November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সন্তানের সুখ মানেই বাবা-মা’র সুখ নয়

তৌকির ইসলাম।। সন্তান পৃথিবীর প্রতিটি জীবের কাছে পরম আদরের এবং ভালবাসার। সন্তানের প্রতি প্রতিটি জীবের মমত্ববোধ এক জন্মগত সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু আমাদের মনুষ্য সমাজে সন্তানের প্রতি ভালোবাসার যে নজীর তা অন্য জীবকুলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার উপরে আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থায় সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালবাসা আরেকটু বেশি গভীর। আর সন্তানের প্রতি এই গভীর ভালবাসা আমাদের পিতামাতাদের জীবন ব্যবস্থার যেমন চালিকাশক্তি তেমনি কিছুটা উদ্বেগের কারণও।

আমাদের সমাজে পিতামাতা তাদের জীবনের সব কিছু ব্যয় করে দেন সন্তানদের পিছনে। নিজেদের সময়, শখ, অর্থ, আনন্দ সব কিছু। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে পিতামাতার স্বকীয়তা বজায় রাখা, নিজের জন্য কিছুটা ভাবা থেকে শুরু করে সন্তান সুখি মানেই পিতামাতা সুখি- এই থিওরি মানতে আমি ব্যক্তিগতভাবে নারাজ এবং আমার দৃষ্টিতে এর অনেকগুলো খারাপ দিকও আছে।

হয়তো পাঠকরা আমার আজকের এই বক্তব্যে খুব বিব্রত হতে পারেন কিন্তু আমি নিজে একজন সন্তান হয়ে বলতে চাই যে পিতামাতা হিসেবে নিজেকে এভাবে ঢেলে দেবেন না। সন্তান নিজে একজন মানুষ, সন্তানের নিজস্ব মতামত আছে, ভাল লাগা আছে, স্বাধীনতা আছে; কিন্তু আমাদের পিতামাতা এই সহজ অংকটা বুঝতে চান না। হ্যাঁ, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সন্তানের পিতামাতার মতামতের দরকার হয় কিন্তু তা সারা জীবনের জন্য নয়। ‘সন্তানের মঙ্গল চাই, তাই বলি’ এই থিওরি সবসময় নাও খাটতে পারে- পিতামাতার তা বোঝা উচিত।

আমাদের পিতামাতারা নিজেদের সুখ, ভালবাসা, শখ এসব সন্তানের জন্য বলি দিয়ে দেন এবং বৃদ্ধ বয়সে সন্তান তাদের জন্য করবেন এই আশায় বুক বাঁধেন। মানুষ হিসেবে পিতামাতার উচিত তার নিজের জন্য কিছুটা সময় রাখা, নিজের জন্য কিছু করা। সব কিছুতেই সন্তানকে টেনে এনে নিজের সব বিসর্জন দেওয়াটা মোটেও ঠিক নয়। আপনাকে আপনারটাও ভাবতে হবে। আপনি শুধু সন্তানের জন্য করতে করতে শহীদ হয়ে যাবেন আর পরে সন্তান আপনার খেয়াল না নিলে আফসোস করবেন- তার দায় পুরোটা আপনারই। কেননা সন্তানের সব ব্যাপারে নাক গলাতে গিয়ে আমাদের মাতাপিতা নিজেদের জীবনের সব আনন্দ মাটি করেন। আপনার মনে রাখা উচিত সন্তানকে আপনি জন্ম দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সন্তান একজন ভিন্ন মনুষ্য সত্তা। আপনার সব কিছু তার ভাল লাগবে না এটাই স্বাভাবিক। সন্তানের সব কিছু আপনার ভাল লাগবে না এটাও স্বাভাবিক। ‘সারাজীবন কষ্ট করে সন্তান মানুষ করেছি এখন বুড়ো বয়সে সন্তান পর হয়ে গেল’ এই অভিযোগ আমাদের বেশিরভাগ পিতামাতার, কিন্তু এটা কেউ বলে না যে সন্তান আপনাকে তার সব ব্যাপারে ভাবতে বলে নি। সব ব্যাপারে আপনাকে বিলিয়ে দিতে বলে নি। আপনি নিজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে নিজে উজার করেছেন। এখন অনেকেই বলতে পারেন যে বাবা মার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা। কিন্তু দায়িত্ব-কর্তব্য পালন আর নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য। আর যদি আপনি পিতামাতা হয়ে উদারভাবে নিজেকে এভাবেই বিলিয়ে দেন তবে শেষ বয়সে আফসোসের কোন দাম নেই কেননা আপনি তো বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। এখন আফসোস করে কী হবে!

পিতামাতা নিজে ভিন্ন মানুষ, সন্তান নিজেও ভিন্ন মানুষ। মানুষ হিসেবে নিজেকে সময় দেওয়া, নিজের জন্য করা অনেক বেশি জরুরি। সম্পর্কের টানে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করা উচিত কিন্তু নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে কখনোই নয়। জীবনটা একবারই পাওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র সম্পর্কের ভিড়ে নিজেকে বলি দেওয়া মোটেও ঠিক নয়। সন্তানের সুখ আপনার ভাল লাগা হতে পারে কখনোই আপনার নিজের সুখ নয়। সন্তানের সুখকে নিজের সুখ ভাবতে গিয়ে নিজের দুঃখ বাড়াচ্ছেন। একটা ছোট উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি চিলি চিকেন খেতে পছন্দ করেন আর আপনার সন্তান ফ্রাইড চিকেন। সন্তানকে প্রাধান্য দিয়ে আপনি কোনোদিনও চিলি চিকেন কিনলেন না বা রান্না করলেন না। শেষ বয়সে আপনার সন্তানের সাথে দূরত্ব তৈরি হলে আপনিই হয়তো বলবেন যে ও পছন্দ করে বলে আমি নিজে চিলি চিকেন খাই নি। এখন আপনিই বলুন ভুলটা কার! সন্তান হয়তো তার দায়িত্ব পালন করছে না বলে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু আপনি আপনার প্রতি কি দায়িত্ব পালন করেছেন? একদিনের মেন্যুতে আপনার প্রিয় চিলি চিকেন থাকলে সন্তানের খুব কষ্ট হতো না বরং সন্তান বুঝতো যে আপনার পছন্দ অপছন্দ।

এই চিলি চিকেনের উদাহরণ খুবই ক্ষুদ্র উদাহরণ। আমি শুধু বুঝাতে চেয়েছি আমাদের পিতামাতারা কিভাবে নিজের দুঃখ বাড়ান। পিতামাতা হয়ে দায়িত্ব পালন করুন নিজের প্রতি যত্নশীল হয়ে। আপনার নিজের সুখগুলোই আপনার। সন্তানকে জন্ম দিয়েছেন বলে তার পুরোটা জুড়ে আপনি- তা ভেবে দুঃখ বাড়াবেন না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]