November 21, 2024
কলামফিচার ২

ভালো থেকো ফুল

প্রমা ইসরাত।। নেত্রকোনা সদরে ৪ জানুয়ারি সোমবার সকালে পৌর সদরের পারলা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একটা কাপড়ে মোড়ানো ছিলো শিশুটির লাশ। এই তথ্য অনলাইন একটা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিলো, কিন্তু ঘটনাটা সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে জানায় আমার স্কুলের স্কাউট বন্ধু সজীব। আমাকে বলে যে খবরে শুনেছে অনেক, সামনা সামনি এই দৃশ্য সে প্রথম দেখেছে, এবং সে এটা মাথা থেকে বের করতে পারছে না।

বাচ্চাটার গায়ে হাসপাতালের একটা ট্যাগ ছিলো, এবং আমার ধারণা সাদা কাপড় ওই হাসপাতালেরই, বাচ্চাটা জন্মের পরপরই হয়তো সেখানে ফেলে রেখে যেতে পারে কেউ। এই যে নবজাতক শিশু হত্যা, এই অপরাধের দায় কে নেবে?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক দম্পতির সুন্দর সুন্দর ছবি দেখি, যারা শিশু জন্মের আগে গর্ভকালীন ছবি তোলেন, অনেক ভালো লাগে দেখতে। ক্রিকেট স্টার সাকিব আল হাসানও যখন স্ত্রীর পেটে অনাগত সন্তানের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে চুমু খেয়ে সেই ছবি প্রকাশ করেন, আনন্দ হয়। শিশু, কত আকাঙ্ক্ষার শিশু।

শিশুকে বুকে নিয়ে পরবর্তীতে সেই পিতা মাতাদের আনন্দের ছবি আমি দেখি। গর্বিত পিতা মাতা, আর তাদের আদরের সন্তান।

কিন্তু খুব কষ্ট হয়, যখন বুঝতে পারি, যে পৃথিবীর সকল শিশুই কাঙ্ক্ষিত নয় , পৃথিবীতে সকল মা তার মাতৃত্বের জন্য গর্বিত নন, পৃথিবীতে সকল পিতাই স্বীকৃতি দেন না তার সন্তানকে। যেসব শিশুকে ফেলে রেখে যায় ডাস্টবিনে, ঝোপে ঝাড়ে আড়ালে, অন্ধকারে লুকিয়ে; সেসব শিশুরা মরে পড়ে থাকে একা, তাদের খেয়ে নেয় শেয়াল কুকুরে।

মানব জনম এতো তুচ্ছ!

নেত্রকোনার সেই নবজাতক শিশুটি ছেলে ছিলো। আমি ওর নাম দিলাম “ফুল”

তো ফুল এমন অপরাধের শাস্তি পেলো, যে অপরাধ সে করেনি। সে নিজের ইচ্ছেয় এই পৃথিবীতে আসে নি। তাকে জন্ম দিয়ে নিয়ে এসে, মেরে ফেলে রেখেছে কিংবা ফেলে রাখার জন্য মরে গেছে সে।

এই ফুলই যদি জন্ম নিতো কোন দম্পতির ঘরে, তবে তাকেও বুকে জড়িয়ে কত সুন্দর আহ্লাদ করতো সবাই। কত কত মানুষ হাহাকার করে একটি সন্তানের জন্য। কত চেষ্টা, ডাক্তার কবিরাজ পানি পড়া, মসজিদে মন্দিরে গীর্জায় যাওয়া, প্রার্থনা করা। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিজেদের ঘুম, শরীরের আরাম অর্থ সব ব্যয় করে নিজের শিশুকে বাঁচিয়ে রাখে পিতামাতা। কিন্তু সব শিশুর ভাগ্য এক রকম হয় না।

হুমায়ুন আহমেদের নক্ষত্রের রাত ধারাবাহিক দেখেছিলাম। মনীষা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, শমী কায়সার। বড় হওয়ার পর, মনীষা জানতে পারে যে তাকে কুড়িয়ে পাওয়া হয়েছিল হাসপাতালের পাশে ডাস্টবিনে। তার বিয়ে ভেঙে গেলো, নিজেকে তার নোংরা পোকা মনে হতে লাগলো, রাতের পর রাত তার ঘুম আসতো না। অথচ মনীষা ছিলো ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে মেধাবীদের একজন, যে স্কলারশিপ পেতো। তার বারবার মনে হতো, তাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলো, সে যে কতটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো, সেটা তার বারবার মনে হতো।

কারিতাস বাংলাদেশের সাথে পথশিশুদের নিয়ে একটা প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে আমি জেনেছি এই দেশে প্রায় ১১ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। কতটা অনাকাঙ্ক্ষিত বোধ হয় তাদের, জন্মেই দেখে এই পৃথিবী তার নয়, আশেপাশে নির্ভর করতে পারে এমন মানুষ নেই। বাবা কোথায় জানে না, মা ফেলে রেখে অন্য জীবন শুরু করেছে। তাদের জন্ম নিবন্ধন নেই, তারা দিনের প্রয়োজনীয় খাবার পায় না, স্বাস্থ্য সেবা জোটে না, খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয় না। যৌন সহিংসতা, মানসিক শারীরিক নির্যাতন সব কিছু থেকে সারভাইব করতে করতে একসময় নিজেই একজন অপরাধী হয়ে যায়। সমাজ, সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা বারবার বুঝিয়ে দেয় সে অনাকাঙ্ক্ষিত, এবং তার কোন স্বাভাবিক পরিচয় নেই।

শিশুদের জন্য শিশু সদন নেই পর্যাপ্ত। আর থাকলেও সেখানে এই নিশ্চয়তা নেই যে, সেখানে বাচ্চারা নিরাপদে থাকবে। সেখানেও থাকে নানান পাচারকারী চক্রের জড়িত থাকার আশংকা, পেডোফেলিকদের দ্বারা শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতার ভয়।

সুকান্ত লিখেছিলেন, শিশুদের জন্য তিনি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে যেতে চান, কিন্তু হচ্ছে না, কেননা শিশুদের জন্য এই রাষ্ট্রে যেকোন পরিচয়ের জন্য পিতার নাম প্রয়োজন। পথশিশুদের জন্মসনদ প্রক্রিয়া জটিল। পর্যাপ্ত শিশু সদন নেই, শিশুবান্ধব পরিকল্পনা নেই আলাদা। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থাকলেও, শিশুদের ফোকাস করে আলাদা কার্যক্রম অপ্রতুল।

শিশু জন্ম নেয়ার জন্য ভালোবাসার প্রয়োজন হয় না, সহিংসতার মাধ্যমেও শিশু জন্ম নিতে পারে। অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সেই নারী হয়তো শিশুটিকে জন্ম দিয়ে নিজের জীবন অন্যভাবে শুরু করতে চান। এই যে চাওয়া এতে কোন অপরাধ নেই। অপরাধ ওই ধর্ষকের। কিন্তু সে জন্য শাস্তি পেতে পারে না সেই নারী এবং শিশুটি। তাদের সুরক্ষার জন্য কোন কার্যক্রম নেই। শিশু দত্তক নেয়ার প্রক্রিয়া নেই, নিলেও সমাজের নাক সিটকানো মানুষকে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়।

সব শিশুর জন্য সমান ভালোবাসাময় দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো সকলের থাকবে না, কিন্তু রাষ্ট্রের তো থাকবে, কিন্তু কষ্ট হয় যখন রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়।

এইসব শিশু হত্যাকারীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শিশুকে যদি তার মাতা পিতা গ্রহণ না করতে চায়, তবে তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে, সেই ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]