November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

‘বিয়ে’ শব্দের বিড়ম্বিত জীবন 

আঞ্জুমান রোজী।। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর আমার চিন্তাচেতনায় কিছু কিছু বিষয়ে দৃঢ়তা আসে এবং সেই মোতাবেক জীবনের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই। সেই সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে মূল সিদ্ধান্ত ছিলো জীবনে কখনো বিয়ে করবো না। বিয়ে না করে জীবনযাপনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। যদিও তখনো ঘোষণা দেইনি। ঘোষণা দিতে শুরু করলাম, যখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। কারণ, হঠাৎ করে শারীরিকভাবে আমার মধ্যে বিশাল এক পরিবর্তন আসে। তাতে অনেকের চোখে পড়তে লাগলাম। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বিভিন্ন ছেলেদের উটকো আচরণ ছিল। যদিও তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে ছিল না। সেইসাথে বেড়ে গেলো আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশিদের অস্থিরতা।  প্রায়ই শুনতাম আম্মাকে বলছে, মেয়ে তো বিয়ের উপযোগী হয়ে গেলো!  এখন তো বিয়ে দিতে হবে! আম্মা শুধু মুচকি হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। আব্বাও শুনে হেসে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু আব্বা আম্মা বেশিদিন বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেননি।

এরইমধ্যে বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করলো। আমাকে না-জানিয়েই ঘরভর্তি মানুষের আনাগোনা চলতে লাগলো। আম্মার সঙ্গে আমাকেও মেহমানদারী করতে হতো। আব্বা বুঝতেন, আমাকে বিয়ের ব্যাপারে কথা বললে, আমি কি রিঅ্যাক্ট করবো। এভাবে লোকজন আসা-যাওয়ার মধ্যে আমার একমাত্র খালা, যে আমার কাছে খুব কাছের একজন ছিল, সে হঠাৎ করে বলে বসে, ‘আজকে তোকে আংটি পরাতে আসবে।’ আমি যেন কথাটি ঠিকমতো শুনিনি বা বুঝিনি, তাই বারবার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছিলাম। তখন খালা বিরক্ত হয়ে আম্মাকে ডেকে বলে, ‘বু আমি আর বুঝায়ে বলতে পারুম না।’ আম্মা অবস্থা বেগতিক দেখে আব্বাকে বিষয়টা বলেন। তখন আব্বা আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত রেখে মেয়েদের জীবন কেমন, সেটা বুঝাতে চেষ্টা করেন। সেইসময় আমি এক ঝটকায় আব্বার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছিলাম আমার বিয়ে না-করার  সিদ্ধান্ত।  আব্বা তখন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তাহলে তুই কী করবি?’ আমি বলেছিলাম, ‘আপাতত পড়াশোনা শেষ করবো। তারপর ভাববো কী করবো।’ আব্বা তখন আবারো বললেন, ‘বিয়ের পরও অনেক মেয়ে পড়াশোনা করে, যদি তারা চায়।’ আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় দেখে আব্বা আর কথা বাড়াননি। আম্মাকে বললেন, ‘মেয়েকে এই বিষয়ে আর ঘাটাইও না।’

তারপর থেকেই লক্ষ্য করেছি, অনেকেই সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে আমাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করার চেষ্টা করে আসছে। এতে আব্বা আম্মা খুবই বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমাকেও মানসিকভাবে নাজেহাল করতে লাগলেন। আব্বা ভাবতেন, উপযুক্ত মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না বলে উনি সামাজিকভাবে অসম্মানীয় হয়ে উঠছেন। আর আম্মা ভাবতেন আমার মেয়েটার ভবিষ্যত কী হবে যদি বিয়ে না করে। এদিকে আব্বা আম্মা আমার বিয়ে না-করার সিদ্ধান্ত কাউকে জানাননি বিধায় নিয়মিত প্রস্তাব আসতো। কখনো তাদের সরাসরি কিছু বলেননি। যখনই কোনো পাত্র আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো তখন আমি টেকনিকালি বুঝিয়ে দিতাম আমার সিদ্ধান্তের বিষয়। আব্বা আম্মার ধারণা ছিল হয়তো এভাবে প্রস্তাব আসা-যাওয়ার মধ্যে আমি কাউকে পছন্দ করে ফেলতেও পারি। কিন্তু আমার মন কোনোকিছুতেই সাড়া দেয়নি। কারণ, আমি উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর আর নিজের পায়ে দাঁড়ানো অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এরমধ্যে, যদি কেউ আমার জীবনে আসেই, তাহলেও তাকে আমার মতো জীবনটাকে জটিলভাবে না দেখে, উড়ো উড়ো ভাব নিয়ে জীবন কাটাতে হবে। এভাবেই মনে মনে স্বপ্ন পুরুষ খুঁজে যাচ্ছিলাম।  কিন্তু বাস্তবে দেখলাম সব পুরুষই ঘরকন্যার জন্য নারী খোঁজে।

বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে আমাকে অনেক অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তা নিয়ে লিখতে গেলে বিশাল এক বই হয়ে যাবে। যাই হোক, বিশেষ করে আত্মীয়স্বজন এবং আব্বা আম্মার বন্ধুদের আমার প্রতি হেয় মানসিকতা আমাকে দিন দিন অসুস্থ করে তুলেছিল। এ সমস্ত মানুষের পীড়াপীড়িতে কখনো কখনো আব্বা আম্মা ক্ষেপে উঠতেন, আবার কখনো কখনো মুষড়ে পড়তেন। আমাকে নিয়ে আব্বা আম্মার মাথাব্যথা চরমে উঠে গেলো। এমন অবস্থায় আমি মাস্টার্স শেষ করি। দশম শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত আমি একদিনও সুস্থির  থাকতে পারিনি। আমি সকলের আদরের ছিলাম। শুধুমাত্র তাদের কথামতো কাজ করছিনা বলে আমি হয়ে গেলাম সবার শত্রু। এর মধ্যে আমার খুব সিরিয়াস ইউরিনাল ইনফেকশন হয়ে গেলে বিছানায় পড়ে ছিলাম এক মাস। আম্মা এতই ক্ষেপেছিলেন আমার উপর যে, আমাকে ডাক্তার দেখাতে পর্যন্ত চাননি। এক আত্মীয় এসে আম্মাকে বললেন, ‘মেয়েকে ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেন? মেয়ে তো মারা যাবে?’ এর উত্তরে আম্মা যা বলেছিলেন তা নাহয় আর নাইবা বললাম। ততদিনে আব্বা মারা গেছেন। আব্বা বেঁচে থাকলে আমার এমন দুর্গতি হতো না। এতো কিছুর মধ্যেও আব্বা আমাকেই বুঝতে চাইতেন। কখনোই মানসিক চাপ দিতেন না।

বিয়ে না-করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। নারীর প্রতি সামাজিক-পারিবারিকভাবে একধরণের বৈরী মানসিকতা আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করামাত্রই আমাকে তুমুল চাপের মধ্যে পড়ে নিজ পছন্দে নিজ সিদ্ধান্তে বিয়ে করতে হয়েছিল। তবে যতদিন আমার সংসার ছিল ততদিন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম নিজ পছন্দে সংসার করতে। পারিনি। কারণ নারীদের ‘নিজের’ বলতে কোনো কিছু থাকতে নেই। এমনকি স্বামীটাও আমার ছিলো না৷ সে ছিলো কারোর সন্তান, কারোর ভাই এবং কারোর প্রেমিক। দিল্লিকা লাড্ডু যোভি খায়া ওভি পস্তায়, যোভি না খায়া ওভি পস্তায়।  বিয়ে করে আমি জীবনের অন্যরকম স্বাদ নিয়েছি বটে, তবে দিল্লীকা লাড্ডু আর গিলতে পারিনি। উগড়ে ফেলতে হয়েছে। আমাকে আবার আমার জীবনে ফিরে আসতে হয়েছে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]