জলধারা এবং কদর্যতা
ফারজানা নীলা।।
সারাদিনের কোন কাজ আমার প্রিয় জানতে চাইলে আমি বলি স্নান আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ । জলের ধারার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা, জলের গায়ের সর্বত্র গড়িয়ে নেমে যাওয়ার অনুভূতি নেওয়া। প্রতিদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরেই সোজা বাথরুমে ঢুকি। যাকে আমি জলঘর বলি। এই জলঘরে আমি দীর্ঘক্ষণ একা নিজের সাথে কাটাই। অথবা নিজের শরীরের সাথে কাঁটাই। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে আমি ঝর্না নামের জলধারার নিচে দাঁড়াই। জল মাথা হয়ে ধীরে ধীরে পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে যায়। শরীরে লেগে থাকা সকল ধুলো বালি ময়লা ঘাম ধুয়ে নিয়ে যায়। শরীরকে শান্ত করে সতেজ করে আবার জীবিত করে।
না আরও কিছু করে এই জল। গায়ে লেগে থাকা সকল কুৎসিত নোংরা কদর্য বীভৎস দৃষ্টি, ছোঁয়া, বাক্য সব ধুয়ে নিয়ে যায়। দীর্ঘ দশ ঘণ্টা আমি বাইরে কাটাই। সে দশ ঘণ্টায় গায়ে শুধু ধুলো ময়লা রোদ ঘাম নয় বরং আরও কিছু লাগে যা দেখা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায়। এই অনুভূতিগুলো বড্ড জঘন্য। এই জঘন্য অনুভূতিগুলোকে নিমিষেই ধুয়ে নিয়ে ড্রেনে ফেলে দিয়ে আসে ঐ স্বচ্ছ জলধারা।
ওই স্বচ্ছ জলধারাকে আমি ভালোবাসি। কারণ এই জল আমাকে ভালোবাসে। আমাকে বোঝে। আমার সকল খারাপ লাগা অনুভূতিকে সে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে তোলে।
স্নান সেরে যখন আমি বের হই, আয়নায় দাঁড়াই, নিজেকে আমার ওজনহীন মনে হয়। মনে হয় সারাদিন কতশত ওজন জমা করেছিলাম শরীরে এখন সেগুলো উড়ে গেছে। আমি এখন হালকা। নরম পশমের মতো। পাখির পালকের মত। অথবা আমার ঘরে যে পোষা বেড়ালটি আছে, তার মত তুলতুলে।
আয়নায় দেখি আমি এখন সুন্দর হয়ে গেছি। আমার গাল ত্বক চোখ ঠোঁট দিয়ে জ্যোতি বের হচ্ছে। নরম কোমল শুভ্র জ্যোতি। আমার নিজেকে ভাল লাগে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি নিজেকে সুন্দর ভাবতে ভাবতে।
পুরাতন বারোটি বছরের মত আজকেও আমি সকালে উঠি, তৈরি হই আবার নিজেকে বের করতে এই নোংরা পরিবেশের মধ্যে। আমার কোনও গাড়ি নেই ব্যক্তিগত। আমি সাধারণের মতই বাসে ট্রামে চড়া নারী। সকাল সাড়ে সাতটায় যখন আমি লাইনে দাঁড়াই বাসের জন্য তখন আমি চোখে রোদচশমা পরি। যদিও তখন সূর্য গনগনে হয়ে উঠে না। কিন্তু আশেপাশে অনেক গনগনে আর ঘিনঘিনে নজর এড়িয়ে যেতে বস্তুটি আমাকে অনেক সহায়তা করে। আমি কৃতজ্ঞ আমার রোদ চশমার প্রতি। এই রোধ চশমার ফাঁক দিয়ে আমি দেখি আমার পাশের লাইনে দাঁড়ান কয়েকজন পুং লিঙ্গধারী আমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। আমি তাদের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারি তাদের দৃষ্টির কদর্যতা।
এই শুরু আমার শরীরে ময়লা লাগা। মনে মনে ভাবি আরও কত লাগা যে বাকি!
বাসে আমি নারী সিট বলে যে গরম উত্তপ্ত সীট পাওয়া যায়, পারতপক্ষে আমি সেখানেই বসতে চাই। মাঝে মাঝে দাঁড়াতেও হয়। দাঁড়াতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমার কোমরে পায়ে মেরুদণ্ডে যথেষ্ট জোর আছে দাঁড়িয়ে যাওয়ার । কিন্তু আশেপাশের কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণীর অঙ্গ লাগানর প্রবল ইচ্ছের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে ঘেন্না লাগে।
আমার অফিসে আমার জন্য একটি ডেস্ক আছে। সেখানে আমি যতটা মন দিয়ে কাজ করি ঠিক ততটাই মন দিয়ে আমাকে কেউ না কেউ দেখতে থাকে। আমি এই ক্ষেত্রেও না তাকিয়ে বুঝতে পারি তাদের দৃষ্টি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাঝে মাঝে সাহসী হয়ে ওঠে। অপ্রয়োজনীয় কথাকে প্রয়োজনীয় বানিয়ে কাছে ঘেঁষতে চায়।
– তানিয়া, কী খবর?
– জ্বি ভাল।
– আর একা একা কত ভাল থাকবেন বলেন, এবার দোকা হয়ে যান।
আমি সামান্য হাসি।
– বলেন তো পাত্র খোঁজা শুরু করি!
– পাত্র কি রেডি আছে?
– রেডি নেই, আপনি বললেই পেয়ে যাবো।
– তাই? জামা নাকি, বললেই পাওয়া যায়।
– হাহাহাহ। আপনি হাসাতে পারেন মিস তানিয়া। জামা কেন হতে হবে? ছেলের অভাব আছে নাকি ভুবনে?
– না ছেলের অভাব অবশ্যই নেই। মানুষের অভাব আছে।
কিছুটা থতমত খেয়ে রফিক সাহেব বলেন, জ্বি কী বললেন?
– ছেলে পুরুষ রোজই দেখি। মানুষ দেখি না। মানুষ পেলে দোকা হবো।
রফিক সাহেব একটা ঠোঁট বাঁকা হাসি দিলেন।
– ঐ মানুষ খুঁজতে খুঁজতে যদি যৌবনই চলে যায় তাহলে মানুষ দিয়ে কী করবেন? হেহেহে।
রফিক সাহেবের মোটা পেটটি দুলে উঠে যখন তিনি এমন হেহেহে করে হেঁসে উঠেন।
হাসতে হাসতে তার দৃষ্টিটি আমার ওড়না ভেদ করে বুকের দিকে যায়। আমি তাকাতেই সরিয়ে নেন তার নর্দমার দৃষ্টি। কিন্তু ততক্ষণে আমার গায়ে নোংরা লেগে যায়।
আমি কেন বিয়ে করি না এটা মানুষের বিনোদনের একটা অংশ হয়ে গেছে। এই বিনোদন মানুষকে কতটা সুখ দেয় সেটা বলতে পারব না। কিন্তু আমাকে একরাশ বিরক্তি দিয়ে যায়।
আমার যে প্রেম ভালোবাসা জাগে না তা নয়। আমারও ভালবাসতে ইচ্ছে হয়। প্রেম করতে ইচ্ছে হয়। প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয়। কিন্তু দুপেয়ে এবং সামনে লেজধারি জীব ছাড়া কিছু দেখি না। দেখি না এমন মানুষ যাকে দেখলে বুকে কাঁপন লাগে, যাকে দেখলে শরীরে আগুন লাগে, রক্তে মাদকতা জাগে। যার জন্য অনন্ত রাত জাগা যায়। যার জন্য অসীম দিন অপেক্ষায় থাকা যায়।
তবে একবার ভালবাসতে ইচ্ছে হয়েছিল। একজনকে দেখে রাতদিন নির্ঘুম কাটিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার শুরুতে।
বড়ভাই বলতে হয় বড় ক্লাসের ছেলেদের। সেই বড়ভাই আমাকে আকর্ষণ করেছিল চুম্বকের মত। আমি মোহগ্রস্ত হয়ে তাকে লেপ্টে ধরতে গিয়ে দেখি সে আমার ব্লাউজের ভেতর কী যেন খুঁজছে। আমি হতবাক হয়ে তাকে বলি “এখনই না!”
সে মানে না। সে খুঁজতে খুঁজতে বোতামের দিকে চলে যায়। আমি আরও তীব্রভাবে মানা করি। সে মানে না। তার অগ্রাহ্যতা আর ব্যাকুলতা আমাকে বুঝিয়ে দেয় সে আমাকে ভালোবাসে না। শুধুই পেতে চায়। ওর চোখে প্রেম নয় কামুকতা জ্বলজ্বল করেছে।
আমি কি কামুক হতে চাই না? চাই। কিন্তু চাওয়াটা দুপক্ষের সমান তালে জাগা উচিত নয় কি? একজনের অসম্মতি কি প্রেমিককে ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে?
প্রেমিককে পারে না কিন্তু একজন কামুককে পারে।
জীবনে আমি প্রেম চেয়েছিলাম। যে প্রেম মেঘ থেকে বৃষ্টি হয় রীতিতে কামও আনবে। কিন্তু প্রেমহীন কাম চাই নি কখনো।
সেদিনের সেই জোরাজুরি আমাকে অনেক পিছনে নিয়ে গিয়েছিল। নিয়ে গিয়েছিল আমার অতীতে, শৈশবে, কৈশোরে।
খেলাধুলা শৈশবে আমার এতই পছন্দ ছিল যে যেই আমার সাথে খেলতে চাইত আমি তার সাথেই খেলতে রাজি হয়ে যেতাম। সে যদি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ও হয় তাতেও কোনও রা নেই আমার।
সেই খেলাধুলা পাগল আমি একদিন খেলতে শুরু করলাম পাশের বাসার ডিগ্রি পড়ুয়া ভাইয়ার সাথে। তিনি আমাকে এক নতুন খেলা শেখালেন। একটা ছোট কাগজ লুকিয়ে রাখতে হবে যেকোনো জায়গায়, খুঁজে বার করতে হবে সেটা। লুকোলাম আমি সোফার নিচে, বাইরে ইটের তলে, জুতার নিচে।
এরপর তিনি লুকোলেন হাতে। আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যখন পেলাম না তিনি দেখালেন তার হাতে মুঠ করা সেই টুকরো কাগজ। বললেন “এবার তুমি লুকোও তোমার শরীরে কোথাও, আমি খুঁজে বের করবো?”
আমি লুকোলাম আমার চুলের ব্যান্ডের ভেতর।
তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজলেন আমার সারা শরীর। আমার ফ্রকের ভেতর হাত গলিয়ে, আমার প্যান্টের ভেতর হাত গলিয়ে। আমি স্তব্ধ থেকে ভয়ে কাঁদতে শুরু করলাম যখন তখন তিনি হাসতে শুরু করলেন।
বললেন “আরে তুমি তো খেলায় হেরে গেলে কেঁদে ফেলো। তোমার সাথে তো আর খেলা যাবে না।”
আমি দৌড়ে পালাই।
সেদিনের সেই কিলবিল করা হাতের স্পর্শ আজো আমার সাথে লেগে আছে। কোনও সাবান স্ক্রাব বডি ওয়াশ কিছুই সেই স্পর্শ দূর করতে পারে না।
আমি বড় হয়েছি সেই স্পর্শ নিয়ে। আমি পড়ালেখা করেছি সেই স্পর্শ নিয়ে। আমি পাশ করেছি সেই স্পর্শ নিয়ে। আমি চাকরি করছি সেই স্পর্শ নিয়ে। আমি খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, গল্প করছি, ঘুরছি এবং শ্বাস নিচ্ছি সেই স্পর্শ নিয়ে।
কাজ শেষে যখন আবার বাস ধরার সময় হয় তখন আমি ক্লান্ত থাকি। বাসের জন্য এবার আমাকে অনেক কসরত করতে হয়। কে কার আগে উঠতে পারবে সেই কসরত। এই কসরতে আমার শরীর শক্ত হয়ে যায়। পা বাসের দিকে এগুতে চায় না। কিন্তু বাড়ি ফেরার অন্য উপায় নিতে আমি সক্ষম নই।
পা বাড়াতে হয়। ধাক্কাধাক্কি লাগাতে হয়। যতক্ষণ বাসে উঠে একটা জায়গায় না বসতে পারি ততোক্ষণ একটা সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র ভয় আমার আশেপাশে জোঁকের মত লেগে থাকে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে আপ্রাণ চেষ্টা চলে নিজেকে বাঁচিয়ে মানে নিজের শরীর বাঁচিয়ে বাসে উঠা। কনুইয়ের গুঁতো বা কোমরে খামচি, বুকে থাবা, উরুতে চিমটি বা পেছনে অঙ্গের শক্ত স্পর্শ।
চেষ্টা মাঝে মাঝে সফল হয়। তখন নিজেকে বিশ্বজয়ী মনে হয়। বাসের উত্তপ্ত গরমও তখন হিমশীতল মনে হয়।
আজও সফলতার সাথে জয়ী হয়ে বাসে উঠে একঘণ্টা পর যখন নামতে যাব তখন বাসের দরজার সামনে এসে বুঝতে পারলাম কাঁধে ঝুলানো ব্যাগের পাশ দিয়ে একটা থাবা বুকে এইমাত্র লাগল। থিকথিকে ময়লা কে লাগালো বুঝে উঠার আগেই বাস থেকে নেমে যেতে হল।
ক্লান্তিকর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
রাত বেশি নয়। আটটা কি সাড়ে আটটা। এই সময় গলির মুখে আমি কিছু শিষ শুনতে পাই। প্রতিদিনই পাই। কানে এক থোকা ময়লা জমা হওয়া প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেছে।
আজ নতুন আরেক ময়লা লাগল গায়ে। বাড়ি ফিরে যখন দেখি দুলাভাই বসে আছে সোফায়। এই লোককে দেখা মানে পুরাতন ময়লা নতুন করে ছিটকে লাগা।
আমার বড় বোনের স্বামী একদা আমাকে ঝাপটে ধরে ঠোঁটে একদলা থুথু লাগিয়ে দিয়েছিল।
তিনি একে চুমুর নাম দিয়েছিলেন। আমার কাছে একদলা থকথকে কফ মিশ্রিত থুথুই মনে হয়েছিল।
দৌড়ে বাথরুমে লুকোনো ছাড়া কিছুই যেন করতে পারার মত ছিলাম না।
এই লোকের সাথে আমার বোন বাস করে উনিশ বছর ধরে।
এই লোককে দেখলে আমি একশ হাত দুরে ছিটকে যাই। এই লোককে দেখলে আমার সারা শরীর ময়লায় ভরে যায়।
আমি কোনোমতে মুখটা দেখিয়ে সোজা নিজের রুমে গিয়ে নিজেকে আটকে রাখি।
আটকে রাখি জলধারার নিচে। আমার শান্তি লাগে। স্বস্তি লাগে। তৃপ্তি লাগে। জল গড়ায় শরীর বেয়ে। আমি শুচি হতে থাকি। সুন্দর হতে থাকি। পরিষ্কার হতে থাকি।
অন্যদিনের মতোই সকাল আসে। ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামি। বাসের কাছে যাওয়ার আগে খেয়াল করি সামনের গলি থেকে একটা মিহি কান্নার আওয়াজ আসছে।
কার?
কীসের?
মেয়ের?
গলা ভিজিয়ে যখন সেই আওয়াজের কাছে যাই দেখি একটা নির্মীয়মান দালানের নিচে একটা লোক, মধ্যবয়স্ক, দারোয়ান শ্রেণির; নিজের লুঙ্গি উঠিয়ে কী যেন করছে। আরও কাছে যেতে বুঝতে পারি নিজেকে নিজে মন্থন করছে। আমার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায় যখন দেখি লোকটার সামনে একটা স্কুল পোশাক পরিহিতা ক্রন্দনরত কিশোরী দাঁড়িয়ে।
ভয়ে মেয়েটি থরথর করে কাঁপছে। নাকের পানি চোখের পানি এক হচ্ছে। আর লোকটি তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে মন্থন করছে!
আচানকই আমার মনে হল মেয়েটির চেহারা আমার মত। মেয়েটির স্কুল পোশাকটি আমারটার মত। মেয়েটি যে ভয় পাচ্ছে সেই ভয় আমিও পেয়েছিলাম যখন ঐ প্রতিবেশী ভাইয়া আমার সারা শরীর হাতড়াচ্ছিল।
আমি জমে যাই, থেমে যাই।
কিন্তু হুট করে আবার জেগে যাই। পাশে একটা রড ছিল।আমি ক্ষিপ্ত হাতে সেই রড তুলে নিয়ে সজোরে লোকটার মাথায় বসিয়ে দেই।
লোকটার লুঙ্গি খুলে যায়। তার উত্থিত অঙ্গটিকে ছেড়ে সে চিৎকার করে মাথা চেপে ধরে।
আমি মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে সেখান থেকে পালিয়ে যাই। আমার প্রচণ্ড ভয় লাগতে থাকে। আমার চরম আনন্দও লাগতে থাকে।