November 2, 2024
কলামফিচার ২

এই ধর্ষকদের কি খুব অচেনা মনে হয়?

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।। গণধর্ষণের পর মেয়েটিকে বেধড়ক পেটানো হয়।

নাকে-মুখে-পিঠে এলোপাতাড়ি লাঠির আঘাত, লাথি-ঘুষি, গা থেকে কাপড় টেনে ফেলা চলতেই থাকে। সেই সাথে জোরপূর্বক তার বিবস্ত্র শরীরের ভিডিও করা হয়।

সুস্থ মানুষের পক্ষে সহ্য করার মতো দৃশ্য নয় সত্যি তাই বলে আমাদের জন্য “এ আমি কী দেখলাম” বলে জ্ঞান হারানোর মতো নতুন কিছুও তো নয়!

এ রকম বিক্ষুব্ধ কি আগেও হইনি কখনো? কিন্তু আপনি-আমি বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ হলেই ধর্ষক থেমে থাকছে না। প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে এ অপরাধ। প্রতিদিন অসুস্থ হচ্ছি আমরা।

চূড়ান্ত অসুস্থ হলেও এই দৃশ্য  আপনাকে, আমাকে দেখতে হয়েছে। আপনাদের কারো কান্না পেয়েছে, কেউ কেউ রাগে, ক্ষোভে থরথর করে কাঁপছিলেন, কেউ শেষ পর্যন্ত দেখতে পারেন নি।

আমি বলছি, আমার কান্না পায়নি, রাগে গা কাঁপেনি।

কেবল মনে হয়েছে, এরকম গা শিউরে ওঠা ধর্ষণের খবর প্রতিদিন ডাল-ভাতের মতো পেতে পেতে, এমন দৃশ্যের ভাইরাল ভিডিও দেখার পর আপনি বা আমি কেউ আর সুস্থ বলে দাবি করতে পারি কি না নিজেদের?

আমি, আপনি সবাই যদি সুস্থ মানুষ হই তাহলে এমন ধর্ষক প্রজন্ম কীভাবে জন্মায় এই দেশে? যদি ধরেও নেই  আপনি এবং আমি সুস্থ ও স্বাভাবিক তাহলে ওরা কারা?

আপনার-আমার সুস্থতাকে, দেশের আইন-শৃংখলাকে কাঁচকলা (পড়ুন শিশ্ন) দেখিয়ে প্রতিদিন ধর্ষণের মহোৎসব করে বীরদর্পে খবরের শিরোনাম হতে যাদের বিন্দুমাত্র আত্মা কাঁপে না? ওরা আমাদের কেউ নয় ভেবে নিয়ে আমি-আপনি নিজেদের সুস্থ স্বাভাবিক নাগরিক ঠাহর করে আত্মতুষ্টির জীবন পার করে আর কত? আমি-আপনি যে সমাজে বাস করি ওরা কি তার বাইরের কেউ? দাগী ধর্ষক শুধু নয় আস্ত ধর্ষকামী এক সমাজের নাগপাশ ঘিরে রেখেছে আমাকে-আপনাকে। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে কুকীর্তি করেই ক্ষান্ত না, এই ধর্ষক বীরপুঙ্গবেরা আবার ধর্ষণের শিকার নারীকে এলাকাছাড়াও করছে। কত বড় বুকের পাটা ভাবা যায়?

এই বীরপুঙ্গবদের কি খুব অচেনা মনে হয় আপনার? আমার তো তা মনে হয় না! রাস্তাঘাটে, ঘরে-বাইরের কথা বাদ দিন, অহরহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়স, অবস্থান, পেশা নির্বিশেষে যে কোনো নারীকে যে ধরনের জঘন্য মন্তব্যের শিকার হতে হয় তাদের মধ্যেই কি নিহিত থাকে না ধর্ষকামী / ধর্ষকের বীজ? নারীর শরীর, পোশাক, চলাফেরা, পেশা, লেখা, পরিচয়কে দলে দলে ভার্চুয়াল ধর্ষণ করে বেড়ায় এরা। ওয়াজের নামে নারীকে নিয়ে চলে অশ্রাব্য কথাবার্তা। সেখানে দেখবেন একদল পিশাচের কদর্য হাসির সমর্থন। এরাই যে Potential Rapist তাতে কি কোনো সন্দেহের অবকাশ আছে?

এই সকল Potential Rapist, সাইবার ধর্ষকের বিরূদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এ যাবৎ?

আইনের বিচারের প্রশ্ন তো আছেই, গুটিকতক সচেতন মানুষের মানববন্ধনে দাঁড়ানো আর প্রতিবাদ সমাবেশ দিয়ে তো ধর্ষকের বিবেক জাগ্রত করা যাচ্ছে না! আইনের প্রয়োগ তরান্বিত করা যতোটা জরুরি ততোটাইজানা জরুরি যে, কেমন পরিবার ব্যবস্থায় ধর্ষকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা? কতিপয় বিকৃতমনস্ক কীভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে হাজারে হাজারে বিষাক্ত বীজ, ধর্ষণের মহামারি? এখন থেকে ধর্ষকের পরিবারের বক্তব্য জানতে চাই। শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি  সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ – সুবিধা থেকে বঞ্চিত হোক ধর্ষক ও তার আশ্রয়দাতা পরিবার।

দলীয় লেবাসধারী হলে Pillow Passing খেলা বন্ধ করে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া হোক। একঘরে, ভিটেছাড়া, এলাকাছাড়া,হেনস্থা করতে হলে ধর্ষক ও তার পরিবারকে করুন, ধর্ষণের শিকার নারী বা তার পরিবারকে নয়। পরিবার, সমাজ, দল, রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব প্রতিহত করা অন্যথায় নয়। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ধর্ষণের এই লোমহর্ষক চিত্র গ্রাম- শহর, পাহাড়-সমতল ছাড়িয়ে সমগ্র বাংলাদেশের।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে, চলায় চলায় বাজছে যখন নারীর ক্ষমতায়নের জয়ের ভেরী, এখনো প্রতি মুহূর্তে কী ভীষণ নিরাপত্তাহীন, অরক্ষিত, বিপদসংকুল এ  নারী জীবন! তবুও সুস্থ থাকার কী মরণপণ চেষ্টা আপনার-আমার!

স্তব্ধতা নয় বরং আমাদের প্রতিবাদ জারি থাকুক। এই মুহূর্তে যাত্রা অব্যাহত রাখাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]