতেই তুমি এমন করছ…
আরোও কিছু বলতে যাচ্ছিল ডালিয়া। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ডলি বলল,
– ও আচ্ছা, তোমাকে বলা হয় নাই, একটা দাঁতে ব্যাথা ছিল, অনেকে হয়তো বলবে রুট ক্যানেল কর, কিন্তু আমি ভাবছি তুলেই ফেলব, কী বল? সেজন্যই ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। এখন রাস্তায়, পরে কথা হবে, বাই…
বলে ফোনটা কেটে দেয় ডলি। সত্যি হোক, বা ফান হোক এনিয়ে এখন আর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছেনা তার। এ রকম সাংঘাতিক ফান কেউ করেনা। তবে ডালিয়াকে কথাগুলো বলতে পেরে ভালো হয়েছে, খুব ফোপর দালালি করতে এসেছে, অন্যের ব্যাপারে এত নাক গলানো কেন বাপু!
ডলি এদিক ওদিক দেখে আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোনা মুছে ফেলে, ওভার ব্রিজে, রাস্তার ওপারে তাকায়, ল্যাবএইড হসপিটালের সাইনবোর্ডে চোখ পরতেই প্রমিতের কথা মনে পড়ে। অসম্ভব রকম সুন্দর দেখতে প্রমিত আর ডলি একই সাথে শংকর স্যারের কাছে অংক করতো সেই ক্লাস টেনে থাকতে। তখন প্রমিতের নিয়মিত যাওয়া আসা ছিল ডলিদের বাসায়। পরে প্রমিত মেডিকেলে চান্স পেয়ে ডাক্তার আর ডলি কমার্স নিয়ে পড়ে কর্পোরেটে। মেডিকেল থেকে পাশ করার পরে চার-পাঁচ বছর ইংল্যান্ডেও ছিল প্রমিত। ও তো ল্যাবএইডে কাজ করতো এক সময়, এখন করে কিনা কে জানে,অনেকদিন কথা হয়না, ভাবে ডলি। অমিত বলতো, “মন খারাপ হলে রাস্তায় হাঁটবি, লন্ডনে প্রথম প্রথম যেয়ে যখন আমার মন বসতো না তখন কত রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি! আর না হলে কোনো হসপিটাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওয়েটিং লবিতে গিয়ে বসে কে কী বলছে শুনবি, দেখবি তুই অনেকের থেকে ভালো আছিস, অনেকের থেকে ব্লেসড”। প্রমিতকে পেলে ভাল হত , মনে হতেই ডলি প্রমিতের নম্বর ডায়াল করে। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে মেকানিকাল ভয়েস অনুরোধ করে ভয়েস মেসেজ রেখে দেবার। ডলি “রাতে ফোন করিস, কথা বলব”, মেসেজ পাঠায়।
ডলির হঠাৎ করেই মন ভাল হতে শুরু করে, পাশের দোকানে বাজতে থাকা, “ও আমার উড়াল পঙ্খীরে, যা যা তুই উড়াল দিয়া যা’’, শুনে দুই-তিন মিনিট দাঁড়ায়, তার এখন গানটা গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে, মনে মনে গুনগুনও করে ওঠে। ডলি ভাবে, কী এক অকৃতজ্ঞ, অবিবেচক লোকের জন্য মন খারাপ করে রেখেছিল সে! মন খারাপ করে রাখা মানে নিজের কিছু সুন্দর সময় নষ্ট করা। না, আর মন খারাপ করে নিজের সময় নষ্ট করবে না সে। ডলি রাস্তা ক্রস করে মিরপুর রোড ধরে গাউসিয়ার দিকে হাঁটতে থাকে, একে একে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার, ডায়ানা ফ্যাশন, গোল্ডেন গেট শপিং সেন্টার, পেট্রোল পাম্প, দোজ্জা মার্কেট পার হয়ে মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। অচেনা মানুষের কাতারে হাঁটতে বেশ ভাল লাগছে তার, ডলি বেশ টের পাচ্ছে, পায়ের তলায় ক্রমাগত মিশে যাচ্ছে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা দুঃস্বপ্নের মত মন খারাপেরা।