আশালতা বৈদ্য: বঙ্গবন্ধুর ‘বুড়ি’ যখন মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নারী কমান্ডার
রেহমান মুস্তাফিজ।। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। যাকে স্মরণ করতে গেলে শুরুতেই মাথায় আসে ‘‘৩০ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ (যদিও প্রকৃত সংখ্যাটা এরও অনেক উপরে) মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই দেশ’’। যে বীভৎসতা বুঝাতে লন্ডন টাইমস ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নিজেদের পাতায় লিখেছিলো-
If BLOOD is the price of INDEPENDENCE, then BANGLADESH has paid the highest price of history.
এতটাই বীভৎস আর ভয়ানক ছিল আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জনের দুঃখময় পথটা। আসছে আমাদের আরেকটা বিজয়ের বর্ষপূর্তি। আমরা আমাদের স্বাধীনতার সকল বীরত্বগাথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবো। কিন্তু বরাবরের মত হয়তো অগোচরে থেকে যাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা আমাদের নারী মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধে নারী শব্দটা শুনলেই আমরা ধারনা করে বসি বীরাঙ্গনা। কিন্তু বীরাঙ্গনা ছাড়াও দেশের আনাচে কানাচে অনেক নারী বীর মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন, যারা পুরুষের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে রনাঙ্গনে এঁকেছেন নিজেদের বীরত্বগাথা। প্রয়াত তারামন বিবি মায়ের কথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। আজ তাই এমন আরেকজন নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা বলতে চাই। যিনি রনাঙ্গনে যুদ্ধ করেও রয়ে গেছেন পর্দার আড়ালে আনসাঙ হিরো হয়ে। যাকে যুদ্ধের পর সইতে হয়েছে অনেক বঞ্চনা। যাকে সমাজ বা দেশ কখনোই তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয় নি।
আশালতা বৈদ্য – মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নারী কমান্ডার
১৯৫৬ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী স্কুল শিক্ষক হরিপদ বৈদ্য এবং গৃহিণী সরলাময়ী বৈদ্যের ঘর আলো করে জন্ম হয় তাদের প্রথম মেয়ে আশালতার। বঙ্গবন্ধুর গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় জন্ম। তাই পারিবারিকভাবেই ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক। ছোট থেকেই তার পারিবার তার ভেতর রাজনৈতিক সচেনতনা তৈরি করে দেয়। ১৯৬৮ সালের গণ ছাত্র আন্দোলনে ছিলেন একজন পরিচিত মুখ। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু জেল থেকে একবার ছাড়া পেয়ে কোটালিপাড়া আসলে সেখানে অন্য আর ছাত্রদের সাথে বক্তব্য রাখেন আশালতা বৈদ্যও।
১৯৭১ সালের মে মাসের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা প্রায় পুরো বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ দখল করে নেয়। চালাতে থাকে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ। এ থেকে বাদ যায় নি কোটালিপাড়াও। আশালতার বাকি দুইবোনই ততদিনে যুবতী। সে সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের এদেশীয় দোসরদের লোলুপ দৃষ্টি পরে আশালতা ও তার দুই বোনের দিকে। আশালতার বাবা কিছুটা অর্থশালী ছিলেন বলে আলবদররা তার বাবার কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা দাবি করে। আর টাকা দিতে না পারলে যেন নিজের তিন মেয়েকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এক সপ্তাহের সময় দেয়া হয় হরিপদ বৈদ্যকে। হরিপদ বৈদ্য কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। একবার মনে হয় ইন্ডিয়া চলে যাবেন আবার নিজের ভিটে মাটি নিজের দেশ ছেড়ে যেতেও মনে সায় দেয় না। মেয়েদের রক্ষার চিন্তায় হরিপদ বৈদ্য ঠিক করেন তিনি ইন্ডিয়ায় চলে যাবেন। দেশ, দেশের মাটি বাপের ভিটে সব হারিয়ে গেলেও অন্তত মেয়েরা তো নিরাপদ থাকবে।
হরিপদ বাবুর এই দুঃসবাদ একান সে কান হতে হতে পৌছে যায় হেমায়েত বাহিনীর প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন (বীরবিক্রম) এর কানে। তিনি এক রাতে হরিপদ বাবুর বাড়িতে আসেন। এসেই তিনি হরিপদ বাবুকে দেশ ছাড়তে মানা করেন। আর আশালতার নিরাপত্তার স্বার্থে আশালতাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কথা বলেন। আশালতা মনে মনে চাচ্ছিলোই যুদ্ধে যোগ দিতে। এবার তাই প্রস্তাব পেয়ে আর মানা করে নি। আশালতার বাবার হাতেও আর কোন উপায় ছিল না রাজি না হওয়া ছাড়া।
আশালতার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয় কোটালিপাড়ার লেবুবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। এখানেই সে সহ মোট ৪৫ জন নারীকে নিয়েই শুরু হয় প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষন। তারপর তিনি প্রশিক্ষন নেন হেমায়েত বাহিনীর আরেকটা প্রশিক্ষনকেন্দ্র কোটালিপাড়ার নারকেলবাড়ি হাইস্কুলে। এখানে নারী পুরুষ সকলের সাথে সম্মিলিত প্রশিক্ষন নেন। তারপর গেরিলা প্রশিক্ষন নেন ভাঙ্গারহাট স্কুল প্রাঙ্গনে। আর সুইসাইড স্কোয়াড প্রশিক্ষণ নেন জহুরকান্দি স্কুলে। সর্বমোট তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন। এই তিনমাসে তিনি ৩০৩ রাইফেল, পিস্তল, গ্রেনেড ও বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেন। তাছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষন, গোয়েন্দাবৃত্তির কৌশল এবং সুইসাইড স্কোয়াড সম্পর্কেও সব ধরনের প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
প্রশিক্ষণ শেষ। এবার সত্যিকারের যুদ্ধ করার পালা। হেমায়েত উদ্দিন ও আরেক মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বাবুর কমান্ডে বিভিন্ন সময়ে আশালতা অনেক সম্মুখ যুদ্ধ করে। যার মধ্যে ঘাগর বাজার যুদ্ধ, কলাবাড়ির যুদ্ধ ও রামশীল পায়শার হাট যুদ্ধ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেহেতু এই অপারেশনগুলো প্রায়ই ছিল হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে আর এগুলোতে আশালতার অবাদানও ছিল ব্যাপক আর তাই তার এই সাহসীকতা লুকানো রইলো না কারো কাছে। তার সাহসীকতা আর অবদানের কারণে তাদের ক্যাম্পের আর ২৪ জন নারীকে নিয়ে হেমায়েত উদ্দিনের আদেশে আলাদা একটা নারী কমান্ডো তৈরি করা হলো। আর যার নেতৃত্ব দেয়া হলো আশালতা বৈদ্যকে। তাদের কাজ ছিল শত্রুর অবস্থান রেকি করা, ছদ্মবেশে গেরিলা আক্রমন করা বা সুইসাইড স্কোয়াড হিসেবে কাজ করা। আশালতাসহ তার কমান্ডের সকলেই সুইসাইড স্কোয়াড হিসেবে কাজ করার জন্য ছিল সদা প্রস্তুত। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আশালতা তার উপর অর্পিত দায়িত্ব এবং নিজ দলের কমান্ড শক্ত হাতেই সামলান।
যুদ্ধে শেষে দেশ স্বাধীন করে এবার ঘরে ফিরে আসার পালা। ঘরে ফিরেও আসেন। শুরুতে সবাই তাকে সম্মান করলেও আস্তে আস্তে চারপাশের পরিবেশ বদলে যেতে থাকে। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে তার সম্মানও নেমে যায়। লোকেরা তাকে কটু কথা শুনাতে থাকে৷ তার নামে কুৎসা রটায়, গঞ্জনা করে। চুপচাপ সবই সহ্য করে গেছেন। এসবের মাঝেই ম্যাট্রিক, ইন্টার, বিএ, এমএ (বাংলায়) পাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন দেশকে পরিবারকে বাঁচাতে অস্ত্র ধরেছিলেন তেমনি পড়াশোনা শেষ করে মানুষের, নারীদের জীবন উন্নয়নে সমাজ সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পরেন। সূর্যমুখী সমাজ কল্যান সংস্থা নামের এক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন সেই ৮০ দশক থেকেই। আশালতা বৈদ্য তার বৈচিত্র্যময় জীবনের সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি শ্রেষ্ঠ মহিলা সমবায়ের প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক, রোকেয়া পদক, প্রশিকা মুক্তিযোদ্ধা পদকসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পান নি কোন রাষ্ট্রীয় উপাধি। সেটা নিয়ে আফসোস না থাকলেও লোকেদের কটু কথায় কষ্ট পেয়েছিলেন ভীষণ। একবার বলেছিলেন- আমরা যখন পুরুষের সাথে সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছি তখন কারো মান সম্মান যায় নি। যখন মা বোনদের রক্ষা করেছি তখনো ছিলাম সকলের কাছে সম্মানীয়। কিন্তু স্বাধীন দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে শুনতে হয়েছে লোকেদের ধিক্কার। নিজের উপরই কেমন এক ঘৃণা জন্মে গিয়েছিলো সে সময়।
এই ছিল মাত্র ১৫ বছর বয়েসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া আশালতা বৈদ্যর গল্প। বঙ্গবন্ধু যাকে ডাকতেন বুড়ি বলে। ৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গোপালগঞ্জের বাকি নেতাদের সাথে এসেছিলেন তিনিও। তার নামের জায়গায় লেখা ছিল “আশালতা বৈদ্য- আপনার বুড়ি”। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলে মাথায় হাত দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “বুড়ি এখনও কাঁদিস কেন? তরা থাকতে আমাকে কি কেউ মারতে পারে”? বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছেতেই বরিশালে মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানে ছাত্রলীগ তৈরি করে সভাপতি হয়েছিলেন। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হয়েছিলেন রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ সভাপতিও। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রাণের মায়ায় লুকিয়ে থাকতেও হয়েছিলো। ১৭ দিন পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন রোকেয়া হলের প্রধান বিল্ডিং এর পাঁচ তলার ছাদে পানির ট্যাংকির নিচে। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর প্রথম যে মিছিলটা হয়েছিল প্রতিবাদের, সেখানেও ছিলেন তিনি। পুলিশের বন্দুকের মুখ থেকে বাঁচিয়ে আনেন তোফায়েল আহমেদ আর আব্দুর রাজ্জাক। তারাই রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, রাইফেলের গুলি করলে আমাদের করবা, মা বোনদের না। লুকিয়ে লুকিয়ে বোরকা পরে এভাবেই কেটেছিলো সে সময়। লুকিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশও করে ফেলেন। তারপর গ্রামে চলে গেলে গ্রেফতার হন গ্রাম থেকে। এভাবেই সংগ্রামে সংগ্রামে কেটেছে একটা জীবন।
এরকম আর অনেক আমাদের বীর রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে। যেমন করুণা বেগম। রাজাকারদের নিকট নিজের স্বামীকে হারানোর প্রতিশোধ নিতে যিনি অস্ত্র হাতে তুলেছিলেন। যদিও শেষ বয়েসে এসে আফসোস করে বলেছিলেন “আমি যুদ্ধে গিয়েও আমার স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। দেশবাসী যেন তাদের ক্ষমা না করে, আল্লাহ যেন এদের ক্ষমা না করেন”। কে বা কারা তার স্বামীকে হত্যা করেছে প্রশ্নে বলেছিলেন “আমি নাম বলে নিরাপত্তা হারাতে চাই না। আমি যুদ্ধে গিয়েও প্রতিশোধ নিতে পারলাম না এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ। এই দুঃখ আজীবন আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে”। নিহত মুক্তিযোদ্ধা স্বামী এবং নিজে আহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুই ভাতা পান। দারিদ্রের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা করুনা বেগমের জন্য সেটা কম হলেও চাওয়া নেই কোন কিছুই। চাওয়া পাওয়ার প্রশ্নে বলেন “যে আশায় যে চাওয়ায় যুদ্ধ করেছি তাতো পেয়েই গেছি। আর কী চাইতে পারি? শুধু চাইতে পারি নতুন প্রজন্ম যেন আমাদের অর্জিত এ স্বাধীনতা ধরে রাখে”।
এলো আরেকটা বিজয় দিবস। এই বিজয় দিবসে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা আমার এ সকল মায়েদের প্রতি।