November 2, 2024
ফিচার ১মুক্তমত

‘আর্দশ নারী’ নই বলেই আমি খারাপ

সিদ্রাত মুনতাহা।। নারী জীবনের কষ্টের অভিজ্ঞতা সিরিজে লিখতে গিয়ে অনেক ভাবলাম। বুঝতে পারছিলাম না আসলে বিশেষভাবে কোন অভিজ্ঞতার বলব। পরে মনে হলো বিশেষ কোন অভিজ্ঞতার কথা না বলে বরং নারী হিসেবে আমার জীবন কীভাবে কেটেছে সেটা নিয়েই লিখি। একজন ‘আদর্শ নারী’র সংজ্ঞা বলতে এ সমাজ যা বোঝে তা কখনোই ছিলাম না আমি।

খুব বেশি পরিপাটি আমি কখনোই ছিলাম না। নারীদের সাজসজ্জায়ও খুব বেশি আগ্রহী ছিলাম না। খুব সাদাসিধে চলাফেরা করতাম। নিজেকে অতি সুন্দরী দেখানোর চিন্তা মাথায় কাজ করত না। আর মা বলত ‘‘কেমন মেয়ে মানুষ হইসিস, একটু রুপচর্চাও করিস না”। আমি গভীর মনোযোগে গায়ে রং মেখে ছবি আঁকতাম আর মায়ের গালি খেতাম যে আমি নাকি নোংরা।

ছোটবেলায় দিব্যি ছেলেদের শার্ট প্যান্ট পড়ে ঘুরে বেড়াতাম। বই পড়তাম প্রচুর, মাঠেও খেলতাম আবার গেমও খেলতাম প্রচুর। ছোটবেলায় বাবা কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন। মনে আছে আমার শৈশবের ছেলে বন্ধুরা ঠাট্টা করে আমাকে বলত তুমি পারবা না আমার সাথে গেমে। মেয়ে বলেই যেন এই তাচ্ছিল্য। এমনকি এও মনে আছে এক ছেলে বন্ধুকে গেমে হারিয়ে দিয়েছিলাম। সমান তালে দুজনের মাউস কন্ট্রোলার চলছে, আমার বন্ধু উত্তেজিত, তার মধ্যে সংকোচ শেষমেশ একটা মেয়ের কাছে হেরে যায় কিনা। হ্যাঁ শেষমেশ সে একটা মেয়ের কাছেই হেরে গিয়েছিল। আফসোস আমি কখনো গেম খেলার জন্য গেমার মেয়েবন্ধু পাইনি।

আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম, আর ফ্যামিলি থেকে চাপিয়ে দেওয়া হলো সালোয়ার কামিজ নামক পোশাকটি যা আমি কখনোই পছন্দ করতাম না। কিন্তু আমি তো মেয়ে, বড় হচ্ছি, শালীনতা বজায় রেখে বুক ঢেকেঢুকে চলতে হবে। সবসময় ভাগার চেষ্টা করতাম এই পোশাকটা থেকে। জিন্স টপ, কুর্তি, ফতুয়াতেই আমি কম্ফোর্টবেল ছিলাম। এজন্য কত কথা শুনতে হয়েছে তার হিসাব নেই- আমি বেহায়া, বেপর্দা, বেপরোয়া আরো কত কি!

মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সালোয়ার কামিজ গায়ে চাপতাম একটা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত। তারপর নিজের যখন এতটুকু অবস্থান তৈরি হলো যেখানে নিজের ইচ্ছামতন পোশাক গায়ে জড়ানো যায়, নিজের ইচ্ছাই প্রায়োরিটি দিতাম। অনেক কথা শুনতাম তারপরও নিজের পছন্দেই চলতাম। আমার কাছে ফ্যাশনের মানে হচ্ছে নিজের কম্ফোর্ট জোন। আমি পোশাক পরবো নিজেকে খুশি করার জন্য, অন্যকে খুশি করার জন্য না।

খুব বেশি মেকাপ করতেও ভালোবাসতাম না কখনোই। হাল্কা পাতলা সাজে আমি সবসময় নিজেকে দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু পরিস্থিতি ও সবার সাথে খাপ খাওয়াতে অনেক সময় ভারি মেকাপ করতে হত তবে সেদিন কেমন যেন নিজেকে অচেনা অচেনা লাগত। এই নাহয় গেল পোশাক আশাকের কথা। পোশাক আশাক নিয়ে এখনো কথা শুনি।  এখনো শুনি এত বড় মেয়ে কাপড় চোপড়ের ঠিক নেই।

যেকোন অনুষ্ঠানে যেতে হলে আমি শাড়ি পরে যাই কারণ শাড়ি বড্ড ভালোবাসি আমি। ভালো লাগা থেকেই পরি। আবার এখানেও কারো কারো অবজেকশন “ঢং, এত শাড়ি পরা লাগবে কেন? ছেলেদের মনোযোগ চায়”! হাহাহা। এরা কখনোই বুঝবেনা আমার সাজগোজ আমার নিজেকে ভালোবেসেই।

তারপর আসি বন্ধুমহলের কথায়। আমার বন্ধু বরাবরই কম। এর কারণ হয়তো বা আমি বই পড়তে ভালোবাসতাম ছোটবেলা থেকে আর আগ্রহ ছিল সংগীতে। তাই চিন্তাচেতনা অন্য রকম ছিল। অপরদিকে আমার হাই স্কুলে কোন বই পড়ুয়া মেয়ে বন্ধুই ছিল না। খুব ইচ্ছে হত এমন কোন বান্ধবী হবে আমার যার সাথে বই, সাহিত্য, বিজ্ঞান নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করা যাবে। কিন্তু আমার বেশিরভাগ বান্ধবীর কথা বলার টপিক ছিল প্রেম ভালোবাসা, সাজগোজ, বয়ফ্রেন্ড ইত্যাদি, যা সবসময়ই আমার বোরিং লাগত। আমি এড়িয়ে যেতাম নাহয় চুপ থাকতাম কারণ এসব বিষয়ে আমার আসলেই কিছু বলার নেই। আমি প্রেমে আগ্রহী নই বলে অনেক বান্ধবীই আমায় নিয়ে মজা নিত। বোকাসোকা ভাবত। আসলে আমি বোকা ছিলাম না, ব্যাপারটা হচ্ছে আমি যা বুঝতাম তা ওরা বুঝত না, আর আমি বুঝাতে গেলে আমিই হাসির পাত্রী হতাম। তাদের মনে হত আমি অল্প বয়সে বেশি জ্ঞানগর্ভ কথা বলছি, যা নাকি আমার সাথে যায় না। মানায় না। আমারো উচিত বিয়েশাদির স্বপ্নে বিভোর হয়ে এসব আলোচনা করা। আমি তাদের বলতাম বই পড়। তারা তাতে বিরক্ত হত।

আমাকে তারা পাগলাটেও ভাবত কারণ আমি আগে থেকেই স্পষ্টবাদী স্বভাবের। কোনো ব্যাপারে আমার মতামত আমি সরাসরি ব্যক্ত করতাম সেটা কড়া শোনালেও।তোষামোদ করা কখনোই আমার স্বভাবে ছিল না। আমার আত্মীয়স্বজনরাও আমাকে বলত আমি পাগল। কারণ সেই একটাই সোজাসাপটা কথা বলতাম। কিছু ভালো না লাগলে মিথ্যে প্রশংসা হতো না আমার দ্বারা। আমার আত্মীয় আর বান্ধবীদের দেখতাম তারা আড়ালে বদনাম করা মানুষদেরও প্রশংসায় ভাসিয়ে দিত যেখানে আমি থাকতাম চুপ। আমার ভালো লাগেনা যাকে সেটা আমি সরাসরি প্রকাশ করব না, কারণ আমি তাকে আঘাত করতে চাইনা, তার মানে আমি তাকে মিথ্যা প্রশংসায় ভরিয়ে দেব তাও না। আমি চুপ থাকব। এড়িয়ে যাব তবুও মিথ্যা ভণ্ডামি আচরন দেখাব না।

আমি এজন্য খানিকটা বোরিং বা বোকা বলে গন্য হতাম। স্পষ্টবাদীতার জন্য রুড বলে গণ্য হতাম। একজন পারফেক্ট মেয়ে নাকি নরম সরম ছিচকাদুনে হয়। লাজুক হয়। কথাবার্তা রেখে ঢেকে বলে। আমি সরাসরি কথা বলি বলেই আমি বেয়াদব মেয়ে। আমি ছিচকাদুনে নই বলি আমি নিষ্ঠুর। গোলাপি রং আমার পছন্দ না শুনে কতজনে অবাক হয়। দোকানে গেলে জিজ্ঞেস করে দোকানদার- আপু পিংক এর মধ্যে দেখাব? আমি যখন বলি আমার পিংক ভালো লাগেনা, তখন কেন তারা অবাক হয়? কেন পিংক ভালো লাগতেই হবে আমার? রং পছন্দের ক্ষেত্রেও জেন্ডার আছে বুঝি? আমার বোল্ড কালার পছন্দ। কালো, গ্রে, এশ, ডিপেস্ট ব্লু, নেভী ব্লু। আমার আশেপাশের মানুষের তাতে কত অবজেকশন। আমি কেন এমন ধরনের শোকের কালার পরি? রংচঙে কেন পরিনা? আমি ছেলেদের টিশার্ট পরি।মেয়েদের টিশার্ট আমার পছন্দ না। ডিজাইন ভালো লাগেনা। আমি জেন্টস টিশার্ট পড়ি বলেও হাসাহাসি।

তারপর আমি রক ও মেটাল গান পছন্দ করি এটাও সমস্যা। আমার কোন বান্ধবীরা রক বা মেটাল শোনেনা। তারা হিন্দি বা বাংলা লুতুপুতু ধরনের প্রেমের গান পছন্দ করে। আমার পছন্দ না অমন গান। আমার রকই ভালো লাগে। রক ভালো লাগা নিশ্চয়ই দোষ না। আমি রক মেটাল বাজালে তারা বিরক্ত হয়। আমার মিউজিক চয়েস দেখে বলে আমি পাগল ছাগল। কীসব গান শুনি। কি অদ্ভুত তাইনা? মিউজিক চয়েসেও জেন্ডার ক্লাসিফিকেশন। কেন একটা মেয়ে কেন মেটালহেড হতে পারবেনা? অনেক মিউজিশিয়ান ছেলে তো আমাকে টেস্টও করতে এসেছে আমি আসলেই মেটাল মিউজিকের কিছু বুঝি কিনা। কি অপমানজনক তাইনা?

বড় হতে হতে খেয়াল করেছি আমার মেয়েবন্ধুর চেয়ে ছেলেবন্ধু বেশি। কেন হবেনা বেশি? মেয়ে বন্ধুগুলার সাথে আমি শাড়ি গহনা, মেকাপ, বিয়ে, সংসার, প্রেমের বাইরে খুব বেশি কোন কথা বলতে পারিনি। তারা সবাই একত্র হয়ে একেকজনের সমালোচনার আসর বসিয়েছে, আমি তাতে যোগদান করতে পারিনি। সত্যি আমার খুবই নিম্নমানের কাজ মনে হয় এটা। মানুষের সমালোচনা করার চেয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হওয়া আমার অধিক লাভজনক লেগেছে। অন্যের বদনাম করতে পারিনি বলেও বান্ধুবীদের খুব প্রিয় হতে পারিনি। বরং এমন অনেক ছেলে বন্ধু পেয়েছি যাদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়, ডিসকাস করা যায়। আমার মেয়ে বন্ধুরা তার প্রেমিক দ্বারা অত্যাচারিত হলে আমি সবসময়ই বলতাম প্রতিবাদ করতে বা বেরিয়ে আসতে, বাকিদের মত বলিনি- এসব একটু আধটু হয়ই মানিয়ে নে। এজন্যই হয়তো কারো প্রিয় হতে পারিনি। ছেলেবন্ধু বেশি বলে চরিত্র খারাপ এও শুনতে হয়েছে। আমি পজিটিভ মাইন্ডের এবং বন্ধুভাবাপন্ন বলে আমাকে কখনো কখনো সস্তাও ভাবা হয়েছে। “লজ্জা নারীর ভূষন” এ বাক্যে আমি কখনো বিশ্বাসী ছিলাম না বরং নারীদের হতে হবে সাহসী এবং স্পষ্টবাদী এই থিওরিতে জীবন যাপন করেছি। সেজন্য আমার বিয়েসাদী এবং সংসার হবেনা শুনতে হয়েছে।

আমি বেশ রাগী এবং জেদীও।

মেয়ে মানুষের এত রাগ ভালো না। এত জেদ ভালোনা। “মেয়েরা রাগে বেশ্যা হয়” কম শুনিনি এই কথা। ছোটবেলায় ক্রিকেট ফুটবল খেলতে চাইতাম বলেও কথা শুনতে হয়েছে- এসব তো ছেলেদের খেলা, কেন তুমি খেলবে? তবুও খেলেছি। অনেকেই কটু কথা বলেছে। পাত্তা দেইনি। আমি রান্না করতে পারি এ কথাও অনেকে যেন বিশ্বাস করতে চায়না। তাদের মস্তিষ্কে এই ভাবনা ঢুকানো আমার মত উড়াধুরা চঞ্চল স্বভাবের মেয়েরা নাকি রান্নাবান্না এবং ঘরের কাজ কিছুই পারেনা। অথচ আমি খুব ভালো রাধুনী এবং ঘরদোর সামলানোর কাজটা ভালোই পারি। বাইরের দুনিয়ায় মেতে থাকা মেয়েরা নাকি ঘরের কাজে মনোযোগী হতে পারেনা। আমি পারি সবই। তবে আমি কোনটা করব বা করতে চাই সেটা আমার চয়েস। আমার যদি ভালো লাগে একটু এলোমেলোভাবে চলতে আমি চলব। মেয়ে হয়েছি বলে ১০০% পরিপাটি কেন হতে হবে আমার? আমি সমাজকে দেখানোর জন্য জীবন যাপন করছিনা, নিজের জন্য করছি। আমি নিজে ভালো থাকতে চেয়েছি আগে যেকোনোভাবেই।

আর আমার প্রেমিকদের কথা? প্রথমে তারা আমার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেও একটা সময় এসে আমার মাঝে খোঁজে মেয়েলি ন্যাকামি স্বভাব। আমি তেলাপোকা কেন ভয় পাইনা? কেন আমি রাতের বেলা একা একা হরর মুভি দেখি? এসব নাকি অস্বাভাবিক। কোন ছেলেবন্ধুকে যতবার বলেছি ভালো কোন হরর মুভি সাজেস্ট কর। তারা হেসে দিয়ে বলেছে, আরেহ তুইতো ভয় পাবি। আমি যতবার বলেছি আমি ভয় পাইনা, তাদের যেন কথাটা বিশ্বাস হয়নি। কেন ভয় পাওয়াটা জরুরি? ভয় না পেলে আমি অগ্রহণযোগ্য?

তারপর আমি কনসার্টে কেন যাই? কেন যেতে চাই? কনসার্টে কি মেয়েরা যায়? তারপর, আমি টং এ কেন চা খাই, মেয়েরা কি টং এ চা খায়?

আরো কত কি! মোট কথা তথাকথিত সমাজের তৈরি করা ‘আর্দশ মেয়ে’র বৈশিষ্ট্য নিজের মাঝে ধারণ করতে পারিনি আমি, বরাবরই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে খারাপই হয়ে এসেছি, যেখানে আমি কখনো কারো ক্ষতি করিনি। কারো খারাপ চাইনি, খারাপ চিন্তাও করিনি। বরং মানুষের ভালোর জন্য কাজ করেছি। এতটুক গর্ব করে বলতে পারি আমার দ্বারা কারো কখনো ক্ষতি হয়নি এবং মানবচরিত্রের এমন কোন ক্ষতিকর স্বভাবও আমার মাঝে নেই যাতে অন্যের কোন অসুবিধা হয়। তবুও আমি ভালো নই। আমি নাকি পুরুষালি স্বভাবের এ কথা আমার মায়েরই বলা। কি অদ্ভুত না?

আমি যতই সফল হই, যা-ই করি, তারপরও আমার এই কথাগুলো শোনা লাগে যে আমি বাড়াবাড়ি করি, আমি বেয়াদব গোছের, ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণ সেই যে আমি ন্যাকা নই, আমি প্রতিবাদি, আমি স্পষ্টবাদী, আমি কারো উপর নির্ভর করতে পছন্দ করিনা।

নারী হয়ে জন্মে কষ্টের অভিজ্ঞতা কী বলব? একটু আলাদা হওয়ার কারণে পুরো জীবনটাই তো ছোট বড় কষ্টের অভিজ্ঞতা দিয়ে ভর্তি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]