November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বউকে উপার্জন করতে না দেয়া সুপারহিরোদের প্রতি…

রেহমান মুস্তাফিজ।। এইটা একটা গ্লোরিফাই করা ছবি। পুরুষ দিবসের দিন থেকেই শত শত লোকের ওয়ালে দেখছি এটা। কেন গ্লোরিফাই করা সেটা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতেই বলি৷ এই যে ছবিতে দেখা যায় একজন কর্মক্ষম পুরুষের কাধে বাবা, মা, বউ বাচ্চাসহ সকলকে চালানোর দায়িত্ব নিয়ে পুরুষকে এই সুপারহিরো হতে  কে বলেছে? সে নিজেই সমাজে বা পরিবারে সকলের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে অনেকটা জোর করেই এই দায়িত্ব নিয়েছে। না এইটা মনগড়া কিছু বলি নি আমি। দুইটা ব্যক্তিগত ঘটনা শেয়ার করি এই প্রেক্ষিতে।

আমার এক পরিচিত বড় ভাই আছেন। মোটামুটি বড় বেতনের জব করেন। উনার পরিবারও অনেক  সচ্ছল। অনেকটা উচ্চ মধ্যবিত্ত যাকে বলা হয় সেটাই । তো উনার বিয়ের জন্য কম করে হলেও ৫০ জন মেয়ে দেখা হয়েছিলো৷ শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়া প্র্যাক্টিসিং এক ডাক্তার মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। মাস দুয়েক পর থেকেই দেখি ভাবি বাসায় থাকে। একদিন কথায় কথায় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ভাবি কি আর প্র্যাক্টিস করে না? জবাবে বলছিলো, না। কারণ তাকে ঘরেই বেশি প্রয়োজন। তখন আবার বলছিলাম যদি গৃহিনীই চাচ্ছিলেন তবে আর শুধু শুধু ডক্টর খুঁজে বিয়ে করলেন কেন? এই প্রশ্নের জবাবটা ছিল খুবই শকিং। বলেছিলো ডক্টর দেখে তো বিয়ে করেছে তার স্ট্যাটাস অনুযায়ী পারফেক্ট ছিল বলে। উনার তো বউয়ের নামটা দরকার যেন গর্ব করে পারিবারিক বা সামাজিক গ্যাদারিং-এ বলতে পারে বউ ডাক্তার। বউয়ের কামাই তো দরকার নেই।

আমার ফুপি-ফুপা দুজনই স্কুলের টিচার। আঙ্কেল এক সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বর্তমানে। আগে সাধারণ শিক্ষকই ছিলেন৷ বাংলাদেশে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন কেমন থাকে সেটার ধারনা কম বেশি সকলেরই আছে। কিন্তু এখানে কথা হচ্ছে আঙ্কেল যদি কখনো স্বীকার নাও করেন তবুও উনি জানেন আমার আন্টি উনার জন্য ছিলো বিশাল রিলিফ। রিলিফ কেন বলি, আমার দুই ফুপাতো ভাই মনে হয় না কোনোদিন বলতে পারবে তাদের প্রয়োজনের কোন জিনিস তারা তাদের বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। কারণ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় বা লাক্সারি যতখানিই আঙ্কেল আন্টির মাধ্যমে পূরন করা যেত তার পুরোটাই আসতো আন্টির পক্ষ থেকে। আর আঙ্কেল সংসারে বাসা ভাড়া তেল নুনের যোগান দিতেন। এভাবেই দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় সারা জীবন তাদের সংসার চলছে।

এখন প্রথম ঘটনাটার মত যদি আমার আঙ্কেলও চিন্তা করতেন, আমি তো শুধুমাত্র সমাজে আমাকে বড় করে দেখাতেই শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করে এনেছি তাহলে আর যতখানিই স্বচ্ছল ভাবে উনাদের সংসার চলছে ততখানি কোনোভাবেই সম্ভব  হতো না। হয়তো ওনার দুই ছেলেই হয়তো এখন যেভাবে জার্মানিতে পড়াশোনা করছে সেটাও হয়তো হতো না তখন৷

আমি বলছি না আপনারা আপনাদের পরিবারের সদস্য, বয়স্কদের দেখাশোনা না করুন। অবশ্যই তাদের দেখাশোনা করুন। কিন্তু আপনার পরিবারে যদি অন্য কোনো উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থাকে এবং সে উপার্জন করার মত যোগ্যও হয় তাহলে তাকে উপার্জন করতে দেয়াও উচিৎ। জোর করে নিজেকে সুপারহিরো বানিয়ে আবার সেটার ক্রেডিট চাওয়া তো উচিৎ নয়, তাই না?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বলি। আমাদের দেশে যদি আমরা মনে করে ২৫ বছর থেকে উপার্জন করার মত বয়স তবে ২৫-৬৫ বয়স পর্যন্ত জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৭% মাত্র। দেশে নারী এবং পুরুষের অনুপাতও অনেকটা সমানই। ধরেন ৪৭ এর অর্ধেক করে দিলাম, এখন তাহলে সংখ্যাটা ২৩.৫% দাঁড়ায়। এই ২০২০ সালে এসেও যার মাত্র ৮% এর মত কাজ করে। তার মানে বাকি ১৫% কিন্তু বেকার। আর যদি ১৫ বছর বয়স থেকে ৬৫ পর্যন্ত উপার্জনক্ষম ধরি তাহলে নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২% এর মতো মাত্র। সাথে যোগ করুন পুরুষের অনুপাত ৩৩.৫। যা শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষ সকলে মিলে মাত্র ৪২% মানুষ ১০০ ভাগ মানুষের বোঝা টানছে।  সাথে এটাও জানিয়ে রাখি বর্তমান বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে প্রতি আড়াই জন পুরুষের বিপরীতে মাত্র একজন নারী কাজ করে। যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রতি .৯৭ জন পুরুষের জন্য রয়েছে ১ জন নারী! সংখ্যাটা অবাক করে না?

কিন্তু এই যে এতগুলো ম্যানপাওয়ার দিনের পর দিন বছরের পর বছর আমাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেই দোষ কার? এটা কি শুধু একা সরকারের দোষ, নাকি তার বেশ কিছুটা উপরের ছবির সেইসব স্বঘোষিত সুপারহিরোদের উপরও বর্তায়? ভাবুন। ভেবে দেখুন এইবার।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]