রেইপ কালচার এবং আমরা
সাদিয়া মেহজাবিন।। প্রথমত এই লেখা তাদের জন্যে যারা নারীর ইজ্জত বা সম্মানকে মাংসপিণ্ডের বাইরে ভাবেন। সম্মানের চাহিদা, সংজ্ঞা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ একেক সমাজে একেক রকম। বর্তমানে একটি শব্দ আমাদের বারবার শুনতে হচ্ছে, ধর্ষণ। যারা আজকাল ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে জানেন তারা রেইপ কালচার বা ধর্ষণ সংস্কৃতি সম্পর্কেও জেনে থাকবেন।
দেশের সাম্প্রতিক তথ্য মতে (জানুয়ারি- আগস্ট ২০২০) নারী ধর্ষণের সংখ্যা ৮৮৯ জন, শুধু ধর্ষণ ৬৯২ জন, গণ ধর্ষণ ১৯২ জন, ধর্ষণের পরে হত্যা ৪১ জন, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা ৯ জন, ধর্ষণের চেষ্টা ১৯২ জন। খেয়াল করে দেখুন আত্মহত্যা ৯ জন, কিন্তু যারা বেঁচে থেকেও মৃত তাদের সংখ্যা কি কোথাও আছে?
রেইপ কালচার বলতে বোঝায় এমন এক ধরণের সংস্কৃতি যেখানে ধর্ষণ সংস্কৃতির অংশ ও স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে গণ্য হয় এবং ভিক্টিমকেই দোষ দেওয়া হয়। আরো বাড়িয়ে বললে যেখানে ধর্ষণ করার পর ধর্ষক নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় এবং দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। ধর্ষণের কোনো মামলায় কখনো শুনেছেন পুরুষ ধর্ষণ? কিংবা এই মহা জগতে পুরুষ নামক এই প্রাণির রাতের ঘুম হারাম হয়েছে নিজের ধর্ষণের ভয়ে? পুরুষের ইজ্জত শিশ্নে নয় অবশ্য! তাদের সম্মান তাদের বাহুর শক্তিতে মানে কে কত ক্ষমতাবান। পুরুষ দুর্বল হলে কিন্তু সে পুরুষ ঠিকই মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই ক্ষমতার লড়াই এবং অধিকারের প্রশ্ন আসে।
প্রাচীন কাল থেকে পুরুষ চেয়েছে নারীকে তাদের ব্যক্তিগত মালামাল হিসেবে ব্যবহার করতে এবং তার সম্পত্তি ভাবনা এত প্রবল যে ঢেকে রেখে বা একগামী করে নিয়ম আরোপ করে নারীর যৌনতাকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে। পুরুষ তাদের মেইল ইগোর কারণে নারীকে একাই ভোগ করতে চেয়েছে এবং নিজের ‘জিনিস’কে কেবল নিজের করে রাখতে চেয়েছে। অনেকে বলতে পারেন ক্যাপিটালিজমের কারণেই নারী তার যৌনতা নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু যারা এমন বলেন তাদের সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালে গিয়ে দেখেন ধর্ষণের প্রতিবাদের ব্যানার।
মূলত চাইলেই নারীর যৌনতাকে নাকচ করার আর সুযোগ নেই। নারীর যৌনতা আছে বলেই তার সম্মতির অধিকার আছে। যে সমাজ নারীর যৌনতাকে স্বীকৃতি দেয় না, সে সমাজ তার সম্মতিকে স্বীকৃতি দেবে তা ভাবা হাস্যকর। পুরুষ কেন সবসময় নারীর যৌনতাকেই আক্রমণ করে নারীকে দমন করছে?
ধর্ষকদের জবানবন্দিতে দেখা যায় বেশিরভাগই বলে, পরে আমি তাকে বিয়ে করব ভেবেছিলাম! মানে একবার নারীর ইজ্জত গেলে এই সমাজ তাকে মেনে নেয় না, এই সমাজ তাকে অপবিত্র ভাবে। তার মানে কি এই যে নারীর ইজ্জত কেবল তার যোনীতে?
অনেক নারী ভয়ে থাকেন রেইপের। এর কারণ কী? কারণ নারী নিজেই মনে করেন তার সম্মান ঐ ভ্যাজাইনাতে। পুরুষ তো ভাবে না তার একবার সংগম হলেই সব শেষ। একজন ভিক্টিমকে নিশ্চিত এই জ্ঞান আলাপ দেওয়া প্রয়োজন নেই কিন্তু অবশ্যই এই রেইপ কালচার পরিবর্তন করতে হবে যেন অন্যায়ের প্রতিবাদ হয়, শাস্তি পায় ধর্ষক এবং নারী তার জীবনে হেরে না যায়।
রেইপ কালচার যদি স্থায়ীত্ব পায়, তাহলে এই অন্যায় বন্ধ করা সম্ভব না। আপনার কী মনে, হয় ধর্ষণের পর একজন নারী কেন আত্মহত্যা করতে চান? কারণ তিনি মনে করেন তার সব শেষ, মুখ দেখানোর জায়গা নেই। যদি রাস্তায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয় তাহলে কি আপনি মুখ লুকান? সমাজ কি আপনাকে ফেলে দেয় নাকি আপনি আপনার অ্যাক্সিডেন্ট করা অঙ্গকে ফেলে দেন? নিশ্চিত নয়! যে অন্যায় ভাবে বেআইনী গাড়ি চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, নিজেকে সুস্থ করে তোলেন, আবার আগের জীবনে ফিরে যান। তাহলে ধর্ষণের মামলায় আত্মহত্যা কেন? কোনো কিছুর সমাধান মৃত্যু নয়!
আমাদের সাথে অন্যায় হলে প্রতিবাদ কারা করবে? আমরাই। একজন নারী যদি ধর্ষণ হয় সে অনুগ্রহ না চেয়ে নিজেই লড়াই করুক! নিজেই রাজপথে এসে বলুক, বিচার চাই! তাহলে ধর্ষক ভয় পাবে। কারণ প্রতিবাদহীন জনগণ রাজপথ থেকে চলে যাবে, আপনি না! কারণ আপনাকে এত কিছুর পরও থামানো যায়নি। তাহলে রেইপ কালচারের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদেরই। নাহলে এই ধর্ষক সমাজ দিন শেষে আমাদের বেঁচে থাকার স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন তুলবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]