ইস্যুটি ‘সিগারেট’ নয়, অন্য কিছু
শারমিন শামস্।। নারীর সমস্যা একটা বা দুইটা না। নারীর জন্মমুহূর্ত থেকে মৃত্যু অবধি লড়াই জারি থাকে। এই লড়াইয়ের ইস্যুগুলোর কোনোটা থেকে কোনোটাকে আপনি ক্ষুদ্রতর করে ভাবতে পারবেন না। সমস্যাগুলো একেক শ্রেণিতে একেক পরিস্থিতিতে প্রত্যেক নারীর ব্যক্তিত্ব, আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা ও শক্তি সাহসের ওপর নির্ভর করে। যে সমস্যাটি একটা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল নারীকে সহজেই কাবু করে দেয়, আত্মনির্ভরশীল রোজগেরে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নারীর ক্ষেত্রে সেটি তেমন সমস্যাই নয় হয়তো। আবার শিক্ষা, বেড়ে ওঠা, ব্যক্তিত্বও সমস্যার রকম পাল্টে দেয়। অনেক নিম্নবিত্ত নারীও যে সমস্যায় মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারে, অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীকে দেখেছি সেই একই সমস্যায় পুরুষতন্ত্রের পায়ে নিজেকে সপে দিয়ে হার মেনে নিতে।
তাই আপনি যখন ধূমপানের জন্য কোনো নারীকে নারী হবার কারণে হ্যারাজড হতে দেখেন, সেই সমস্যাটাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নাই। আপনি বলতে পারেন না যে, ধূমপান করা নিয়া এত কেন মাতামাতি করতে হবে, নারীবাদের গুরুত্ব এতে কমে যাবে, আরো বড় বড় ইস্যু আছে ইত্যাদি। কেন বলতে পারেন না? বলতে পারেন না, কারণ এই হ্যারাজমেন্ট ইস্যুটি ধূমপানে নয়, ইস্যুর উৎস অনেক গভীরে, এর প্রভাব গভীরে, এর কারণ ও প্রতিক্রিয়াটি গভীরে। রাস্তায় বসে মেয়ে সিগারেট খাইতেছিল আর এক ব্যাডা এসে ধমকাইসে, এইটা কোনো ইস্যু না এত চিৎকার করার, কারণ অনেক নারী কোনোখানে খাইতে পায় না, কোনোখানে পরতে পায় না ইত্যাদি ইস্যুগুলারে আপনার বড় ইস্যু লাগে। দুঃখিত, তাইলে প্রকৃত অর্থে আপনি এই সমাজের আপামর নারীর যন্ত্রণার ছিটেফোটাও স্পর্শ করতে শিখেন নাই।
ধূমপান, বিড়ি, সিগারেট- এসব তো মামুলি ব্যাপারই। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদটা কোথায় তবে? একটি মামুলি সিগারেট একটি উচ্চশিক্ষিত মেয়ে, একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, একটি স্বনির্ভর মেয়ে নিজের ইচ্ছেয় পান করতে পারেন না। অথচ একটি একই অবস্থানের পুরুষ সেটি পারেন। পুরুষ শুধু ধূমপান নয়, প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ, নিম্নাঙ্গ চুলকানোর মত অসভ্য কাজও দেদারসে করে যেতে পারেন। আর ধূমপান তো অহরহই পারেন। তাহলে নারী কেন পারেন না?
নারী কেন পারেন না, কিংবা নারী পারলে তাকে কেন সংঘবদ্ধভাবে হয়রানি ও অপমান করা হয়, সেটিই চিন্তার জায়গা। একটা গণতান্ত্রিক সমাজে, একটি তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজে, একটি নারী অধিকার সচেতন সমাজে বারেক ও তার সহযোগী পুরুষদের মত পুরুষেরা, এবং তাদের সমর্থণ দিয়ে যাওয়া নারী পুরুষেরা কীভাবে কোন্ সাহসে একজন ব্যক্তিকে তার লিঙ্গের কারণে প্রকাশ্যে অপমান করবার সাহস পান, সেই অপমানকে জাস্টিফায়েড করতে নানান ছুতোনাতা হাবিজাবি বলার নির্লজ্জতার চর্চা করেন, সেটিই ভেবে দেখবার। তাহলে কি নারী পুরুষ এই দেশে সমান মর্যাদার নাগরিক নন? তাহলে কি নারীর অপরাধ ও পুরুষের অপরাধের মাপকাঠি আলাদা? তাহলে কি নারীর যাপন পুরুষের যাপনের মত হতে নেই?
এই জায়গাটিই মূল জায়গা। এই মূল জায়গাটি থেকেই আর সব জায়গার নগ্ন চেহারাটা বেরিয়ে আসে। এই অসভ্য বৈষম্যের রূপটাই সমাজের সমস্ত স্তরে উৎকট দাঁত বের করে হাসতে সাহস পায়।
জায়গাটি চিনতে শিখুন। নারীর কোনো লড়াই-ই ক্ষুদ্র নয়। সব নারীর সমস্ত লড়াই সমান বেদনার, কষ্টের এবং যন্ত্রণার।