November 1, 2024
সম্পাদকীয়

পুরুষ পিতৃতন্ত্রের দাস, আর নারী সেই দাসেরও দাস

শারমিন শামস্।। পুরুষতন্ত্র কীভাবে পুরুষের জীবনকে আক্রান্ত করে, আঘাত হানে, নিয়ন্ত্রণ করে, যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়- সেটি বেশিরভাগ পুরুষই টের পান না। তারা ভাবেন, পিতৃতন্ত্র তাদের বিশাল কোনো ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, স্বাধীনতা দিয়েছে, তাদের শক্তিমান ও প্রভাবশালী করেছে। এদিকে এই স্বাধীনতা ও ক্ষমতার মূল উৎসটির দিকে তারা কখনো নজর দেন না। তারা অনুভব করেন না যে, এই স্বাধীনতা আসলে তারা পেয়েছে অন্য একটি লিঙ্গকে পরাধীন করে রেখে, অন্য একটি লিঙ্গকে শক্তিহীন করেই তারা শক্তিমান হয়েছে, তাদের ক্ষমতাটি আসলে অন্য লিঙ্গের ওপরে প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটানোর ক্ষমতা, আর কিছু নয়। পিতৃতন্ত্রের এই ক্ষমতা কাঠামো লিঙ্গভিত্তিক, বৈষম্যমূলক ও অনৈতিক। একটি অসভ্য, নীতিহীন কাঠামোর ভেতরে থেকে পুরুষ যে ক্ষমতা, সুবিধা ও স্বাধীনতার চর্চা করে, সেই কাঠামো আসলে তার জন্যও ক্ষতিকর। শেষ অবধি পুরুষও পিতৃতন্ত্রের হাতে ধরা সুতোয় বাধা পুতুলমাত্র।

পিতৃতন্ত্র পুরুষকে শেখায় সেইসব, যা পুরুষের ভেতরে থাকলে পিতৃতন্ত্রের সুবিধা হয়। পুরুষ হয়ে ওঠে পিতৃতন্ত্র এবং সামগ্রিক অর্থে পুঁজিবাদের সেবাদাস। আর এই সেবাদাস হলো সেই সেবাদাস, যে সেবাদাসকে দুধ কলা মাখন খাইয়ে এতটাই স্থবির আর স্থূল করে ফেলা হয় যেন তার বোধ বুদ্ধি বিবেক ও বিবেচনার দরোজাগুলো চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সে তখন ছড়ি ঘোরায় নারীর ওপর, নারীর স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে যাতে তার নিজের মাখন ও দুধের সরবরাহটি অব্যাহত থাকে। এর বিনিময়ে পিতৃতন্ত্র কেড়ে নেয় পুরুষের ভেতরের আসল মানুষটাকে। পুরুষকে গড়েপিঠে নেয় নিজের কাঠামোর আদলে, তাকে বানায় ‘পুরুষ’- যে পুরুষ নিছক একটি শারীরিক লিঙ্গ নয়, হয়ে ওঠে একটি শাসকের নাম, একটি সুবিধাভোগী ভৃত্যের নাম। যে তার চিন্তা চেতনায় নারীকে অর্ধেক হিসেবে জ্ঞান করে, নারীকে অপূর্ণ মানুষ বলে মনে করে, নারীকে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করে, ভোগ করে। নারী তার কাছে সহযাত্রী নয়, হয়ে ওঠে তারই দাস, ভৃত্য। তার সেবার নিমিত্তে নিয়োজিত একটি প্রাণি। এবং এমন পুরুষ হয়ে ওঠার জন্য তাকে আত্মবিসর্জন দিতে হয় পিতৃতন্ত্রের পায়ে।

পিতৃতন্ত্র পুরুষের আবেগ অনুভূতি বোধ অভ্যাস ভাললাগা মন্দলাগাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে যেভাবে চায়, পুরুষ হয়ে ওঠে সেই পুরুষ। পুরুষও পিতৃতন্ত্রের চোখে শুধু পুরুষই, মানুষ নয়। পিতৃতন্ত্র তাকে নির্দেশ দেয় যেন সে বুকের ভেতরের হাহাকার আর চোখের অশ্রু চেপে রাখে, সে যেন নিজের সব ইচ্ছা অনিচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজের শেখানো ‘পুরুষের কাজ’গুলো করে যায় নীরবে। ভুলেও যেন ‘নারীর কাজ’গুলোতে হাত না দেয়। সে যেন ক্ষমতা ও শক্তির বাইরে গিয়ে হলেও সমস্ত আর্থিক দায়দায়িত্ব মাথায় তুলে নেয়। তার শরীরে যথেষ্ট শক্তি ও এনার্জি থাকুক বা না থাকুক, তাকে প্রদর্শণ করতেই হবে তার শারীরিক শক্তি, তাকে বইতে হবে বোঝা, তাকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে শরীরের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে হলেও ওজনদার জিনিস। নাহলে খর্ব হবে তার পুরুষত্ব।

এই সমাজ তাকে সুবিধা দেবে। আবার একই সাথে সেই হবে সবচেয়ে বেশি ভিক্টিম, দোষী, সে হবে যেকোনো ঘটনার প্রথম সন্দেহভাজন, তাকে সামাজিক, আইনগত ও আবেগ অনুভূতির জায়গা থেকে সবসময় পরে বিবেচনা করা হবে। তাকে দেখা হবে পশুর সমতুল্য করে, যে পশু অর্থ খারাপ, একগুঁয়ে, নিষ্ঠুর ও হিংস্র। এই ‘পশুত্ব’ আবার পিতৃতন্ত্রই তার কাছে চাইবে, তাকে শেখাবে এইভাবেই, তাকে গড়েও তুলবে এভাবে। তারপর তাকে ছেড়ে দেবে খেলার মাঠে- মজা দেখতে।

পিতৃতন্ত্রের এই জটিল কঠিন ও কুটিল রাজনীতিটা বেশিরভাগ পুুরুষের মাথায় ঢোকে না। তাই পুরুষ পুরুষতন্ত্রের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। সে হয়ে ওঠে এই কুটিল সিস্টেমের সেবাদাস, অথচ সে নিজেকে ভাবে সমাজের মালিক। অথচ সে নিতান্তই এক ভৃত্য বৈ আর কিছু নয়, ঠিক যেমন নারী। তবে নারীর অবস্থা আরো করুণ। নারী হলো পুরুষ নামের সেই ভৃত্যেরও ভৃত্য, নারীর মাথার ওপর একাধিক শাসক ও শোষক- যারা লিঙ্গ ক্ষমতার নামে তাকে দমন করছে।

পুরুষতন্ত্রের এই জাল ছিঁড়ে বেরুতে হবে আমাদের। নারী পুরুষসহ সব লিঙ্গকেই। লিঙ্গভিত্তিক ব্যবধান ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। পুরুষকে বুঝতে হবে এই অশুভ রাজনীতি। নিজেকে পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চর্চা করতে হবে।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর লেখক ও পাঠকদের কাছ থেকে বিষয়ভিত্তিক কিছু লেখা আহ্বান করে এবং খুব আনন্দের বিষয় হলো, সেইসব বিষয়ভিত্তিক লেখায় বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। লেখক পাঠক সকলেই খুব উৎসাহ বোধ করেন।

তো এইবার, বিষয়ভিত্তিক লেখা ঠিক করা হয়েছে- পুরুষতন্ত্রে পুরুষের জীবন। লেখা আহ্বান করা হয়েছে মূলত পুরুষদের কাছ থেকে।

পুরুষতন্ত্রে পুরুষের জীবন- বিষয়ভিত্তিক এই লেখার আয়োজনে আপনাদের স্বাগত জানাই। ভালবাসা নেবেন।