ধর্ষণ রুখতে গিয়ে মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেবেন না
মেহেরুন নূর রহমান।। আপনারা সবাই জানেন বাংলাদেশ এখন ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের মহোৎসব চলছে। ধর্ষণের পর অনেক সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে খুন করা হচ্ছে। আবার অনেক সময় সেগুলো ভিডিও করে বাইরে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বীভৎস সেই সব ভিডিও দেখে আমরা আহা উহু করছি, মানসিকভাবে বিচলিত হচ্ছি। ফেসবুকে দুই চারটা করে পোস্ট দিয়ে দিচ্ছি। কোথাও কোথাও ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষেরা সত্যি সত্যি প্রতিবাদ মিছিল করছেন, সেখানে আবার সরকার পক্ষ থেকে মিছিলকারীদের হটানোর জন্য অত্যাচার করা হচ্ছে। অনেক কিছুই হচ্ছে চারপাশে।
এর সাথে আরও একটি জিনিস হচ্ছে, এবং আমি মনে করি অনেকেই সেটা খেয়াল করে থাকবেন এবং কেউ কেউ হয়তো মনে মনে সাপোর্টও করে থাকবেন, সেটা হলো বিভিন্ন রকম ওয়াজ এবং ফতোয়া হচ্ছে যেখানে বলা হচ্ছে ধর্ষণের জন্য মেয়েদের পোশাক দায়ী। বলা হচ্ছে মেয়েরা পর্দা করে না বলেই ধর্ষণের হার বাড়ছে। এসব কথা এই সব মোল্লারা হর-হামেশাই বলে থাকে, কিন্তু এই সময় যখন ধর্ষণের ভয়াবহ সব ঘটনায় আমরা সবাই কম বেশি বিপর্যস্ত এবং ভীত, তখন এসব ওয়াজ ধর্মভিরু সমাজের সাধারণ মানুষদের চিন্তাধারা এবং মনস্তত্বকে একটি নিদৃষ্ট রূপ বা শেপ দিতে ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ধর্মের কারণে হোক বা ফ্যাশনের কারণে হোক অনেক নারী পর্দার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। রিসেন্টলি যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে বড় অংশ ভিকিটিম হিজাবী ছিলো। সিলেট এমসি কলেজে স্বামীর সাথে যাওয়া মেয়েটি হোক কিংবা ঘরে এসে দলবেঁধে অত্যাচার করে ভিডিও প্রকাশ মেয়েটি হোক কিংবা নুসরাত হোক, সবাই কিন্তু হিজাবী ছিলো। এছাড়া ২ মাসের শিশু ধর্ষিত হচ্ছে, ৭০ বছরের বৃদ্ধা ও ধর্ষিত হচ্ছে। মাদ্রাসায় ধর্ষণ করা হচ্ছে ছেলে এবং মেয়ে শিশু দু’জনকেই। এখন আপনারা আমাকে বলেন এখানে কোন কোন ঘটনায় আপনার মনে হয় পর্দা করেনি বলে এসব ঘটনা ঘটছে আর পর্দা করলে তারা রেহাই পেত?
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষণ হয়েছিলেন তখন কোন ধরণের পর্দা তাদের রক্ষা করতে পারতো বলে আপনি মনে করেন? স্বামী, ভাই, বাবা, মামা, চাচা বা চেনা লোকদের দ্বারা যখন মেয়েরা রেপড হয় তখন কোন পর্দা তাদের বাঁচাবে? ধর্ষণ কোন সাধারণ যৌন সম্পর্ক নয়। এর সাথে বিকৃত মানসিকতা, ক্ষমতা/শক্তি/ শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন এবং নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কযুক্ত। ধর্ষণের সাথে পর্দার কোনো সম্পর্ক নেই সেটা প্রমাণিত, তারপরও মেয়েদের ছায়া দেখলেই লালা ঝরা এই সব মোল্লারা ক্রমাগত একই কথা বলে যায়। তাদের কাছে যে কোন সমস্যার মূল কারণ নারীর পর্দাহীনতা। মনে আছে কোন এক হুজুর যেন বলেছিল ভূমিকম্পের কারণ হলো মেয়েদের জিন্স পরা।
এই যে সব কিছুর সাথে নারীর পর্দা বা হিজাব করা / না করাকে জড়ানো হয় তার কারণ কখনো ভেবে দেখেছেন? কারণ একটাই – নারী বিদ্বেষ এবং যে কোন উপায়ে নারীকে দমন করা, নারীকে হাতের মুঠোয় রাখা, কন্ট্রোল করা। তারা এসব বলে বলে অশিক্ষিত ধর্মভীরু মানুষদের চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত করতে চায়। আজকে বলছে পর্দা করতে, কালকে বলবে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে রাখো। এরপর বলবে হাতের নখ, পায়ের আঙ্গুল কেন দেখা যায়? এগুলো দেখলেও তো পুরুষ কামার্ত হতে পারে সুতরাং তোমাদের হাত মোজা পা মোজাসহ নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে হবে। এরপর এরা বলবে হিজাব পরেও মেয়েরা যেহেতু বাইরে যাচ্ছে, সে জন্য ধর্ষিত হচ্ছে। এখন মেয়েরা কী কারণে বাইরে যায়? পড়াশোনা অথবা চাকরি করতে! সুতরাং বন্ধ করো মেয়েদের পড়াশোনা এবং চাকরি। মেয়েরা তোমরা ঘরে থাকো, ঘর থেকে বের হবে না। বেঁচে থাকো পুরুষদের দয়া-দাক্ষিণ্যে। পুরুষ যদি শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে তোমাদের চুপ করে থাকতে হবে। স্বামীরা যদি গৃহকর্মীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তোমরা চুপ করে থাকবে। যদি আরেকটি বিবাহ করতে চায় ভালো স্ত্রীর মত সম্মতি দেবে কারণ তোমাদের তো যাবার কোন জায়গা নাই। তোমাদের শিক্ষা নাই, অর্থনৈতিক শক্তি নাই, আত্মবিশ্বাস নাই, তোমরা তো নিজেকে মানুষ ভাবার মতো অবস্থায়ই নাই। জানি উপরের কথাগুলো আপনাদের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে কিন্তু বিশ্বাস করেন আজ যদি আপনারা সবকিছু চুপচাপ মেনে নেন, তখন একদিন এই দিন দেখতে হবে।
এক ধর্মীয় নেতা ফতোয়া জারি করেছে যে ধর্ষণ রোধের জন্য মেয়েদেরকে পর্দা করতে বাধ্য করানো উচিত। বাধ্য কথাটির উপর জোর দিচ্ছি। এর মানে হল আপনি যদি পর্দা না করেন তাহলে আপনার জেল জরিমানা হতে পারে অথবা আপনাকে দোররা মারা হতে পারে। আবার একই সাথে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হচ্ছে। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষদের নিয়ে ধর্মের নামে যে নোংরা রাজনীতির খেলা চলছে সেটা কি সত্যি বুঝতে পারেন না? আপনারা নিজের হাতেই যে ফ্রাঙ্কেস্টাইন তৈরি করছেন এটা বোঝাও কি খুব কঠিন? অ্যানাকোন্ডার সেই গল্পটি জানেন তো? এক মেয়ে ভালোবেসে অ্যানাকোন্ডা পালে। মাছ মাংস দুধ ডিম খেতে দেয়। সাপ ধীরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। একপর্যায়ে মেয়েটি দেখে সাপ প্রতিদিন তার পাশে এসে শোয়। মেয়েতো খুশি, ভাবে সাপ তাকে ভালোবেসে পোষ মেনে গেছে। একজন বুদ্ধিমান মানুষ ব্যাপারটি দেখে মেয়েটিকে বললো, সাপ তোমাকে মোটেই ভালোবাসেনি, জাস্ট মেপে দেখছে আর কতটুকু বড় হলে সে তোমাকে সম্পূর্ণ গিলে খেতে পারবে। আপনারাও ধর্মান্ধ হয়ে অ্যানাকোন্ডা পালছেন যে একদিন আপনাদের সবাইকে গিলে খাবে। এই অ্যানাকোন্ডা সমাজের সাধারণ মানুষদের মনতত্ত্বকে চেঞ্জ করে দিচ্ছে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
আজ থেকে বিশ তিরিশ বছর আগেও যখন আমি বড় হচ্ছি তখন পাড়ার ছেলেরা ইভটিজিং করলে মা বাবাকে বলতে শুনিনি যে আমাকে পর্দার নিচে নিজেকে আড়াল করতে হবে। বরং বাবা মামারা গিয়ে ইভটিজারকে শাসিয়ে দিয়ে এসেছে। তবে আজ কেন যে কোনো ঘটনা সেটা ইভটিজিং বা ধর্ষণ যাই হোক না কেন মেয়েদের এবং মেয়েদের পর্দাহীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে? বাংলাদেশের কোন মেয়ে অশালীন পোশাক পরে? রাস্তাঘাটে আমি তো কোন মেয়েকে রিভিলিং বা সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে দেখিনি। তারপরও কেন পর্দা পর্দা করে সবার মাথা খারাপ করে দেয়া হচ্ছে? কেন ছোট ছোট মেয়েদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে তারা যৌনবস্তু ছাড়া আর কিছু নয়? তাদের চুল, তাদের তাদের নখ থেকে শুরু করে সবকিছু পুরুষদেরকে কামনায় জর্জরিত করতে পারে সুতরাং তাদের নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে হবে?
পর্দা ধর্ষণ প্রতিরোধ করে- এটি একটি মিথ মাত্র। পর্দা করে বা হিজাবের ভেতর থেকে আর যাই হোক ধর্ষণ কমানো যাবেনা। ধর্ষণের ভয়ে মেয়েরা যতই কাপড়ের ভেতর ঢুকতে থাকুক না কেন কোনো লাভ নাই। অনেকে বলে থাকেন পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী স্বাধীনতা আছে তাহলে ওখানে কেন এত ধর্ষণ হয়। শুনুন আগেই বলেছি, ধর্ষণ কিন্তু কোনো সুস্থ স্বাভাবিক যৌন কর্ম নয়। ধর্ষণ পুরুষদের নারীর ওপর নিজের ক্ষমতা, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হাতিয়ারও বটে। এসব দেশেও নারী-পুরুষদের সম্পূর্ণ সমতা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এখানেও পুরুষরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে ধর্ষণকে ব্যবহার করে থাকে। এসব দেশে ধর্ষণের ঘটনা রেজিস্টার্ডও হয় অনেক বেশি যেখানে বাংলাদেশে ৮০% থেকে ৯০% ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্টেড হয় না। পশ্চিমা দেশগুলোর ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখে অনেকে ঢোল বাজাতে শুরু করে। শুনেন এইসব দেশে মেয়েরা রাত-বিরাতে যখন তখন বের হয়। সামারে এবং সি-বিচে তারা যে ধরনের পোশাক পরে ঘোরাফেরা করে, আমাদের দেশের হুজুরদের মতামত অনুযায়ী দিনে অন্তত কয়েক লক্ষ ধর্ষণ হওয়ার কথা।
মনে রাখবেন আপনারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলেই মোল্লারা পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী জাতীয় ওয়াজ করতে সাহস পায়। সাহস পায় নির্দ্বিধায় নারীবিদ্বেষ ছড়াতে সব জায়গায়। আপনাদের প্রশ্রয়েই এরা সাহস পায় বাল্যবিবাহের পক্ষে কথা বলতে, সাহস পায় মেয়েদেরকে খোলা মিষ্টি বা তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করতে। সাহস পায় বলতে মেয়েদের দুই তিন ক্লাসের বেশি পড়াশোনা করানোর দরকার নেই। এরা শুধু বলেই ক্ষান্ত নয়, অশিক্ষিত ধর্মান্ধ এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ব্রেইন ওয়াশ করে তাদের মাথার ভেতর এসব চিন্তা ভাবনা ঢুকিয়ে দিচ্ছে এবং সম্ভাব্য ধর্ষক তৈরি করছে। এদের দ্বারা অনুপ্রাণিত পুরুষরা তাদের পরিবারের নারীদের কতটুকু শ্রদ্ধা করবে তা সহজে অনুমেয়। এইসব পরিবারের স্ত্রীরা পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত হয়। মেয়েরা পড়াশুনার সুযোগ পায় না, বাল্যবিবাহ হয় এবং ক্রমাগত বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়।
আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার মেয়ের জীবনটা এমন হোক! ধার্মিক হন ভালো কথা কিন্তু ধর্মান্ধ হবেন না। দয়া করে মৌলবাদের উত্থানে মদদ জোগাবেন না। মৌলবাদী শক্তিকে মাথা চারা দিয়ে উঠতে বাধা দিন। আপনার বিবেক, মানবিকতা, মননশীলতা ধর্মের কাছে বিক্রি করে দিয়েন না। মৌলবাদের মত ভয়াবহ শক্তিকে তাল দিয়ে দানবে রূপান্তরিত করে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েন না।
আপনার মেয়েকে মুক্ত বাতাসে মানুষ হতে দিন। তাকে শিক্ষিত, সাহসী, মানবিক হিসেবে গড়ে তুলুন। ছেলে সন্তানদের মানুষ করুন এমনভাবে সে যেন শুধু পুরুষ না হয়ে মানুষ হয়। বিবেকবান হয়, হৃদয়বান হয়, সৎ হয়। মেয়েদের শুধু কামনার বস্তু নয়, মানুষ হিসেবে সমকক্ষ ভাবে।
সেই সাথে প্রতিবাদ করুন মেয়েদের উপর হওয়া অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করুন সঠিক বিচারের জন্য। বিচারব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করে দোষীদের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি পাবার মত ব্যবস্থা সরকার যেন গ্রহণ করে সে জন্য আওয়াজ তুলুন। এবং সেই সাথে জোরে “না” বলুন মৌলবাদকে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]