ডিভোর্সড নারী ও আশেপাশে থাকা কিছু মাংসাশী প্রাণি
শাহরিয়া দিনা।। একজন রোহিঙ্গার ঘরে জন্ম নেয়া শিশু আর বিল গেটসের সন্তানের বেড়ে ওঠার পরিবেশ এক না। তাদের শিক্ষা, জীবনাচরণে আকাশপাতাল পার্থক্য। আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় চার ধরনের পদ্ধতি বিদ্যমান। ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মাধ্যম, ইংলিশ ভার্সন এবং মাদ্রাসা শিক্ষা। যেন অভিভাবকের সামর্থ্য অনুযায়ী বেছে নাও কার্যক্রম। সবার জন্য শিক্ষা হলেও সবার জন্য সমান শিক্ষা নয়। তো, এই চার ধরনের পদ্ধতিতে পড়া মানুষের কাছ থেকে আপনি কখনোই একইরকম নাগরিক আচরণ আশা করতে পারেন না।
একই অবস্থা আর্থিক এবং সামাজিকতায়। সুতরাং আমরা ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসি আর আমাদের চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা। যা আমার সিলেবাসে নাই তা দেখে হৈ হৈ করে ‘গেল গেল’ রব তুলবার কিছু নাই। বরং বিষয়টা জানা-বোঝার চেষ্টা করতে হবে নিজস্ব বিবেচনাবোধ খাটিয়ে। সহনশীলতার বিকল্প নেই। এই সমাজে সবচেয়ে সহনশীল প্রাণিটি সম্ভবত ডিভোর্সি নারী। যদিও ডিভোর্সি, তালাকপ্রাপ্তা, স্বামী-পরিত্যক্তা এইসব বিশেষণ ব্যবহার নারীর জন্য অবমাননাকর। একজন পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু কখনোই স্ত্রী-পরিত্যক্ত শব্দটা ব্যবহার হয়না এমনকি স্ত্রী তাকে ছেড়ে দিলেও না।
সংসার করার স্বপ্ন এবং ইচ্ছে নিয়েই বিয়ে করে মানুষ। কোন কারণে সেটার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা না গেলে তার দায় তো একপক্ষের নয়। একটা মেয়ের ডিভোর্স হল মানে সে কিন্তু মেয়ে থেকে একলাফে একটা মাংসের দলা হয়ে যায়না। সে যেই মানুষ ছিল সেটাই থাকে। সাথে যোগ হয় কিছু হতাশা আর অনিশ্চয়তা। ডিভোর্সি মেয়ে প্রথম ধাক্কাটা খায় নিজের পরিবারের কাছে। বেশিরভাগ পরিবার তাদের নিজের মেয়েকেই বোঝা ভাবতে শুরু করে। যতদিন পারো সয়ে যাও— মেয়ের বাড়ির এই মনোভাবের কারণে লাশ হয়েছে কত মেয়ে তার সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভবত কেউই জানেনা।
যে মেয়েটা মেরুদণ্ড সোজা করে বেরিয়ে এসেছে একটা অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে তাকে পূর্ণ সাপোর্ট দিলে সেই পারবে নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিতে। এই সাপোর্টের জায়গাটা পাওয়াই কঠিন। যেটা পাওয়া সহজ তার নাম সুযোগ নেয়া। বেশিরভাগই তার কাছ থেকে সুযোগ নেবার আশা করে। সেটা শারীরিক সুযোগ। শুভাকাঙ্ক্ষী সহমর্মী সেজে আসেন। উপকার করবেন আশ্বাসের বিনিময়টা আগেভাগে করার তাগাদাই দিবেন। কাজের কথা তুললে পরে দেখা যাবে অবস্থা।
যদি টের পাওয়া যায় মেয়েটা ডিভোর্সি তাহলে পনের বছরের জুনিয়র থেকে ত্রিশ বছরের সিনিয়রদেরও একই প্রশ্ন, ‘‘কীভাবে থাকো? কষ্ট হয়না?’’ ভাবছেন তারা বাড়িভাড়া দিতে না পারার কষ্টের কথা জানতে চাইছে? কিংবা বাচ্চার দুধ কেনার পয়সা না থাকার কষ্টের কথা? অথবা বাজারের অভাবে রান্না বা হওয়ায় খালি পেটে না ঘুমানোর কষ্টের কথা? নাহ! তারা তা জানতে চায়না। তারা শুধু জানতে চায় সেক্স না করার কারণে কষ্ট হয় কিনা। সে না করে কীভাবে থাকছেন সেটা। আর এই কষ্ট লাঘবে তিনি বা তেনারা যে কত আগ্রহী কত দরদী সেটা আকারে-ইঙ্গিতে এমনকি প্রকাশ্যে বলে বুঝানোর চেষ্টাতে ত্রুটি রাখবে না।
আচ্ছা, এই ডিভোর্সি-দরদীরা তাদের বিধবা মা’য়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে না, ‘‘মা তোমার একলা থাকতে কষ্ট হয়না? কিংবা একটা সঙ্গী ছাড়া কীভাবে থাকো, অন্তত একটা বয়ফ্রেন্ড রাখলেও তো পারো।’’ কারণ তারা বাইরের মানুষের জন্য এত কনসার্ন হলে ঘরের মানুষের প্রতি আরও কেয়ারিং হওয়া উচিৎ। নাহ আমি টিপিক্যাল কথা নারী মা’য়ের জাত বা ঘরে মা-বোন নেই ধরনের কথাবার্তা বলছি না। দুনিয়ায় সবার কেন মা-বোন হতে হবে! একটা পুরুষকে তো আরেক পুরুষ নিজের বাপ-ভাই মনে করেনা। সম্পর্ক তো হবার কথা মানবিক এবং স্বাভাবিক।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডিভোর্সড মেয়েটাকে গোপনে আপন করে পাবার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ারাই কিন্তু তার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলে। কোন বন্ধুর সাথে ঘুরতে দেখলে কুৎসা রটায়। অথচ উনিই কিন্তু বলতেন, তার স্ত্রী কত অকর্মা, বুদ্ধিতে কত আমড়া কাঠের ঢেঁকি মার্কা, দেখতে কেমন জরিনা; বিপরীতে সেই মেয়ের পায়ের নখ থেকে মাথার চুলের কতশত প্রশংসা। বিছানায় নেয়া যায়নি বলে তার দীঘল কালো কেশ হয়ে যায় ঘোড়ার লেজ, বনলতার মতো চোখ হয়ে যায় গরুর চোখ, বেগম রোকেয়ার মত ব্যক্তিত্ব হয়ে যায় ফালতু মেয়েমানুষ কোথাকার।
এসব মাংসাশীদের ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যারে পাই তারে খাই’ অবস্থা। এর মধ্যে পছন্দের তালিকায় বিচ্ছেদে একা থাকা, পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ারা শীর্ষতম। এরা কিন্তু বউয়ের চোখে হিরো। এখন হিরো আলমও কারো চোখে হিরো হতেই পারে, ব্যাপার না! কিন্তু সমস্যা হল, এই হিরোপত্নীরা যত দোষ নন্দঘোষ বলে মেয়েটাকেই নন্দঘোষ বানায়। আর এই হিরোরা বউয়ের আঁচল ছায়ায় থেকে অন্যের ব্লাউজের হুক খুলবার ধান্ধা করে। গাছের উপরেরটা খাই তলারটাও কুড়াই অবস্থা।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে—
গরব সব হায় কখন টুটে যায়, সলিল বহে যায় নয়নে’। এখন সোশ্যাল মিডিয়া যুগে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার দিনে গানের কথাগুলো একটু অন্যরকম হয়ে যেত। যেমন- সিসিটিভি’র ফাঁদ পাতা রুমে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে…
বাকি সব ঠিকঠাক অর্থাৎ নয়নে সলিল বহিয়া যাবে। সুতরাং ছদ্মবেশী শুভাকাঙ্ক্ষী কিংবা প্রেমষ্পদ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলাই সর্বোত্তম।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]