তবু, এবং, কিন্তু ছাড়াই সুন্দর!
লীনা দিলরুবা শারমিন।। সুন্দর শব্দটার প্রতি বাঙালির লোভ আছে না বিতৃষ্ণা সেটি বোঝা ভার। বিতৃষ্ণাই বোধয় আছে। তবে তার ওজন মেপে দেখার সামর্থ্য আমাদের নেই। অসীম প্রতিযোগিতার এই বোধ শূন্য মাঠে শুধু গায়ের রঙের জোরে বাজিগরের মতো সব জিতে নিতে দেখলে যেমন হিংসে হয় তেমন কালো রঙটির প্রতি আমাদের অশ্রদ্ধা একেবারে বাড়াবাড়ি রকমের।
কালো শুধু বুকে তুলে রাখি শোকের দিনে। সাদা পাঞ্জাবীতে সাদা পিনে আটকে থাকা এক টুকরো কালো শোক প্রকাশ করে নাকি মানব জাতির মূর্খতা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসে সেটা কিন্তু আমরা ঠিক জানি না। এসব যা তা কথা জানার কোনো প্রয়োজন আমরা অন্তত দেখি না।
আপনার বয়স যদি ত্রিশের আশেপাশে হয় তাহলে খুব সম্ভাবনা আছে ছোটবেলার অন্তত একটি ছবিতে হলেও কপাল জুড়ে একটি কালো টিকা পরার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আপনার হয়েছে। এবং জীবনে অন্তত একবার হলেও আপনি শুনেছেন, জন্মের সময়/ ছোটবেলায় কী ফর্সা সুন্দর ছিল! কালো তো হলো রোদে ঘুরে ঘুরে। ভিটামিন ডি গায়ে না দিলে এক সময় যে হাড় ক্ষয় রোগে ভুগতে পারেন এই তথ্য আমাদের জানা না জানার দরকার নেই। আমাদের ফর্সা হতে হবে। রোদে ঘোরা যাবে না, দুধ চা খাওয়া যাবে না! কালো হয়ে যাবে। মানুষের গায়ে কালো টিকা দেয়া হয়েছে যেন সৌন্দর্যে নজর না লাগে। যে সংস্কৃতিতে কালোকে অশুভ আর অসুন্দর বিশ্বাস করা হয়, সেখানে আর কী আশা করেন?
ধরুন আপনার বয়স ২২। গায়ের রঙ কালো। বিদেশ থেকে আপনার এক আত্মীয় বাসায় বেড়াতে এসেছেন। ধরে নেয়া যাক, সে আপনার খালা। হতে পারে, আপনার মায়ের খালা। বা আপনার বাবার ফুপু। বলুন তো, তারা আপনার জন্য কী আনবেন? আপনি বাবা মায়ের পুত্র সন্তান হলে সম্ভাবনা আছে টিশার্ট থেকে শুরু করে মোবাইল পর্যন্ত পাওয়ার। কিন্তু আপনি যদি মেয়ে হন তবে অধিকাংশ বাঙালি পরিবারে উপহার হিসেবে আসে সাবান, শ্যাম্পু এবং রঙ ফর্সা করার ক্রিম।
রঙ ফর্সা, সোজা মসৃণ চুল, ডাগর চোখ, পাতলা নাক, ভারি ঠোঁট নারীকে কত স্তরে সুন্দর হতে হয়। অথচ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের মাপকাঠি একেবারে টইটম্বুর হয়ে ওঠে একটু লম্বা হলেই। পুরুষকে দোষ দিচ্ছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যারা বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে কটু কথা শুনিয়েছেন তাদের অধিকাংশই নারী। এবং কালো রঙ নিয়ে যতসব কুসংস্কারে তাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
সৌন্দর্যের প্রতীক সাদা বলে সস্তা রঙ ফর্সাকারী ক্রিমে আমাদের খুব আগ্রহ। তাতে ঘি আর গু এক সাথে ঢেলেছে ফেয়ার এন্ড লাভলী ধরনের বিজ্ঞাপনগুলো। সৌন্দর্য যে মানুষের আত্মবিশ্বাসের সাথে মিশে আছে, সৌন্দর্য মানে যে এক মুঠ হাসি সেটি আমাদের শিক্ষায় নেই।
সিনেমায় দেখেছি কালো মেয়ের বিয়েতে যৌতুক লাগে, ফর্সা মেয়ে দেখিয়ে ঘোমটার আড়ালে কালো মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়া হয়, কালো মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে কথা শোনে, খুঁটির সাথে দাঁড়িয়ে আঁচলে আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে চোখের পানি ফেলে। কালো হওয়াটা কি কোনো অপরাধ এই প্রশ্ন করে স্বামীর কাছে চড় খেয়ে উপুড় হয়ে কেঁদে বিছানার চাদর ভেজানোর শিক্ষা যুগের পর যুগ ধরে এসেছে। যেখানে নারী কালো হলে তার দোষের শেষ নেই সেখানে কৃষ্ণ কালো পুরুষের অঙ্গে একেবারে রূপ যৌবন ঢেলে দেয়ার মতো করে বলা হয়।
মানুষকে সুন্দর ভাবতে শেখার জন্য বুদ্ধি দরকার আছে। সুশিক্ষা, ভালো মানসিকতা আর নিরপেক্ষ বিচার বোধও অনেক দরকার। আপনি আরেকজন মানুষকে কীভাবে দেখবেন সেটি শেখার জন্য প্রচুর পড়ালেখাও দরকার হয়।
আপনি চাইলেই কাউকে কালো বলতে পারেন। ‘কিন্তু, এবং, তবু’ দিয়ে কালো বলার দরকার নেই। কালো কিন্তু চেহারা সুন্দর কথাটি কোনোভাবেই প্রশংসা করা না। তা আপনি বোঝেন বা না বোঝেন। যাকে বলছেন তিনিও যদি না বোঝেন তাতেও এটি কোনো ইতিবাচক কথা না।
কালো শুনলে কখন খারাপ লাগে জানেন? যখন কালো বলার মাধ্যমে আপনি বৈষম্য সৃষ্টি করেন। কালোটাকে গালির মতো করে বলেন। বা চোখে আঙুল দিয়ে বলেন এই নানা ট্যাবুতে ভর্তি সমাজে গায়ের রঙ দিয়ে মন জয় করার প্রতিযোগিতায় এই মেয়েটি শুরু থেকেই বাদ পড়ে গেছে। আপনি কি একবার জানার চেষ্টা করেছেন কালো বলে মেয়েটির একান্ত নিজের কোনো দুঃখ আছে কিনা?
আমি জানি, প্রতিটি মানুষ নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানে। নিজেদের চোখে তারা নিখুঁত। নানা সময়ে খুব সহজভাবে অবলীলায় মানুষের মুখে শুনে শুনে এক সময় মানুষ নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং আশেপাশের একেবারে যা তা কথা বিশ্বাস করে। ওই যে, বাঘ এসেছিল শুনে পাড়ার লোকে বারবার বিশ্বাস করেছিল সত্যিই বাঘ এসেছে। তা রাখাল এরপর নিজেই বাঘের সন্ধানে গেছে নাকি সত্যিকারের বাঘ এসেছিল তার কাছে, সে কথা কিন্তু আমরা কেউ জানি না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]