নারীর প্রতি সহিংস মনোভাব এবং আমাদের অন্ধত্ব
তৌকির ইসলাম।। পৃথিবীর কোনো ধর্মই আমাদের সহিংসতা শেখায় না, অন্যায় শেখায় না, কিন্তু ধর্মের নাম দিয়ে আমরাই সহিংসতায় ব্যস্ত এবং নারীর প্রতি এই সহিংসতার মাত্রা যেন আরও বেশি।
ধর্মকে কেন্দ্র করে নিজেকে ধার্মিক প্রমান করতে গিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার কতকগুলো কারণ রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো আমরা ধর্ম জিনিসটাই বুঝি না, আমাদেরকে ধর্মের নাম করে শেখানো হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি, আমাদের ধর্ম পালন ধর্মীয় গুরুনির্ভর। আবার আমাদের তথাকথিত ধর্মীয় গুরুরা নিজেদের মধ্যকার কোন্দলে ব্যস্ত, ধর্মীয় গুরুর কাছে ধর্ম একটি ব্যবসা। অন্যদিকে নারীর প্রতি ধর্মীয় গুরুদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং ধর্মীয় গুরুদের প্রতি আমাদের অন্ধ বিশ্বাসও অন্যতম বড় কারণ।
দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ধর্মের ব্যাপারে বেশ আবেগি। আর এই ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে, সবাই নয়, তবে অধিকাংশ ধর্মীয় গুরু নিজের আখের গুছাচ্ছে। আর আমরাও ধর্মীয় গুরুর বক্তব্য শোনার ক্ষেত্রে তার বিদ্যার চেয়ে তার নূরানি চেহারা আর সুমধুর কণ্ঠের প্রতি বেশি আগ্রহী।
ধর্মীয় বক্তব্যের এক বিশাল অংশ জুড়েই থাকে নারী। এবং নারীর প্রতি কটু কথা, উস্কানিমূলক বক্তব্য, নারীকে খারাপ, অপয়া, নিকৃষ্ট ইত্যাদি বলে মন্তব্য করা- কোনো কিছুই বক্তব্যে বাদ থাকে না। আর নারীর প্রতি পূজনীয় গুরুর এইসব বিরূপ মন্তব্য আবেগি ধার্মিকের মনে বেশ ভালই প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু জনসম্মুখে মানুষ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করা কি কোনো ধর্ম সমর্থন করে! আমার জানামতে কোন ধর্মই করে না।
একজন ব্যক্তি তার জীবনে আস্তিক কিংবা নাস্তিক হবেন- এটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং একজন মুসলিম হিসেবে আমি জানি মহানবী (সা.) মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আমাদের তথাকথিত ধর্মীয় গুরুরা হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল- এদের মৃত্যুর পর উল্টাপাল্টা কথা বলে বক্তব্য দিয়ে ময়দান গরম করেছেন।
আমাদের দেশ এবং ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের উপর বক্তব্য রাখতে গেলে গুরুরা নারীর পর্দা নিয়ে অনেক কথা বলেন এবং ধর্ষণের জন্য দায়ী করেন এই ইস্যুটাকে। পর্দা নিয়ে আমার কোন তর্ক নেই, আপনি ধর্মীয় অনুশাসন মানবেন কিনা তা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আমি আমার ক্ষুদ্র ধর্মীয় বিদ্যায় যতটুকু জানি ইসলাম ধর্মে পর্দার কথা পুরুষের জন্যও বলা হয়েছে, সর্বদা দৃষ্টি সংযত রাখতে বলা হয়েছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে এবং আরও অনেক কিছুই। এসব ব্যাপারে গুরুর বক্তব্য বড়ই থিওরেটিকাল, কিন্তু নারীর প্রতি হলেই যে বক্তব্য হয়ে যায় সহিংস।
কেউ কেউ তো নারীর চরিত্র টানাটানি করতেও পিছুপা হন না। এর একটি কারণ হতে পারে গুরুর সামনে বসে থাকা সকল শ্রোতা পুরুষ এবং গুরু নিজেও পুরুষ। আমি অবশ্য এটির একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ খুঁজে পাই আর তা হলো নারীর প্রতি সহিংস বক্তব্য আমাদেরকে পৈশাচিক আনন্দ দেয়, এমন কি একজন নারী যদি সঠিক কোন কাজও করে থাকে আর ধর্মীয় গুরু যদি তার বিরুদ্ধে বলে, তাতেও আমরা সায় দেই কারণ নারী যে বড় কিছু করতে পারে, নারীরও যে বিদ্যা বুদ্ধি মেধা রয়েছে তা আমরা এখনও হজম করতে পারি না।
প্রতিবেশী দেশের দিকে যদি একটু তাকাই, তাহলে সেখানেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাব। ধর্মীয় গুরুরা সেখানে ধর্মের নামে নারীকে কতটা খারাপভাবে ব্যবহার করছে তা হয়তো আপনি আধুনিক প্রতিবেশী দেশের কিছু আধুনিক শহর ঘুরেফিরে বুঝতে পারবেন না। নারীর প্রতি সহিংসতার একটা বড় নজির পাওয়া যায় তখনই যখন প্রতিবেশী দেশের খ্যাতনামা গুরু আশ্রমের মেয়েদের ধর্ষণ করে আইনের আওতায় আসেন আর তার মুক্তির জন্য ভক্তরা রাস্তায় আন্দোলন করে। আর পর্দা দিয়ে যে ধর্ষণ ঠেকানো যাচ্ছে না তার প্রমাণ তো আমাদের দেশে তথাকথিত হুজুর কর্তৃক মাদ্রাসার ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা। এবং খুব আশ্চর্য হই যখন কোন ধর্মীয় গুরু এসবের প্রতিবাদ করেন না।
জাতি হিসেবে আমরা অধিকাংশই আসলে ঠিক প্রকৃত ধর্মপ্রাণ নই, বরং আমরা বেশিরভাগই ধর্মীয় গোঁড়ামিতে অভ্যস্ত। আমরা ধর্মীয় গুরুদের হাতে ধরা পুতুলের মত। মহানবী (সা.), শ্রীকৃষ্ণ, যিশু, বুদ্ধ- তাঁরা যে ধর্ম পৃথিবীতে প্রচার করেছিলেন, আর আমাদের ‘প্রিয়’ গুরুরা যা আমাদের শেখাচ্ছেন তার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। তাই অপেক্ষা করি কবে আমাদের বোধ বুদ্ধি বিবেক জেগে উঠবে আর আমরা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও দর্শন উপলব্ধি করতে পারবো।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]