দুঃস্বপ্ন
আলীয়া তামজিদা কান্তি।।
আশির দশকে এসে বনেদী পুরানো বাড়ির তালিকায় এসে ঠেকেছে ছায়াদের জমিদার বাড়ি আদলের বাড়িটি । মিছিলের শব্দে দৌঁড়ে দোতলার টানা বারান্দায় এসে দাঁড়াল ছায়া। পেছনে এসে চমকে দেয় স্বাতী, ছায়ার সার্বক্ষনিক সঙ্গী। ছায়ার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে স্বাতী এই একান্নবর্তী পরিবারে ছায়ার মতো অনুসরণ করে ছায়াকে। স্বাতীর বাবা-মা বিদেশে যাওয়ার পর থেকে স্বাতী ছায়ার ঘরেই থাকে; এসএসসি না দিয়ে যাবে না বিদেশে। দুজনের চেহারায়ও দারুণ মিল যদিও ছায়ার মতো সুন্দরী পাওয়া কঠিন। স্বাতীও যোগ দেয় মিছিল দেখায়। প্রায়ই স্বাতী উচ্ছ্বসিত হয়ে উপভোগ করে দিক-না-জানা দমকা হাওয়ায় সুতো-কাটা ঘুড়ির বিক্ষিপ্ত চলাচল।
দুই বছরের চেষ্টায় ছায়ার মন পেলো তৌসিফ। অনেক বড় বাড়ির ছেলে। শিক্ষাদীক্ষা, বিষয়-সম্পত্তি, চেহারা- চাকুরি সবই ভাল। ছায়ার ডিগ্রি পরীক্ষার পরই বিয়ে হলো। বিয়ের দিন গয়নার ওজনে সংজ্ঞা পর্যন্ত হারিয়েছিল ছায়া। সবশেষে মায়ের বাঁধন ছাড়িয়ে, স্বাতীর মন শূণ্য করে ছায়া চলে গেল শ্বশুরবাড়ি।
বাড়ি তো নয় যেন প্রাসাদ! জমিদার বাড়ির আদলে আধুনিকতার মিশেল। বাড়ির কায়দা-কানুনও সেরকম। শাশুড়ির ঘরে দেখা করতে গেলেও ফোন করতে হয় ইন্টারকমে। কিছুদিনের মধ্যে তারা চলে যায় ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজেদের আরেকটা বাড়িতে।
ঢাকায় গিয়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিলো ছায়া। মাঝে মাঝে বাড়ির জন্য খারাপ লাগে। ছায়ার চোখ-মুখ, ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি, টোলপড়া গাল, ঠোঁটের কোণে উঁকি দেয়া লাজুক হাসিতে অভিভূত তৌসিফ খুঁজে পায় জীবনকে উপভোগের প্রেরণা। তাই হঠাৎ ছায়ার খারাপ হওয়া মনকে ভাল করে দিতে বাইকে করে ছায়াকে নিয়ে বেরিয়ে হাজির হয় নিজের কিংবা ছায়ার ঢাকার বন্ধুদের বাসায়। ছায়ার মনে হয় জীবন যেন আজ তার শ্রেষ্ঠ অবস্থায়।
ওদিকে স্বাতীর মনের অবস্থা ভয়াবহ; ছায়ার অনুপস্থিতি মানতেই পারছে না। মা বাবার জন্যেও খারাপ লাগে; টানছেনা বান্ধবীদের গল্পও। ইচ্ছে করে বাঁধন ছিড়ে সুতো-কাটা ঘুড়ির মতো উড়ে যায় ছায়ার কাছে। কষ্টটা বিষন্নতায় পৌঁছে যাচ্ছে। বিদেশে মা ছটফট করে। শেষ পর্যন্ত স্বাতীর মা ছায়ার দ্বারস্থ হয়। আপাতত ছায়ার কাছে এনে ঢাকায় কটা দিন রাখতে বলে। তাই ছায়াও ভাবে তৌসিফ রাজী থাকলে স্বাতীকে ঢাকায় এনে স্কুলে ভর্তি করে দেবে। হলোও তাই।
ছায়ার শাশুড়ি ভেবেছিল কদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে স্বাতী; কিন্তু বিষয়টা বুঝে অবাক! ছায়ার শ্বশুর-শাশুড়ি কানাডায় বড় ছেলের কাছে যাবে আট মাসের জন্য। তিনি ছায়াকে বোঝালেন কীভাবে সংসারটাকে চালাতে হবে। ছায়ার ভয় লাগলেও মন দিয়ে শোনে শাশুড়ির কথা। সব শেষে তুললেন স্বাতীর প্রসঙ্গ। একটু গম্ভীর হয়েই বললেন, “ও যদি থাকতে আসে তাহলে কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় ! এখন সে তোমার কাছে আমানত। সে তোমার আপন ভাইঝিও নয়। ওর পুরো দায়িত্ব সামলাতে পারবে? তোমার বয়সও তো কম!”
– কেন পারবো না মা? কোনো সমস্যাই হবে না।
– মা, জীবন তো অত সহজ না। স্বাতীর বয়স কম। ও যে অনেক কিছুই বোঝে না ওর চালচলন দেখে আমি বুঝে গেছি। তারপর যদি স্যারের বাসায় পড়ে বন্ধু-বান্ধব হবে……, কোন খপ্পরে পড়বে; সামলাতে পারবে?
– মা, স্বাতী এরকম মেয়েই না। ওকে আমি আপন ভাতিজিই ভাবি। ও খুব নিষ্পাপ মনের মেয়ে!
– দ্যাখো মা, সবই বুঝি, কিন্তু মানুষের মন বড় বিচিত্র; কাউকেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করা যায় না। এ কথাটা মনে রেখো। যা বোঝ করো; একটু সাবধানে থেকো!
শাশুড়ির কথা সত্যিই দুশ্চিন্তায় ফেলে ছায়াকে। স্বাতীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে তৌসিফকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলে ছায়া। ছায়ার কথায় তৌসিফ কিশোর-বয়সী মন্টুকে এমনকি তাদের মূল বাবুর্চি মাঝ-বয়সী রহিম চাচাকে ছুটি দিয়ে দিল। বদলে কাজলী মাকে স্থায়ী করা হলো কাজলীকেসহ।
প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পরে ছায়া আর স্বাতী বসে লুডু খেলতে। তৌসিফ অফিস থেকে ফিরেও প্রায়ই দ্যাখে ওরা খেলছে। মাঝে মাঝে সেও যোগ দেয়। একদিন তৌসিফ দ্যাখে দাবা খেলায় ছায়া হেরে যাচ্ছে। তৌসিফ ছায়ার সাথে যোগ দিয়ে ওকে জিতিয়ে দেয়। স্বাতী রেগে-মেগে আগুন। তৌসিফ অবাক হয়ে দ্যাখে রাগলেও একটা মানুষকে এত সুন্দর লাগে! এরপর সুযোগ পেলেই স্বাতীকে রাগিয়ে ওর গালের লালচে আভাটা চোখ দিয়ে উপভোগ করে সে। ছায়া মাঝে মাঝে শাসায়- “তুমি ওকে ক্ষেপাও কেন? তুমি তো ওর দুলাভাই না, ফুপ্পা!” তৌসিফ হাসতে হাসতে বলে “উফ্, আমাকে ও ফুপ্পা ডাকে কেন? মনে হয় যেন বিয়ে করেই বুড়ো হয়ে গেলাম।” তৌসিফের কথা শুনে হেসে ফেলে ছায়া। আরেক দিন তৌসিফ দ্যাখে লুডুতে স্বাতী হেরে যাচ্ছে। তখন সে ওর সাথে যোগ দিয়ে ওকে জিতিয়ে দেয়। স্বাতী মহাখুশী হয়ে একটা লাফে উঠে ফুপ্পার সাথে হাত মেলায়। স্বাতীর চোখ-মুখের খুশি, নরম হাতের ছোয়ায় রোমাঞ্চিত হয় তৌসিফ। এই মুগ্ধতার রেশ যেন কাটেই না। তার নেশা জেগে ওঠে স্বাতীকে কোন অবস্থায় বেশি সুন্দর লাগে তা জানায়।
ছুটির দিন পাকা গিন্নী ছায়া চুলোয় গরুর মাংস চড়িয়েছে। তৌসিফ দু’একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে শেষে স্বাতীর ঘরে গেল। স্বাতী তখন বারান্দায় চুল শুকায়। তৌসিফের যেন চোখ মন সব আটকে গেল স্বাতীর ছড়ানো চুলের ফাঁকে ফাঁকে রোদ পড়া ফর্সা গালে। সরতেই ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছিল সেই গালের কোমলতা অনুভব করে; উপায় নেই। কথার বলার ফাঁকে সে চালিয়ে যায় এক তুলনা করার খেলা। কে বেশি সুন্দর, ছায়া নাকি স্বাতী? ছায়া একটা পরিপূর্ণ গোলাপ হলে স্বাতী হবে একটা আধ-ফোটা গোলাপ। ছায়ার চেহারা পরিণত, স্বাতীর চেহারা কচি, তুলতুলে, কোমল। কচি মুখের কোমলতাই আজ তাকে টানছে বেশি। এই অনুভূতি তার নিজস্ব, কাউকে বলার মতো নয়, কিন্তু তার ইচ্ছে হচ্ছে স্বাতীকে এসব বলে তার প্রতিক্রিয়াটা উপভোগ করতে। সুযোগ পেলে সে বলবেই; এই অদ্ভুত ইচ্ছের লাগামটা টেনে ধরতে তার ইচ্ছে করে না।
বিকেলে স্বাতী বায়না ধরে বাইকে চড়বে । তৌসিফের মাথা থেকে পাতা পর্যন্ত আনন্দের স্রোত! ইচ্ছে করেই গতি বাড়িয়ে দেয়, ডান-বাম করে যাতে স্বাতী তাকে শক্ত করে ধরে। মেঘ না চাইতেই জল! বাইকে চড়ে মহা উত্তেজিত স্বাতী। তৌসিফের প্রাণবন্ত ব্যবহারে স্বাতী আপ্লুত, উচ্ছ্বসিত। তার ইচ্ছে করে বিয়ে করলে এমন একজন মানুষকে বিয়ে করবে যে ফুপ্পার মতো হয় এবং বাইক চালাতে পারে। ছায়া সংসারের খুঁটি-নাটি সামলাতে ব্যস্ত; শাশুড়িকে রিপোর্ট দেয়। চাল- ডালের মাসিক হিসাবও বের করে ফেলেছে। স্বাতীর পড়াশুনারও খেয়াল রাখে।
ওদিকে তৌসিফের বেড়ে যায় স্বাতীকে দেখার লোভ। অফিসে মন বসে না। তাড়াতাড়ি ফেরে বাসায়। চকলেট নিয়ে এসে প্রথমেই ঢোকে স্বাতীর ঘরে। সুযোগ পেলেই গাল টিপে দেয়। প্রথমে বিষয়টা বুঝত না স্বাতী। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বিষয়টা বোঝে এবং কেমন যেন উপভোগ করে। সেও যুক্ত হয় ছায়াকে ফাঁকি দেওয়ার ঘৃণ্য খেলায়। উপভোগের নেশা অতিক্রম করে বিবেকের দংশনকে। তৌসিফও পুরানো গাড়িটার বদলে নতুন বাইকটা চালিয়ে যে আনন্দ পায় সেরকম আনন্দ পায় ছায়াকে ফাঁকি দিয়ে স্বাতীর সাথে সময় কাটিয়ে।
তৌসিফের মধ্যে কিছু পরিবর্তন টের পায় ছায়া। সে আগের মত উচ্ছাস নিয়ে গল্প করে না। অফিসের কাগজপত্রে চোখ গুঁজে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হয়। অভিযোগ করলে সে পাল্টা বলে, “তুমিই তো আমাকে সময় দাও না, কথা বলতে চাইলেই দেখি কি সব কাগজ-কলম নিয়ে ঠুকাঠুকি করো; অফিস নেই, পড়াশুনা নেই এত কিসের হিসাব-নিকাশ?” ছায়া স্তম্ভিত ! কিন্তু সে কথা বাড়ায় না। সে বোঝে আসলে নিরিবিলিতে কোথাও ঘুরে আসলে দুজনেরই হয়তো ভাল লাগবে। আসলেই সে সংসার নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। তার উপর তৌসিফের মা-বাবা দেশে নেই। এটাও একটা কষ্টের কারণ। সে ভাবে তাদের বিয়ের প্রথম বার্ষিকীতে তৌসিফকে বলবে ছুটি নিতে ।
আরও কিছুদিন পর স্বাতী হঠাৎ বায়না ধরে সে স্কুলের শিক্ষা সফরে চিটাগাং যাবে। ছায়া দিতে চায় না। দুনিয়ার চিন্তা মাথায়! স্বাতী গো ধরায় রাজী হলো। সে ভাবে এ কয়দিনে ছায়া আর তৌসিফ ঐদিকেই কোথাও বেড়াতে যেতে পারে। সম্পর্কের টানা-পোড়নটা হয়তো চলে যাবে। তৌসিফকে বলতেই সে বলল কোনভাবেই সম্ভব না। অফিসের কাজে তাকে যেতে হবে উত্তরবঙ্গে। ছায়া বলল, “আচ্ছা তাহলে আমাকেও ওখানেই নিয়ে চলো, ভালইতো!” তৌফিক ক্ষেপে যায়,“অদ্ভুত কথা বলো না তো! ওখানে যাব অফিসের কাজে। তুমি তখন কী করবে? কোথায় থাকবে?” ছায়া অবাক হয়-“আমি একা বাসায় কীভাবে থাকবো?” তৌসিফ সাথে সাথেই বলে ওঠে, “কীভাবে আবার? বাসা তো কোথাও চলে যাচ্ছে না। বুয়া আর কাজলী তো আছেই তোমার নিরাপত্তা বেষ্টনী। বাইরে দারোয়ান আছে।” ছায়া এবারে হতভম্ব। কথা বাড়াতে রুচি হলো না তার- এ যেন এক অচেনা তৌসিফ। তবে আবারো পুরো ব্যাপারটাকে বিশ্লেষন করে সে। অফিসের কাজে যেহেতু যাচ্ছে, ছায়াকে নেয়া হয়তো আসলেই সম্ভব না। তার জন্যেও এটা বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হতো হয়তো। কিন্তু তৌসিফ এটা বুঝিয়ে সুন্দরভাবেও বলতে পারতো।
স্বাতীর যাওয়াটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ছায়া ঠিক করে সকালে স্বাতীকে স্কুলে পৌঁছে দেবার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথেও আলাপ করবে নিরাপত্তা ব্যাপারে।
সকালে তৌসিফ অফিসে যাবে; অফিস থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে যাবে। ছায়া বলল স্বাতীকে আর ছায়াকে স্কুলে ড্রপ করতে। তৌসিফ অনীহা প্রকাশ করল, “না, আমার দেরী হয়ে যাবে!” ছায়া বলে, “স্বাতী ফুল রেডী। আমি শুধু দুই মিনিটে ড্রেসটা বদলে আসি।” তৌসিফ বাঁধা দিল- “দরকার নেই, আমিই ওকে ড্রপ করে চলে যাব অফিসে, সময় নষ্ট করো না আমার।” ছায়া বলে, “আমিতো স্কুলে গিয়ে একটু খোঁজ নিতে চাচ্ছিলাম। আচ্ছা, তুমি তাহলে ভাল করে খবর নিয়ে আমাাকে জানাবে।”
বেরুবার সময় ছায়া দুজনকে বলে পৌঁছেই খবর জানাতে। তৌসিফ বলে খবর জানানো এত সহজ না। এক জেলা থেকে দূরের আরেক জেলায় সব সময় লাইন পাওয়া যায় না। তৌসিফ বের হবার সময় তাকে দুশ্চিন্তা করতে না করে। আর বলে, “সামনের ছুটিতে আমরা অনেক দূরে বেড়াতে যাব। ঠিকাছে?”
ছায়ার পুরোটা দিনে ভাল কাটলো এই শেষের কথাটিতে। সন্ধ্যার পর তৌসিফ ফোন করে পৌছাঁবার কথা জানায়। ছায়া জানায় এখনো স্বাতীর কোন খবর পায়নি। তৌসিফ অভয় দেয়-চিন্তার কিছু নেই, হয়তো এসে যাবে ফোন। আধ ঘন্টার মধ্যেই ফোন আসে স্বাতীর। ছায়া নিশ্চিন্ত হয়। তার মাঝে ফোন আসে শাশুড়ির। সব খবর জানায় সে। স্বাতীর কথা শুনে তিনি অবাক।
– স্কুল থেকে আজকাল এতদূর নিয়ে যায় নাকি? ভাল করে খবর নিয়েছিলে তো?
– জ্বী মা। আপনার ছেলে নিজে গিয়ে খবর নিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছে।
নিশ্চিন্ত মনে ছায়া কয়েকদিনের করণীয় ঠিক করে। বিশাল তালিকা। তিনদিন ব্যস্ততা কাটিয়ে চতুর্থ দিন নাড়া দিয়েছে স্বাতীর ঘর। সহায়তায় আছে কাজলী। ওয়ারড্রোবের দরজা ধরে টান দিতেই গুটি-পাকানো জামা-কাপড় ঝুপ করে পড়ল। টেবিলে বইয়ের স্তুপ, চকলেটের খোসা। ছায়া কাজলীকে ধমক লাগায়,- “সারাদিন করিস কি বলতো? একি অবস্থা ঘরের?” কাজলী বলে, “আমার কি দোষ? আমারে তো গুছাইতে দেয় না, নিজেও গুছায় না, স্বাতী আপা জানি কিমুন কিসিমের মানুষ!”
– বাঃ ! স্বাতী তোকে দেয় না কাজ করতে?
– না খালা, সত্যই আমারে ধরতে দেয় না। নিজে পড়েও না, আর লুকায়া লুকায়া কার জানি চিডি পড়ে খালি!
ছায়া একটু দুশ্চিনায় পড়ে- কার আবার চিঠি! স্কুল, স্যারের বাসা সব জায়গায় সে নিজেই নিয়ে যায়। যাই হোক কাজলীর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে, “তুই কাজ কর। কথা কম !”কাজলী ফিস ফিস করার মতো ভান করে বলল, “খালা, খালুজানরে একটু সামলাইয়া রাইখ্যেন। প্রত্যেক দিন চকলেট দেওনের নাম কইরা তাইনে এই ঘরে ঢুকে; আমি থাকলে আমার দিকে চেইত্যা চেইত্যা চায়; আমি দৌড় মারি।”
ছায়ার মনে হলো মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। রাগে সে চিৎকার শুরু করল। কাজলীর মা দৌড়ে এসে তাকে শান্ত করে। কাজলীকে থাপ্পর লাগায় তার মা। সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, “মারো ক্যান? তুমিই তো কও এই কতা”! ছায়া কিছু বোঝার আগেই কাজলীর মা তার মুখ চেপে নিয়ে যায় অন্য ঘরে।
ছায়ার মেজাজটা বিগড়ে আছে। এইটুকু মেয়ের সাহস দেখে সে অবাক! ছিঃ! কি নোংরা মন এইটুকু মেয়ের! তার আর কিছুই ভাল লাগছে না। ভেবেছিল বিকালে বের হয়ে দুইটা সুন্দর দেখে বাহারি নকশার টেবিল ল্যাম্প কিনবে। একটা থাকবে স্বাতীর পড়ার টেবিলে। আরেকটা নিজের ঘরে। কিছুই আর ভাল লাগছে না। জোরে ফ্যান ছেড়ে নিজের ঘরের ইজি চেয়ারে বসে। এর মধ্যে বেজে উঠল ফোন। উঠে গিয়ে ধরতেও ইচ্ছে করছে না। তারপরও ধরল। ও পাশ থেকে শোনা গেল তার বান্ধবী মায়ার গলা। খুব রহস্য করে কথা বলছে সে-
– কি শেষ হয়ে গেল সমুদ্র দেখা? আমাদেরও তো সাধ হয় সমুদ্র দেখি। একবার তো বললিও না।
ছায়া আকাশ থেকে পড়ে- সমুদ্র দেখা আবার কী? মাথার নাট-বল্টু জায়গা মতো আছে তো তোর?
– আহা, লুকানোর কী আছে?
– তুই কি বলছিস কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ঢাকার মধ্যে সমুদ্রে আসবে কোত্থেকে?
ছায়ার কথা শুনে মায়াও অবাক। সে ঘটনা খুলে বলল। মায়ার দেবর বৌসহ কক্সবাজার গিয়েছিল। ওখানে ফটোগ্রাফার ছবি তুলে দিয়েছে তাদের বেশ কয়েকটা। ওয়াশ করা ছবি পেয়েও গেছে ; ওখানকার দু’তিনটা ছবিতে মায়া দেখল তৌসিফকে দেখা যাচ্ছে । দুইটা ছবিতে স্বাতীকে দেখা যাচ্ছে। তৌসিফের চেহারা নায়ক বিশ্বজিৎ এর মতো! তাকে তো ভুল করার কিছু নাই। সঙ্গে স্বাতী আছে মানে তো ছায়া থাকবেই ! মায়ার কথা থেকে যেন সাগরের গর্জনের মতো শব্দ আসছে! কথাগুলো কান পার হয়ে ছায়ার মাথায় ঢুকছে না। ফোন রেখে দিল সে। শব্দ তবু থামছেই না।
মায়া প্রমাণ হিসেবে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছে ঘন্টা খানেকের মধ্যে। ছায়া কী করবে এখন? অপেক্ষা করবে? কীসের অপেক্ষা? স্বাতীর ডায়েরি থেকে বান্ধবীর ফোন নাম্বার বের করে। বান্ধবীর মা বললো কোন শিক্ষা সফরেই যায়নি স্কুল থেকে। সামনে পরীক্ষা। ডায়রী থেকে পড়ে যাওয়া কাগজে চোখ বুলিয়ে বুঝলো এটা একটা প্রেমপত্র। হাতের লেখাটা ছায়ার অতি চেনা। মাথার উপর যেন বজ্রপাত হলো। ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। দুয়ে দুুয়ে চার মেলায় ছায়া। শাশুড়ির বলা কথাটা ঘুরছে মাথায় – মানুষের মন বড় বিচিত্র! মাথাটা যেন এক মণ ভারি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে চারিদিকে শুধু নর্দমার কীট; নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত, বিবেকহীন কীটপতঙ্গ…… পৃথিবীতে যেন কোন মানুষ নেই! ছায়া পরনের শাড়িসহ বাথরুমে শাওয়ারের শীতল জলের নীচে দাঁড়ায়। মন চায় জলের ধারায় ধুয়ে যাক পৃথিবীর সব আবর্জনা, মনের কষ্ট আর দুঃস্বপ্নের ঘোর। ভাবে আজকের পুরো দিনটাই যেন হয় একটা দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্নের ঘোর ভেঙ্গে যেন সে দ্যাখে সব ঠিকঠাক ! কোন নর্দমার কীট নেই এই পৃথিবীতে!