একা পথ চলতে অনেক দম লাগে
জিনাত নেছা।। বাংলাদেশের মত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই তন্ত্রের ধারক ও বাহক একাধারে পুরুষ ও নারী উভয়ই। অবশ্য এই ধারক বাহক হয়ে ওঠার কারণ হলো যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে,সংস্কৃতিতে, প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুর মধ্য দিয়েই বিরাজমান এই পুরুষতন্ত্র আমাদের মানসিকতায় গেঁথে গেছে একেবারে শিকড়ে, যা থেকে বের হয়ে আসতে কাঠখড় পোহাতে হবেই, এটাই স্বাভাবিক।
এখনো বাড়িতে গেলে ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে বাড়ির মেইনগেট আমাকে অতিক্রম করতে দেয়া হয়না। এটা আমার মায়ের কড়া আদেশ। লোকে খারাপ বলবে।বলবে অমুকের মেয়ে চাকরি করে, বাইরে থাকে কিন্তু ভদ্রতা শেখেনি, বখে গিয়েছে। তার উপর যদি সেই মেয়েটি ডিভোর্সি হয় তাহলে তো লোকজনের ষোলকলাপূর্ন।আলোচনার এক বিশাল টপিক পাওয়া গিয়েছে যা দিয়ে অনায়াসে বছরের পর বছর পার করে দেয়া যাবে।
সত্যি আমি খুব অবাক হই এই ছয় বছরে ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে আমাকে বাদ দেয়া হয়নি। সেটা পরিবার, সমাজ, আত্মীয়-স্বজন,বন্ধুবান্ধব, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি, এমনকি ফেসবুকের মত স্যোসাল মিডিয়াতেও। এগুলো যা বললাম সবই আমাদের সমাজে ডিভোর্সি একজন নারীর বাস্তবতা। প্রতিনিয়ত আপনাকে এই সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই টিকে থাকতে হয়, হচ্ছে।
একজন একা নারীর ম্যাসেঞ্জারের সবুজ বাতিটা ১২টার পর যদি জ্বলতে থাকে তাহলে দেখবেন অন্যেরও জ্বলুনি শুরু হয়ে গেছে। ‘‘আপা,কি করেন, ঘুমাবেন না, ঘুম আসছেনা, এতো রাত জাগবেন না, শরীর খারাপ করবে” ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্নে আপনাকে জর্জরিত করবে। আর এক শ্রেণি আছে যারা আরো এক ধাপ বেশি কৌতুহলী। ‘‘আপা, এত বছর কেমনে একা থাকেন, খারাপ লাগেনা আপনার, বিয়ে করছেন না কেন, একটা বিয়ে করে ফেলেন”- এররকম কিছু উপদেশ আপনাকে দিতে থাকবে। আরে আবালের দল, একজন একা নারী কেমনে একা থাকে, কেমনে একা চলে এটা যদি তোদের মত আগাছারা বুঝতো তাহলে এসব প্রশ্নগুলো তৈরি হতোনা। এভাবে একা নারীদের হেনস্তা হতে হতোনা। এজন্য দম লাগে দম। একা পথ চলতে বড্ড দম লাগে। এগুলো তোদের মত আবালদের মস্তকে ঢুকবেনা।
একজন ডিভোর্সি নারীর শুভাকাঙ্ক্ষীর কিন্তু অভাব হয়না। আপনি যদি বলেন আপনি ডিভোর্সি বা সিংগেল মাদার, আপনার দিকে একরাশ করুণা নিয়ে মনটাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার লোকের অভাব নাই এই সমাজে, তা নিরক্ষর থেকে শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিতও বটে। যেন একজন “লোক” যার সাথে আপনি সংসার করতে না পেরে পৃথিবীর সবকিছু হারিয়েছেন, আপনি পুরো ব্যর্থ একজন মানুষ। এরপর আপনাকে বলবে,”আহা! মা! একজন সন্তান আছে, একটু মানিয়ে চলতে পারোনি!” যেন জন্মজন্মান্তরে মানিয়ে চলা, মেনে চলার দায়িত্ব নিয়েই নারী জন্মাইছে।
আপনি পথ চলতে গিয়ে এ ধরনের শুভাকাঙ্ক্ষী পথেঘাটে, পরিবারে,আত্মীয়-স্বজন,অফিস সব জায়গায় পাবেন। যারা কিনা গভীর রাতের প্রেমিক পুরুষ হয়ে আপনার ম্যাসেঞ্জারে টুং টাং, চি চি করতে থাকবে। ইনিয়ে বিনিয়ে ‘‘বউয়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ, বউ অসুস্থ, কেমন জানি আর আমার সাথে সেক্স করতে চায়না এমনকি আমরা অনেক বছর যাবত সেপারেশনে থাকি’’- নানান রকমের ম্যাসেজ আপনার ম্যাসেঞ্জারে আসতেই থাকবে। কিন্তু আপনি যদি কোনটার রিপ্লাই না করেন কিংবা সোজা ব্লক করেন তবে পুনরায় ফেইক আইডি খুলে আপনাকে জ্বালাতন শুরু করে দেবে। আর যদি কোন কিছুতেই কোন কাজ না হয় তাহলে দেখবেন এই পুরুষরায় একেবারে ভালো মানুষ সেজে আপনার চরিত্র হননে লেগে পড়বে। আপনার নামে বাজে বাজে কথা বলবে, আপনার স্টাটাসে আজেবাজে কমেন্ট করবে। এই হলো এদের চরিত্র।
আমি খুব অবাক হয়ে যাই পুরুষের এই চরিত্রে। আরে ভাই নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজের বউকে কেন অসম্মান করছেন? বউতো! অন্তত এতটুকু সম্মান দেন তাকে। অন্য কারো সাথে কথা বলার সময় অন্তত নিজের বিয়ে করা বউকে অসম্মান করবেন না। এই ক্ষেত্রে একই সময়ে দুজন নারী আপনার হাতে হেনস্তার শিকার হচ্ছে। আপনি যখন কোন নারীকে রাত ১২টার পর এসব লিখছেন, আমি জানি আপনার এক হাত থাকে শিশ্নে আর অন্য হাত থাকে মোবাইলের টাইপ অপশনে।। ধিক আপনাদের ধিক!!
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে একজন ডিভোর্সি নারী আর সে যদি হয় একা মা, তাহলে তো কথাই নেই, আরো কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথম প্রতিবন্ধকতা শুরু হয় পরিবার থেকে। ‘‘কী দরকার ছিলো ডিভোর্সের! মানিয়ে নে! সন্তানের জন্য অন্তত’’! তা আপনার এক্স স্বামী আর ১০ টা বিয়ে করুক কিংবা অন্য নারীর সাথে পরকীয়া করুক, নেশা ভাং করুক কিংবা আপনাকে হরদম পেটাক তাতে কোন সমস্যা হয়না কিন্তু পরিবারের লোকজনদের। সন্তান আছে তাই যেনতেন প্রক্রিয়ায় সংসার টিকিয়ে আপনাকেই রাখতে হবে। আর যদি সকলের মতের বাইরে গিয়ে আপনি একা চলতে শুরু করে তাহলে আপনি একজন “খারাপ”, “চরিত্রহীন” নারী বলে পরিবার, সমাজ সকলের কাছে সিল সমেত পরিচয়পত্র পেয়ে গেলেন।
একটা ছোট উদহারন দেই, ধরুন আপনি কোন আত্মীয়, নারী বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেছেন, কোনো কারণে রাত্রি নিবাস করবেন কিংবা তা নাও করলেন। কিন্তু আপনার সেই নারী বন্ধুটি কিংবা আত্মীয় আপনাকে চোখে চোখে রাখবে আপনি যদি তার স্বামীকে ভাগিয়ে নিয়ে আসেন! অনেক সময় তো বলেই ফেলেন, “ও যেন আমার বাড়িতে না আসে, আমার সংসার ভাঙ্গবে।”
এসব বাস্তবতায় এখন আর কষ্ট হয়না বরং করুণা হয়, কারণ এর মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের লেভেল, বিশ্বাস কী! আর এর চাইতে ভাই বোনলোগ ঐ ডিভোর্সি একা নারী অনেক অনেক গুন ভালো আছে, বিশ্বাস করুন। সে তার স্বাধীনতার চর্চা করতে পারছে। অন্তত আপনাদের মত মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বেচে নেই যে, কখন আমার স্বামী আমায় ছেড়ে চলে যাবে!
আপনি একজন ডিভোর্সি নারী, কোথাও বাসা ভাড়া নেবেন! অসম্ভব কেউ আপনাকে দেবে না, বিশ্বাস করুন এই ক্ষেত্রে একজন স্বামী থাকা আপনার চাই-ই চাই! যেন স্বামী না থাকা এক ধরনের পাপ! কোনোভাবে যদি একটা বাসা আপনি পেয়েও যান তবে কে বাসায় আসছে আর কে যাচ্ছে সেই গোয়েন্দাগিরির জন্য শার্লক হোমসের দরকার হবে না, পাশের ফ্লাটের ভাবি/আন্টি এই দায়িত্ব নিজ থেকেই নিয়ে নেবে।
এতো কিছু উৎড়িয়ে আপনি যদি একটু ভালো থাকতে চান, আবারো নতুন করে ভাবতে চান, সেটাও অন্যায়, পাপ, ট্যাবু। কেন একজন ডিভোর্সি নারীর বন্ধু থাকবে, কেন কোথাও ঘুরতে যাবে, কেন একটু হেসে ছবি ফেসবুকে দেবে, কেন চেহারাটা একটু সুন্দর হয়েছে! নিশ্চয়ই প্রেম করছে আবার! সোজা কথা আপনি ডিভোর্সি আপনি যা করবেন সমাজের তাতেই মানা, তাতেই বাধা, আপনি কিছুই করতে পারবেন না। আর এসব কিছুর প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে পথ চললে আপনি হয়ে যাবেন চরিত্রহীন, খারাপ, বেশ্যা।
আর এই তকমা নিজের শরীরে, মননে সেটিয়ে আপনি নারী, পথ চলতে কতটুকু দম লাগে, তা শরীরের দম বলুন আর মনের দম, তা কি কেউ কখনো ভেবেছে? ভাবেনি। আমাদের সমাজে এসবের বালাই নাই। জানে শুধু আপনাকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামাতে। আপনার চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করতে!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]