শিশুর জন্ম দিলে, তাকে সুন্দর পরিবেশও দিতে হবে
নন্দিতা সিনহা।। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে অভ্যস্ত। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের জন্মগ্রহণ, বেড়ে ওঠা, জীবন সম্পর্কিত কার্যাবলী সব চলতে থাকে তার সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ একটা সময় ধরে জীবনব্যাপী তা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। আর গবেষণায় পাওয়া গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক অনুকরণপ্রিয় হওয়ায় মানুষ দীর্ঘসময় যে পরিবেশে থাকে সেখানকার আচার আচরণ জীবনপদ্ধতি নিজের অজান্তেই অনুকরণ করতে শুরু করে। তাই নিঃসন্দেহেই মানুষের জীবনে তার পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব অনস্বীকার্য।
ব্যক্তি ও সমাজজীবনে পরিবারই সবচেয়ে সহজ ও নিকটতম প্রতিষ্ঠান। জন্মের পরপরই মানুষের জীবনে সর্বপ্রথম পরিবার প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সেখানে তার সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়, কেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সর্বোপরি তার প্রাথমিক শিক্ষার উপর নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্ব।কিন্তু আমাদের মত দেশ যেখানে সাক্ষরতার হার নগন্য সেখানে পিতামাতার বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও অবচেতনে মানবিকতা বোধের অভাব সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। পরিবারগুলোতেই কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তানের মধ্যে বৈষম্য, নিজ সন্তান ও অপরের সন্তানের প্রতি অসচেতনতামূলক কিছু আচরণের ফলে অনায়াসেই শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে তো অবস্থা আরও সংকটপূর্ণ। যেখানে অর্থ সংস্থানের চিন্তাতেই অভিভাবকদের দিনের পর দিন কেটে যায় সেখানে সন্তানদের নৈতিক ও মানবিকভাবে গড়ে তোলার অবকাশটুকুও থাকে না। যেখানে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ আজকের শিশু তার সংবেদনশীল সময়টি তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনের সময়টি পার করছে সেই সময়টাতেই তাকে গুরুত্বহীন ভেবে তাকে ওভারলুক করা হয়।
আমাদের সমাজে শিক্ষিত মানুষই বা কতজন,আর শিক্ষিত হলেও এসব বিষয়ে সচেতন মানুষই বা কতজন। তাদের সংখ্যা অল্প। বাদবাকি সংখ্যাটাই উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। আর এই সংখ্যাগুরু অংশটাকে বাদ দিয়ে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। হলেও সেটা হবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের দেওয়া দুটি অসমান চাকার গাড়ির করুণ অবস্থার উদাহরণটার মতো। গাড়ির এক চাকা বড় আর অন্য চাকা ছোট হলে গাড়ি যেমন চলে না তেমনি এই সংখ্যাগুরু অংশকে বাদ দিয়ে কোনোকালেই সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাধারণ পর্যবেক্ষনেই আমরা আজ বুঝতে পারি সমাজের এক শ্রেণির প্রতি অন্য ক্ষমতাধারী শ্রেণির শোষন ও অত্যাচার, অমানবিক নিষ্ঠুর আচরন, ধর্ষণ, দূর্নীতিসহ তরুণ সমাজের বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার মত ঘটনাগুলোর পশ্চাতের মূল কারণ আমাদের এই সমাজের ও পরিবারগুলোর অসাস্থ্যকর পরিবেশ ও আচরণ।
আজ চারদিকে ইন্টারনেট সংযুক্ত স্মার্টফোনের ছড়াছড়ি। মা বাবারা সন্তানদের বিরক্তিকর আচরণগুলো থেকে সাময়িক রক্ষা পাওয়ার জন্য স্মার্টফোন শিশুদের হাতে তুলে দেন, যার ফলে সন্তানদের যেসব বিষয় এখনই জানার কথা ছিল না, জানলেও নির্দিষ্ট সময়ের পরে অভিজ্ঞ কারো দিকনির্দেশনায় যা জানা উচিত ছিল, সেগুলোও তাদের কোমল মন ও মস্তিষ্কে স্থান পায়। তাদের প্রভাবিত করতে শুরু করে, যা সন্তানের আচরণেও পরিলক্ষিত হয়।
সন্তানের মানসিক চাহিদাগুলোও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরিবারে সচেতনভাবে ও অসচেতনভাবেও এড়িয়ে যাওয়া হয়। কতজন অভিভাবক নিজে আগ বাড়িয়ে সন্তানের হাতে হাতখরচ তুলে দেন?আমি নিজ দেখেছি সন্তানকে দিয়ে সময়ে অসময়ে কাজ করিয়ে যখন কাজে ফল আসে সেই ফলের সামান্য অংশও স্বেচ্ছায় পিতা সন্তানকে দেন না। যদি দিতেন সন্তান মানসিক প্রেষণাটা পেত। প্রেষণা জিনিসটা মানুষের কাজে আগ্রহ বাড়ায়, মানসিক উন্নয়ণ ঘটায়। আর শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেগুলো অমানবিক ও নিষ্ঠুরতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সেসব নির্যাতন শিশুদের শরীর ও মনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখা যায় শিশুর শৈশবকালীন সাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল জিনিসটাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যেখানেই দেখা যায় অনেক ছোটবেলা থেকে প্রতিযোগিতামূলক পড়াশোনা আর পরিক্ষার চাপে পড়ে ছোট্ট শিশুটিও বিষন্নতায় দিন কাটাচ্ছে। শিশুর আনন্দ ও খেলায় ডুবে বড় হওয়ার সময়টাতেই ওরা জিপিএ ও সিজিপিএ’র সমুদ্রে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। কিন্তু তারপরও টিউশনি সাজেশনস ও টেস্টপেপারসের পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক শিক্ষাটা কি ওরা পাচ্ছে? মূলত শিক্ষাটা কিন্তু পরীক্ষাপ্রাপ্ত গ্রেডে নয়, মানুষের চিন্তাধারা ও আচরণেই পরিলক্ষিত হয়।
কয়েকদিন আগে জানলাম, জাপানের স্কুলগুলোতে নাকি প্রাথমিক পর্যায়ে প্রথম তিনবছর কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয় না। শিশুদের শিক্ষামূলক ও আনন্দদায়ক কর্মসূচি পালন করা হয় ওই সময়গুলোতে। আমার মনে হলো, ঠিকই তো, পরীক্ষা মানেই এক একটা চাপ, যত চাপ তত বিষন্নতা।
আমরা যতই আমাদের সমাজিক ও নৈতিক অপরাধগুলোর জন্য অপরাধীদের দোষারোপ করি না কেন, আসলে পারিবারিক সুশিক্ষার চর্চা ছাড়া সেগুলো আদৌ নিরাময়যোগ্য কিনা তা আমার সন্দেহ আছে। আমাদের পরিবারগুলোতে শিশুদের উপর অগুনতি পরিমান উপদেশ বর্ষিত হয়। শিশুর পিতামাতা থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনরা পর্যন্ত উঠতে বসতে উপদেশ দিয়ে থাকেন। আমরা কি কখনও বিবেচনা করে দেখি শিশুর উদ্দেশ্যে দেওয়া উপদেশগুলোতে আদৌ কোনো যুক্তি আছে নাকি ব্যক্তিত্বহীন কেউ তার নিজের চিন্তাচেতনাগুলো উঠতি বয়সের কোমলমতি শিশুদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। অভিভাবকদের সেই বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
একজন শিশু একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি প্রশ্ন করে থাকে। এইসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েই তারা তাদের জানার পরিধিকে বিস্তৃত করে। এইসময় তাদের একটু যুক্তি দিয়ে যদি ভালোবাসার সাথে কিছু শেখানো হয় সেটা তাদের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। তাহলে একবার ভেবে দেখুন, এই সময়টাতে শিশুকে নৈতিকতা ও ইতিবাচক জীবনদর্শনের আলোকে শিক্ষিত করাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
শিশু কোনো প্রশ্ন করলে তার উত্তরটা যেন গুরুত্বের সাথে দেওয়া হয়। মানুষ হিসেবে আমরা কেউ শতভাগ নির্ভুল নই। লক্ষ্য রাখা উচিত অভিভাবকের কোনো ভুল যেন কোনো শিশুকে বয়ে বেড়াতে না হয়। শিশুর সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারটাও আজকাল খুব আলোচিত। নিঃসন্দেহেই সঙ্গীরা মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
পৃথিবীতে শিশুদের আমরাই নিয়ে আসি। সুতরাং তাদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ দেওয়া আমাদেরই অবশ্যকর্তব্য, দায়িত্বও। আমরা যদি তা দিতে না পারি তাহলে নৈতিকতার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে শিশুকে পৃথিবীতে আনার ব্যাপারটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সুন্দর, সুস্থ ও মানবিক একটা পৃথিবী সকল শিশুই প্রাপ্য। প্রতিটি শিশুই সুস্থ মানবিক পরিবেশে বেড়ে উঠুক, তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না হোক।