‘দাঙ্গাল’ কেন আপনাদের ভালো লাগে?
শাকিল মাহমুদ।। ‘দাঙ্গাল’ কেন আপনাদের ভালো লাগে? কেনো এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জনপ্রিয় সিনেমার একটি? এ প্রশ্ন হুট করেই উদয় হলো। এরপরই দুই ঘণ্টা ব্যাপী সিনেমাটি পুনরায় দেখলাম। এবং সেই একই প্রশ্ন, দাঙ্গাল কেন আপনাদের ভালো লাগে?
আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক- সেটা ছেলে বুড়ো সবাই জানে। একটি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার আগাগোঁড়া পুরো কাঠামোই নারীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পুরুষের জয়গান গাইবে সেটাই স্বাভাবিক। আজকাল দেখা যায় অনেক নারীই একটু আধটু চাকরি করতে পারলে খুশিতে গদগদ হয়ে বলতে শুরু করেন, ‘‘আমার বাবা/ভাই/স্বামী আমাকে চাকরি করতে দেয়!’’ এছাড়াও আজকাল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়। এ বিষয়টিকে একগোষ্ঠী এমন এক পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন যে এখন চোর এসেও যদি বলে, ‘‘আমি চুরি করবো। এটা আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা’’- তখন মুখ বন্ধ করে তাকে চুরি করতে দিতে হবে! ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে এমন সব ভুলভাল ব্যাখ্যা করা বন্ধ করে মূল বিষয় নিয়ে আলাপ জরুরি। যেমন এ সমাজ ব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক। ধর্মীয় এবং মান্দাতার আমলের জীর্ণ ধারণা পোষণ করে এবং এক প্রকারে পুরুষতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে কোনো ক্ষেত্রে নারীকে ছাড় দিয়ে চলা এ ব্যবস্থাকে আমি মরিচা ধরা লোহার সঙ্গে তুলনা করি। এখন মরিচা ধরার ফলে ক্ষয়ে যাওয়া লোহার কিছু অংশ খুঁচিয়ে ফেলে দিতে হবে। অর্থাৎ এ সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের যে কুসংস্কার রয়েছে তাকে উপড়ে সমাজ থেকে ফেলে দিতে হবে। এতে অবশ্য প্রথমে আপনাকে অনেকে অনেক কথা বলবে, পাগল বলবে, ঢিল ছুঁড়বে। কিন্তু তাতে দমে গেলে চলবে না। ‘দাঙ্গাল’ সিনেমাটি এ সমাজ ব্যবস্থাকে মাথায় তুলে ধড়াস করে মাটিতে ফেলে দেয়ার মত একটি সিনেমা। তবুও যখন দেখি এ সিনেমা আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষের ভালো লাগে বিশেষ করে যারা পুরুষতন্ত্রের ধ্বজা ধরে বেড়ায়, তখন বেশ অবাকই হই। এবং ভাবি এদের কাছে সিনেমাটি স্রেফ বিনোদন বৈ আর কিছু নয়।
কিন্তু সিনেমাটিতে খুব স্পষ্ট করে এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে, নারী পুরুষ সমান সমান। এবং সমাজের যুগ যুগ ধরে পুষে রাখা ধারণা কিভাবে মগজ থেকে উপড়ে ফেলতে হয়। সে জন্য সিনেমার অন্যতম চরিত্র মহাবীর সিং ফোগাত তার দুই মেয়েকে মেয়েলি স্বভাবের বাইরে নিয়ে মানুষ এবং একজন কুস্তীগির হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস করেন। তিনি নারীকে দুর্বল নয় নারীর চিন্তাকে দুর্বল মনে করেছেন বলে সালওয়ার-কামিজের বদলে মেয়েদের প্যান্ট, টি-শার্ট পরতে দেন, লম্বা চুলের বদলে চুল ছেঁটে ছোট করে দেন। অনেকে এক্ষেত্রে বলবেন, কে কী পরবে, কীভাবে চলবে তা অন্য কেউ কেন ঠিক করবে? অন্য কেউ ঠিক করবে না ঠিকই। কিন্তু যখন একটি সমাজ ব্যবস্থা অন্য একজনের স্বার্থে গড়ে ওঠে এবং সে সমাজে বাস করা একটা গোষ্ঠী অবহেলিত হয় যুগ যুগ ধরে তখন তাকে তার পথ চিনিয়ে দেয়াটা মোটেই নিজের ইচ্ছেকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া নয়। নারী শারীরিকভাবে দুর্বল নয়। মানসিকভাবে তারা এ সমাজে দুর্বল। যেটা নারীরা মেনে নিয়েছেন একবাক্যে। তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেয়া ঘর-সংসার সামলান, বাচ্চা জন্ম দেন, চুল বাঁধেন, হেঁশেলে পড়ে থাকেন। আর এসবকে যেহেতু নারী জন্মের পর পরই মেনে নেন সেহেতু এ সমাজের ধারনা, নারী নিজের ইচ্ছেয় এসব করেন, তাদের এসব ভালো লাগে। আদতে তা কিন্তু নয়। বরং একজন মানুষ জন্মের পর তার আশেপাশের পরিবেশ দেখে, মানুষের কর্মকাণ্ড দেখে বোঝেন তিনি কে, তার কাজ কী! ফলে নারী জন্মের পর থেকেই দেখছেন তার মা-চাচী-দাদিরা দিন থেকে রাত অবদি হেঁশেলে পড়ে থাকছেন, বাচ্চা জন্ম দিচ্ছেন, মুখ বুঝে বাবা-কাকা-দাদাদের মার খাচ্ছেন- তখন সে মেয়ে মানসিকভাবেই ঠিক করে নেয় এটাই তার কাজ। কিন্তু সে যদি জন্মের পর দেখতেন তার মা-চাচী-দাদিরা পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছেন। নারী-পুরুষ বৈষম্য নেই, সব সমান। তখন সেও মানসিকভাবে ঠিক করে নিতে পারতো তার কাজ কী! টারজান নামক যে প্রাণির সঙ্গে আমরা পরিচিত সে আদতে মানুষ হলেও চিন্তা চেতনায় সে নিজেকে ওই জঙ্গলের অন্য সব প্রাণির মতই একজন মনে করেন। তাই তিনি ওই সব প্রাণিদের মত ডাকেন, গাছে ঝুলে চলেন। ঠিক সে রকমই নারীর ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। শুধু যে নারীর ক্ষেত্রেই হচ্ছে তা নয়। পুরুষরাও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় বেড়ে উঠছেন এ সমাজ ব্যবস্থা দেখেই। সুতরাং যারা বলেন, সংসার করা, সন্তান জন্মানো নারীরা ইচ্ছে করে ঠিক করেন, আনন্দের সঙ্গে বেছে নেন তারা পুরুষতন্ত্রের দালাল।
এখন আমাদের লড়াইটা এই যে মানসিকভাবে একজন নারীকে দুর্বল করে রাখা, এর বিরুদ্ধে। নারীদের মানসিকভাবে শক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। বোঝাতে হবে, এ সমাজে নারীরা যা আজীবন করে এসেছে তা পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া কাজ। এ ব্যবস্থাকে লাথি মেরে ভেঙে ফেলতে হবে।
জীবনানন্দের বনলতা সেন কিংবা হুমায়ূন আহমেদের রূপারা বরাবরই পুরুষতন্ত্রের ঝাণ্ডা বয়ে বেরিয়েছে। আর আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বনলতা আর রূপাদের প্রেমে মজে তাদেরকে আদর্শ নারী আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু এ সমাজ ব্যবস্থাকে ভাঙতে হলে এ ব্যবস্থার বিপরীতে চলতে হবে এবং প্রতি মুহূর্তে বনলতা কিংবা রূপা তৈরির আস্তানায় লাথি মেরে মেরে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার আঁতুড় ঘরকে ভেঙে ফেলতে হবে।
পরিশেষে প্রথমে উত্থাপিত প্রশ্নের সোজা একটা জবাব দিয়ে লেখার ইতি টানবো। ‘দাঙ্গাল’ কেন আপনাদের ভালো লাগে? কেন এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জনপ্রিয় সিনেমার একটি? কেননা জনগণ সস্তা বিনোদনের খাতিরে সিনেমা দেখে। সিনেমায় অনুভ’তির যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে দর্শক তাতে মজে মূল বিষয় থেকে বহু দূরে সরে গেছে। ফলে সিনেমাটি দর্শকের ভালো লাগলেও নজরে আসে নি এর মূল বিষয়। যার ফলে সিনেমাটি এত জনপ্রিয়। তবুও আমার প্রশ্ন থেকেই যাবে এ সমাজের কাছে, দাঙ্গাল কেন আপনাদের ভালো লাগে? কেনো এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জনপ্রিয় সিনেমার একটি?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]