September 20, 2024
সাহিত্যগল্প

কাঁটাতারের বেড়া

প্রমা প্রদীপ্তি।।  “এই বান্টি, তোর মোবাইল থেকে একটা ম্যাসেজ পাঠাতে দিবি?” – সবার চোখ লুকিয়ে রিনি জিজ্ঞেস করলো বান্টিকে। শুনে, ভয়ে প্রায় কুপোকাত হয়ে যাওয়ার অবস্থায় বান্টি চারপাশটা সন্তপর্ণে দেখে নিলো।

রিনিকে বললো, “ না, না!! তোকে মোবাইল দিলে মামা-মামী যদি আমাকে বকে দেয়, তখন?” হতাশাগ্রস্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না রিনি, পাল্টা জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি জানিস না ওরা আমার ল্যাপটপ, মোবাইল সব নিয়ে রেখেছে? জোর করে আমাকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসলো, তার উপর এক সপ্তাহ ধরে ঘরবন্দী করে রেখেছে আমাকে, তার উপর জোর বিয়ে ঠিক করে ফেলছে ওরা আমার মতামত না নিয়েই, এইটুকু হেল্প কি করবি না?” ভীত বান্টির চেহারায় একটু মায়া দেখা দিলো এইবার। “শোন, তুই রুমকির মোবাইল থেকে ম্যাসেজ পাঠা, যেখানে যেখানে পাঠাবি, আমি রিচার্জ করে দিচ্ছি”, বান্টির মুখ থেকে একথা শুনে আশ্বস্ত রিনি জলদি চারপাশ দেখে অন্য দিকে সরে গেলো।

বাইরে বৃষ্টি, মাথা ব্যথা করা ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়ছেই সেই দুপুর থেকে।

হাঁটতে হাঁটতে আঙুলের কোণায় রাখা চিরকুট আবার দেখলো রিনি। চিরকুটে লেখা একটি মোবাইল নম্বর, এই মোবাইল নম্বর এর মালিকের সাথেই রিনির পরিবার রিনির বিয়ে ঠিক করতে যাচ্ছে। ভদ্রলোক এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক। এই লোককে রিনি সেই শুক্রবার দেখা করানোর দিনই জানিয়েছে যে সে পাশ করলেও এখন এসব বিয়ে করবে না, নিজেকে নিয়ে ভাববে। আশ্চর্য! লোকটা তারপরও বিয়ের জন্য দিন ঠিক করতে চায়! এই লোক কি তাকে সম্পত্তি ভাবলো? ভাবতেই রাগে আর জেদ চেপে গেলো রিনির। যে করেই হোক এই লোককে একটা কড়া কথা লিখতেই হবে। কিন্তু মোবাইল ম্যানেজ হবে তো?  এই এক বিয়ের সম্বন্ধ আসার পর সবার মাথা খারাপ, এইখানেই নাকি বিয়ে দিতে হবে। রিনি রাজি না বলে তার মোবাইল, ল্যাপটপও নিয়ে ফেলা হয়েছে, যেন কাউকে কিছু জানাতে না পারে। এরা সবাই এমন কেন, বৃষ্টি দেখতে দেখতে আনমনে ভাবতে থাকে সে।

রিনির অনার্সের রেজাল্ট তার বের হয়েছে কিছুদিন আগেই। এখন সে চাকরি করতে চায়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। করিডোর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে ছোটবেলায়, স্কুল আর কলেজে পড়া অবস্থায় তাকে নিয়ে মা, বাবার চিন্তিত মুখ মনে পড়লো রিনির। প্রতি পরীক্ষার আগে, প্রতি রেজাল্টের সময় মা-বাবার কী উৎকণ্ঠা থাকতো রিনির ভালো রেজাল্টের জন্য! স্কুলের দশ বছরের প্রতি  ‍শুক্রবার থাকতো তার ড্রয়িং আর গানের ক্লাস। মা, বাবার সে কি দৌড়াদৌড়ি পড়ে যেতো তাকে ঐসব আর্ট ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য! ওইসব ব্যস্ততার দিনগুলো কি তাহলে কেবলই তাকে শিক্ষিত করার ভনিতা ছিল? এখনের এই জোর করে বিয়ে দেয়ার জন্য কি ওইসব দিনগুলো মঞ্চনাটকের স্টেজ তৈরির অংশ ছিল? নিজের স্বাধীনতাই যদি না থাকে এত পড়ালেখার কী মানে? কোচিং, স্কুল, কলেজে ভর্তি করাতে বাবার ঘাম, পরীক্ষায় তার নিজের সাথে মায়ের রাত-জাগার কী অর্থ তাহলে? অন্য একটা লোকের ওপরেই যদি তার দায়িত্ব আর স্বাধীনতা তুলে দিতে চায় রিনির বাবা-মা, ওনারা এত কষ্ট করলেন তাহলে কেন! মানুষ হিসেবে ওর মূল্য তাহলে কোথায় দাঁড়ালো???

প্রশ্নরা সব ঘুরেফিরে আসে , আবার বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়ায় মিলিয়ে যায় …

সন্ধ্যা নামলো। বাবা এসে জানালো, রিনি যেন ভদ্রলোককে ফোন দিয়ে জানান, রিনির পরিবার পারিবারিকভাবে বিয়ের কথা বলতে চায়। সেজন্য তার হাতে একটি ফোন দেয়া হলো। যথারীতি ফোন করার সময় রিনিকে কড়া নজরদারিতে রাখা হলো যেন দরকারের বেশি নিজের কোনো কথা রিনি প্রকাশ করতে না পারে!

এসব “পারিবারিক কাজ” সম্পাদন শেষে রিনি গেলো রুমকির কাছে। আশেপাশে খালি, বাবা,মা, ফুফু সবাই আড্ডা দিচ্ছে ভবিষ্যত বিয়ের পরিকল্পনায়। মানুষজন আপন না পর, ভালো চায় না মন্দ চায় – মাঝেমাঝে বোঝা খুব মুশকিল, চকিতেই ভাবলো রিনি। যাহোক, মনোযোগ আবার বর্তমানে ফেরত আসলো। রিনিকে ইঙ্গিত দিতেই রুমকি জিজ্ঞেস করলো, “বলো, এই লোককে কী লিখতে হবে?” লেখার ধরণ গুছিয়ে দিয়ে রিনি জানালার ধারে বসলো। দুই সপ্তাহ আগের সেই শুক্রবারের কথা মনে পড়লো যেদিন তাকে না জানিয়ে পাত্র-পাত্রী দেখার পর্ব সম্পাদনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওইদিনের সবগুলো লোকের খাওয়া তার বাবা একা ফুড কোর্টের রিসেপশন থেকে টেবিলে এনে দিচ্ছিলো, কারণ পাত্রীর বাবাকে নাকি সবসময় পাত্রপক্ষের সেবা করতে হয়! ভাবতেই রিনির হাত, পা গরম হয়ে গেলো। “শোন ওই লোককে ফেসবুকেও কিছু কড়া কথা লিখে মেসেজ পাঠাতে হবে” – রুমকির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে সে নিজেই ঝড়ের বেগে লেখা শুরু করলো …

……………………………………………

তিন বছর পর

মা বাবাকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ রিনির সেই ঝড়ো দিনের কথা মনে পড়লো। সেদিন রিনির কড়া কথায় ভদ্রলোক খুব লজ্জিত হয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন। উনি নাকি জানতেনই না রিনিকে আটকে রেখে বিয়ে দেয়া হচ্ছে! অথচ রিনি স্পষ্ট করে প্রথম দিনই বলেছিলো, শুনুন আমাকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে, আমি রাজি নই! তিন বছর পর বাসায় তার অবস্থান অনেক পরিবর্তন হয়েছে, ‘মেয়ে’ থেকে মানুষের সম্মান সে আদায় করেছে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তবে অন্য মেয়েদের একই অভিজ্ঞতা এখনো যখন শুনতে পায়, তখন মনটা হুহু করে ওঠে। কেন সবসময়ই “মেয়ে/মহিলা” – শব্দে আটকে যেতে হয় এই সমাজের মেয়েদের- এই প্রশ্নের উত্তর কি সে কোনোদিন পাবে?