পুরুষের এ কেমন অযৌক্তিক আবদার!
মৌসুমি চৌধুরী।। যখনই কাউকে বলতে শুনি যে, “আমি আমার স্ত্রীকে দিয়ে চাকরি করাবো না”- বেশ গর্বিত একটা কণ্ঠস্বর যেন কানে ভেসে আসে। মনে হয় শুনতে পাই নিত্যদিন তার বাজখাঁই গলায় স্ত্রীকে দমিয়ে রাখার তীর্যক শব্দ বাণ। আবার অনেক নারীও আছেন যারা অহংকার নিয়ে বলেন, “আমার স্বামী একাই সংসার চালাতে পারে, তাই আমাকে চাকরি করতে দেয়না।”
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখতে চাই যে, কে চাকরি করবে আর কে চাকরি করবে না সেটার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে। নারী বলে তার হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কোন পুরুষের হয়ে যায়নি।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ নিজের ভালো-মন্দ বিবেচনা করে যেকোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাবা/ভাই/স্বামী কিংবা অন্য কোন পুরুষ তো দূরের কথা অন্য কোনো নারীও তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে বাধা না হোক। স্বাধীন মত প্রকাশে চাপ সৃষ্টি করার যে প্রবণতা তা সমাজ থেকে দূর হওয়াটা খুব জরুরি বলে মনে করি।
আবার চাকরিজীবী নারীদের হেয় করে বিভিন্ন সময়ে কতিপয় পুরুষের মন্তব্য দেখি যা অনেকটা এমন,
“সংসারে অভাব না থাকলে কি মহিলা চাকরি করতে বের হয়? এদের ঘরের পুরুষেরা কি করে? বৌয়ের কামাই খায়! বৌ পালার সামর্থ্য নাই!”
প্রথমত, মানুষ স্বনির্ভর না হলে প্রকৃত সম্মান পায়না। আপনি মুখে যতই বলুন না কেন সম্মান করেন, কিন্তু কার্যত সম্মান জিনিসটা আসে মানুষের স্বাধীনতার সাথে। ব্যক্তি তার স্বাধীনতা পায় অন্যের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা থেকে মুক্তির মাধ্যমে।
দ্বিতীয়ত, এদের ঘরের পুরুষেরা মানুষকে মানুষ ভাবে, লিঙ্গ দিয়ে শ্রেণিভেদ করেনা। যেমনটা ঠিক আপনারা করেন, পুরুষ মানে উচ্চশ্রেণী আর নারী মানেই বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনায় আপনার চেয়ে কম। তাই তার জীবনের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আপনি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় করবেন।
তৃতীয়ত, শ্বশুর কিংবা সম্বন্ধীর থেকে টাকা চেয়ে খাওয়ার চেয়ে বৌয়ের কামাই খাওয়া উত্তম। গৃহিণী নারীদের যে যৌতুকের জন্য নির্যাতন সইতে হয় তা ক’জন কর্মজীবী নারীর সাথে ঘটে। নিজের পরিচয়ে যে নারী বাঁচে তার সাথে অন্যায় হলেও সে প্রতিবাদ করার সাহস রাখে।
চতুর্থত, নারীরা হাতি-ঘোড়া কিংবা গৃহপালিত পশু-পাখি নয় যে আপনি তাদের পালবেন।
আরেকটা কথা কি জানেন, এই আপনাদের মতো হামবড়া স্বভাবের পুরুষদের জন্যই আকস্মিক কোন দুর্ঘটনায় স্বামী গত হলে বেশিরভাগ নারী বিপাকে পড়েন। কিছুদিন আগেই একজন সদ্য বিধবা নারীর আত্মীয়র মুখে জানতে পারি যে, তার প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়েছিলো কিন্তু তখন স্বামীটি করতে দেয় নাই। একবার ভাবুন তো সেই মহিলা এখন তার দুই সন্তানসহ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন! শ্বশুরের ভিটেমাটি আঁকড়ে গ্রামে পরে থাকলেও অন্ন জোটাবে কে?
অমুকের বৌ, তমুকের মা এই নামগুলোর চেয়ে নিজের নামে পরিচিত একজন নারীকে দেখে আপনাদের হিংসা হয়। আর তাই কুৎসা রটান। নারীকে দমিয়ে রাখার সহজ অস্ত্র তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা।
“পরের চাকরি করে যে সে চাকরানি আর ঘরে থাকা মানেই রাজরানী”- এইসব সস্তা বুলিতে ভুলিয়ে ভালো মেয়ের তকমার লোভ দেখিয়ে গৃহবন্দী করে কি করে নারীদের পরাধীনতার শেকল পরানো যায় তা এই সমাজ ভালোই জানে।
সংসারের সকল কাজের দায়িত্ব নারীর একার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে দাসীবাদীর মতো খাটিয়ে আবার ‘‘তোমার সংসারে তুমি রাজত্ব করছো’’ বলা আর গাধাকে ঘোড়া বানানোর চেষ্টা একই কথা।
কোনো নবজাতক কন্যা শিশুকে পথের ধারে কিংবা হাসপাতালে ফেলে গেলে অনেকেই বলে ওঠে, ‘‘কেমন মা’’ কিংবা ‘‘মা হয়ে কি করে পারলো ফেলে যেতে…!’’
কই একবারও তো বলেন না যে, কেমন বাবা কিংবা বাবা হয়ে কি করে পারলো!
যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নারীর ছিল তা হরণ করে আবার তার ঘাড়েই দায় চাপান!
কন্যা সন্তানের চেয়ে বেশি পুত্রের আশায় একাধিক সন্তান গ্রহণ নারীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় জানা সত্ত্বেও তা করেন আবার জোর গলায় মিথ্যাচার। বাবা হবার দায়িত্ব বলতে কি কিছু নেই? মহিলাদের ঢাল বানিয়ে সামনে রেখে আড়ালে পলায়ন করে আর কতদিন বাঁচবেন।
নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে এত এত প্রচারণা কি আপনাদের চোখে পড়েনা? ঘন ঘন সন্তান গ্রহণ জরায়ু ক্যান্সারের কারণ- না জানা থাকলে জেনে নিন।
নারীকে নজরবন্দী করার চেয়ে বরং নিজেদের অনিয়ন্ত্রিত কামনা বাসনার দিকে নজর দিন, এত এত ধর্ষণ আর শিশুকামী মানসিকতার প্রমাণ চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও কি করে নারীদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন!
সিগারেট-মদ খাবেন, যৌনপল্লীতে যাবেন, তারপর যত্রতত্র নিয়ন্ত্রণও হারাবেন, কিন্তু বলে বেড়াবেন যে নারীকে কঠোর অনুশাসনে থাকতে হবে- এ কেমন অযৌক্তিক আবদার!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]