আমার বিয়েটা যখন ভেঙে গেলো…
শাফকাত আনোয়ার।। এটাই কষ্ট যে নারীর জীবনে নারীর নিজস্ব কোনও কষ্ট নেই। চারপাশের সকলে যেন নারীকে কষ্ট দেবে বলে টার্গেট করে বসে আছে। একজন নারী হয়ে যদি আমি কোনও কষ্টের মধ্য দিয়ে না যাই, তাহলে কিসের নারী আমি? কষ্ট পাবো, কষ্ট সইবো, হাসিমুখে ধুঁকে ধুঁকে জীবন পার করবো, এই না হলে হয়?
তাই, নারী হয়েছি বলেই, আমারও কষ্টের একটা বাস্কেট আছে। আমার দিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সময়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়া কষ্ট, আমি তুলে রেখেছি। মাঝে মাঝে কষ্টগুলো বেছে বেছে তুলে নিয়ে দেখি, ভালোই লাগে, আমার কালেকশন বেশ ভালোই। মেডেলের মতো কষ্টগুলো ঝকঝক করে।
আমার প্রথম বিয়েটা যখন ভেঙে গেলো… হ্যাঁ, একাধিক বিয়ের ব্যানারও আছে আমার গায়ে। যা বলছিলাম, শূণ্যপ্রায় একটা বাসায় আমি, আমার দুই বাচ্চা, আর বাচ্চাদের দেখার জন্য আরেকটা ছোট মেয়ে। আমার তখনও চাকরি হয়নি, কিন্তু জানতাম পেয়ে যাবো। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে আমি চাচা ডাকতাম। যতদিন ম্যারিড ছিলাম, উনি এবং উনার স্ত্রী আমাকে মেয়ে বলেই স্নেহ করতেন। আমি প্রায়ই বাচ্চা নিয়ে ওনাদের বাসায় যেতাম, গল্প করে আসতাম, মাঝে মাঝে এটা সেটা রান্না করেও নিয়ে যেতাম। বুড়োবুড়ির জন্য কোথায় যেন খুব মায়া হতো। স্বামী নামের একজন ফ্যামিলি মেম্বার যেদিন থেকে নাই হয়ে গেলো, সেদিন থেকে এই চাচা চাচী হয়ে গেলেন অপরিচিত একদম। সেইরাত থেকে যতদিন ঐ বাসাটাতে ছিলাম, আমি যেন ছিলাম একজন অপরাধী। চাচা ডেকে পাঠালেন। আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেন। এবং জানিয়ে দিলেন, স্বামীবিহীন একজন মহিলা এই বিল্ডিংয়ে থাকলে বাকি ভাড়াটিয়ারা আপত্তি করছে। আমি ওনাকে জানালাম যে আমার সামর্থ্য আছে ভাড়া দেওয়ার, আমি এই বাসায় থাকতে চাই। আমার বড় মেয়ের স্কুল ছিল ঠিক রাস্তা পার হয়েই। আমার জন্য লোকেশনটা খুব সুবিধার ছিল। কিন্তু উনারা দুইজন, আমাকে একমাসের মধ্যে বাসাটা ছেড়ে দিতে বললেন।
স্বামীহীন হওয়াতে আমার চেনা জগতটা রাতারাতি বদলে গেলো। সকলের চাহনি, কথাবার্তা, সব বদলে গেলো। দেখা গেলো আমার খুঁত বের করার জন্য সকলেই ব্যস্ত। খুঁত না থাকলে কি কোনও মেয়ের ঘর ভাঙে? এর মধ্যে খুব তাড়াহুড়ায় যে চাকরি পেলাম সেটাতেই কন্ট্র্যাক্ট সাইন করে ফেললাম, কোনও নেগোশিয়েটও করিনি। মনটা খুব ছোট হয়ে গিয়েছিলো দুই সপ্তাহর মধ্যেই। বাসা খুঁজতে বের হতাম। বাসা পেয়েও যেতাম। কিন্তু কথাবার্তার এক পর্যায়ে যখন বাড়িওয়ালা জানতে পারে আমি ডিভোর্সড, আমার আর বাসা ভাড়া পাওয়া হয়না।
আমি আবার বাড়িওয়ালা চাচার কাছে যাই। ওনাকে বলি, আমাকে একটা কাগজে উনি সই করিয়ে নিন, যেসব যেসব ব্যাপারে বিল্ডিংয়ের মানুষের আপত্তি আমি সেসব ঘটতে দেবোনা আমার বাসায়। ভীষণ অসহায় লাগছিলো, নিজের কাছে নিজে এতোখানি ছোট কোনওদিন হইনি আগে। বাড়িওয়ালা চাচা আমাকে বললেন উনার ফ্ল্যাট যেন আমি দেড় কোটি টাকা দিয়ে কিনে নেই, তাহলে উনি বাকি ভাড়াটিয়াদের মুখ বন্ধ করে রাখবেন। আমার কাছে, তখন ছিলোনা দেড় কোটি টাকা। একজন ডিভোর্সি ভাড়াটিয়া হয়ে থাকলে সমস্যা, কিন্তু ফ্ল্যাটের মালিক হিসেবে থাকতে পারবেন। বাসা ছেড়ে দেওয়ার সময়ে অ্যাডভান্সের টাকাটা বাড়িওয়ালা চাচা ফেরত দিলেন না। স্বামীর নামে বাসা ভাড়ার কন্ট্র্যাক্ট করা হয়েছে, ওর হাতেই টাকাটা দেবেন (জানিনা আদৌ দিয়েছেন কিনা পরে)।
এই অভিজ্ঞতা শুনতে হয়তো খুব হাল্কা শোনায়। কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আপনি যখন সম্পূর্ণ অপ্রাসংগিক একটা কারণে আপনার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবেন, তখন পুরা পৃথিবী আপনার কাছে অচেনা হয়ে যায়। আমি খুব কনফিডেন্ট এবং যুক্তি মেনে চলা একজন মানুষ। আমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার বিষয়টা আমার নিজের কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিলো। একটা মরে যাওয়া সম্পর্ককে জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করলে তাতে পচন ধরে, সেই পচনের গন্ধ বাচ্চাদের গায়েও আসে। আমি নিজে বিশ্বাস করি সেই সময়ে আমার ডিভোর্সটা আমাদের দুইজনেরই খুব দরকার ছিলো। খুব শান্তিপূর্ণ একটা ডিভোর্সের পর, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার কিংবা আমার প্রাক্তন স্বামীর এই বিয়েভাঙা নিয়ে কোনও হাহাকার না থাকলেও, মানুষের আহাজারি শেষ হয়না। তার জের ধরে, এই মানুষগুলা কারো না কারো উপর দোষ চাপাতে চায়, তকমা বসাতে চায়। আমার প্রথম বিয়েটা ভাঙার পর, বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করাটা আমার উপরে ছিলো প্রথম ধাক্কা।
যাই হোক আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো। যখন চোখে অন্ধকার দেখছিলাম, বন্ধুর জোর রেকমেন্ডেশনে তার প্রবাসী আত্মীয়ের বাসা ভাড়া পেলাম। তবে সেই বাসার এগ্রিমেন্ট আমার নামে হয়নি, আমার বাবাকে ঢাকায় আসতে হয়েছিলো, বাড়িওয়ালার কাছে প্রমাণ করা লেগেছে আমি কোনও লাওয়ারিশ মেয়ে নই। আমার বাবাকে বাড়িভাড়ার এগ্রিমেন্টে সাইন করা লেগেছে। আমাকে আমার চাকরির স্যালারি-ছাপানো এগ্রিমেন্ট লেটারের একটা কপি বাড়িওয়ালাকে দিতে হয়েছে।
অপরাধ না করেও অপরাধী হওয়াটা যেন মেয়েদের জন্য অবশ্যম্ভাবী। কতবার বন্ধুর সাথে ঝগড়া হয়, কথা বলা বন্ধ হয়, কিংবা ভাইবোনে ঝগড়া হয়, কত আত্মীয়ের সাথে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। সেসব ব্যাপার না। স্বামী নামের একজনকে যদি আপনার একসময় আর ভালো না লাগে, তাকে যদি স্বামীর জায়গাটা আর দিতে ইচ্ছে না করে, তার সাথে যদি এক বিছানা তো দূর এক ঘরে আপনার থাকতে ইচ্ছে না করে, সেটা অ-নে-ক বড় ব্যাপার হয়ে যায়। একটা মেয়ে হয়ে যায় দোষী। এই ব্যাপারে যেন কোনও ইচ্ছে খাটাতে নেই।
ব্যাস, চারপাশের সকলে শুরু করে দেয় ধাক্কা দেওয়া। আপনি যত শক্ত থাকবেন, আপনার দিকে ছুঁড়ে মারা কষ্টের পাথরের সাইজ ততো বড় হতে থাকবে। কারণ সবাই বিরক্ত হয়, এই মেয়ে ভাঙে না কেন? এই মেয়ে কাঁদে না কেন? কান্না ছাড়া, লুটানো শাড়ির আঁচল ছাড়া, মেয়ে হওয়া কি সার্থক হয়?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]