নারী: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও অগ্রগতির প্যারাডক্স
শাহরিয়ার সামস সামি।। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর ঐতিহাসিক ক্ষণে বাংলাদেশ। এ পঞ্চাশ বছরে আছে গৌরবময় ইতিহাস, আছে কলঙ্কিত ইতিহাস; আছে স্রোতস্বিনী সময়ের জোয়ার-ভাটাতে টিকে থাকা একটি রাষ্ট্রের রূপান্তরের গল্প। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের ‘রাষ্ট্র’ বিনির্মাণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তা এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর রোল-মডেল এ রূপান্তরিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। অন্তত দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত এ দাবিকেই সমর্থন করে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও অগ্রগতির সমষ্টিগত অগ্রগতির চিত্র হলো এই তথ্য-উপাত্তগুলো।
বিগত ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলার রেনেসাঁস এর মাধ্যমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে নারী-জাগরণের সূচনা হয়েছিল। বিশেষ করে, বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ায় বেগম রোকেয়ার হাত ধরে শিক্ষার মাধ্যমে নারীজাগরণ এর যে আন্দোলনের শুরু, তা গত একশ বছরে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় মনে করতেন প্রথম বাংলা রেনেসাঁ অবিভক্ত বাংলার এবং তা এখনও অসম্পূর্ণ এবং দ্বিতীয় রেনেসাঁ হয় বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মধ্য দিয়ে এবং তা পুরোই ঢাকা-কেন্দ্রীক। এটি তাঁর বই ‘বাংলার রেনেসাঁস’ এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, সে হিসেবে তো বটেই, বাঙালি জাতির মুক্তির চূড়ান্ত উন্মেষ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হওয়া এ দেশের রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সুবর্ণজয়ন্তীও ধরা যায় এ সময়কে।
আমরা জানি, যেকোনো রাষ্ট্রের প্রধান অনুষঙ্গ জনগণ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নের প্রধান স্বরূপ নির্ধারণ হয় জনগণের বিকাশ ও উন্নয়নে। যেহেতু, বাংলাদেশের জনগণের অর্ধেক নারী, তাই দেশের অগ্রগতির স্বার্থে নারীর বিকাশ, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে লিঙ্গের সমতা প্রতিষ্ঠা জরুরি। নয়তো যেকোনো অগ্রগতি ‘ছদ্ম অগ্রগতি’-তে পর্যবসিত হবে।
বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নানা পশ্চাৎপদতা ও হাজার বছরের লালিত প্রবল পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতার বিপরীতে তৎকালিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হলেও, তা ছিল সংশয়পূর্ণ এবং কণ্টকময়। সময়ের সাথে সাথে, অবস্থার উত্তরণে নানা আইন, নীতিমালা এবং উদ্যোগের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিতায় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রাও আজ ইতিবাচক ধারায় দৃশ্যমান। যদিও পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়- উদ্যোগগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রকট পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব দ্বারা আরোপিত ও প্রয়োগিত; ফলে লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে সত্যিকারের নারীমুক্তি এখনও সুদূর পরাহত। এ প্রেক্ষাপটে, প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়।
যাহোক, নারী মুক্তি বা বিকাশ, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য দিক হলো- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়ন। একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বাংলাদেশে নারীর বিকাশ ও ক্ষমতায়নের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিলো নারীকে শিক্ষিত করার মাধ্যমে নারীর সত্তার পরিচয়ের স্বরূপ উন্মোচন, বিকাশ ও ক্ষমতায়ন করা। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থাতেই মেয়েদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু নারী-শিক্ষামুখী বিভিন্ন নীতিমালা, প্রণোদনা ও উপবৃত্তির মাধ্যমে আজ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ শুধু বেড়েছে বললে ভুল হবে, বরং এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের সমতা নিশ্চিত হয়েছে বলা যায়। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতায় আজও উচ্চ শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুসারে, তখন দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮.৩ শতাংশ ছিল ছাত্রী। ২০১৯ সালের রিপোর্ট বলছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়েদের অংশগ্রহণের হারের উত্তরণ ঘটেছে যা ৫১ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ হার কিছুটা কম, ৩৮ শতাংশ; যদিও ৭০ দশকের শুরুতে ১০-১২শতাংশ ছিলো। এছাড়া, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী যেখানে ২০১১ সালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, তা এখন ৭১ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার সর্বস্তরেই নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে এবং পরিষ্কারভাবে, এ অংশে অভাবনীয় অগ্রগতির চিত্র নির্দেশ করে।
শিক্ষার পাশাপাশি, নারীর বিকাশ ও ক্ষমতায়নের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো হলো নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান উন্নতির দিকে নির্দেশ করে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারীর অংশগ্রহণ ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির। আজকের বিশ্বে যে ক্ষুদ্রঋণের কারণে বাংলাদেশ আলোচিত, তার বিশেষত্ব হল ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের ৮০ শতাংশই গ্রামীণ নারী। ক্ষুদ্রঋণের কারণে গড়ে ওঠা পাঁচ লক্ষের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মধ্যে তিন লক্ষেরও উপরে নারী নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সংগ্রামরত এবং অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক সাফল্যের দাবিদার। তাছাড়া পোশাক শিল্পের বড় অংশ হলো নারী শ্রমিক অর্থাৎ দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার- পোশাক শিল্প নারী নির্ভর। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে বাড়ন্ত শিক্ষার হার, সচেতনতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও অর্থনীতির বাস্তবতায় নারী অংশগ্রহণ সর্বত্র। বিদেশে গিয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে শুরু করে কৃষিকাজ, উদ্যোক্তা হওয়াসহ সমাজের বিভিন্ন অর্থনৈতিক পেশায় আজ রয়েছে নারীর কৃতিত্বপূর্ণ বিচরণ।
নারীর বিকাশে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে পোক্ত করতে প্রয়োজন নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়ন। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে অনেক, বিশেষ করে সর্বোচ্চ পর্যায় নারী নেতৃত্বের সফলতা রীতিমত ঈর্ষনীয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরের ২৯ বছর ধরে বাংলাদেশের সরকার প্রধান নারী। নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছাড়াও জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রোভিসি, রাষ্ট্রদূত, নির্বাচন কমিশনার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী, কর্মকর্তা বা প্রধান হিসেবে নারীর ভূমিকা সাফল্যমণ্ডিত। যে কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের এ চিত্র রোল মডেল হিসেবে ধরা হয়।
বিকাশের এহেন চিত্র থেকে বলা যায়, বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতার মাধ্যমে নারী মুক্তির পথে বহুদূর এগিয়েছে। কিন্তু এ সফলতা আসলে চূড়ান্ত নয়। কারণ লিঙ্গ সমতা এখনো সর্বোপরি প্রয়োগ হয় না এবং সার্বজনীন নয়। তাছাড়া, সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রে এমন কিছু গুরুতর প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যেগুলো সমাধান ব্যতীত কাঙ্ক্ষিত সফলতা অসম্ভব। সময়ের সাথে সাথে এ প্রতিবন্ধকতাগুলোও পাল্লা দিয়ে প্রতীয়মান হচ্ছে অর্থাৎ অগ্রগতির বৈপরীত্য বিরাজমান। তাই,আপাত এ সফলতাকে প্যারাডক্সিক্যাল উন্নয়ন বা বিকাশ বললে ভুল হবে না।
নারী অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, যখন সাধারণ জনগণ নারী ক্ষমতায়ন বলতে শুধু সমাজে নারীর অংশগ্রহণকেই বুঝে। সিদ্ধান্ত ও অংশীদারভিত্তিক ক্ষমতার সুষম বন্টন অস্বীকার করা হয় বলে নারীর প্রকৃত ক্ষমতা যে প্রতিষ্ঠিত হয় না- এটি সাধারণ জনগণের বোধে আসে না। ফলে, প্রতিপদে নারী বাধা ও বৈষম্যের চূড়ান্ত শিকার হয়। যদিও বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষকে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছে। এর সমর্থনে নানা আইন ও নীতি প্রণীত হয়েছে। নারী-পুরুষ সমতার পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করে অনেক আন্তর্জাতিক দলিলেও বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। তবুও এদেশে নারী-পুরুষ সমতা, প্রবল পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে লিঙ্গ-বৈষম্যও রয়ে গেছে। এ সমাজে তাই পুরুষই প্রধান চরিত্র এবং নারী মার্জিনালাইজড; চিন্তক দেরিদার ডি-কন্সট্রাকসনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আলো ফেলা যায়; যার গন্তব্য নারীবাদের পথ।
নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক মানসে গড়ে ওঠা সমাজ এখনও গ্রহণ করতে পারেনি। সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক ও বাহক পুরুষ ও নারী উভয়ই। কারণ মনস্তাত্ত্বিকভাবে ও কর্মে নারী এখনও পরাধীন এবং পুরুষ কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী প্রভু। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আরোপিত নিয়ম বা প্রথাগুলোকে নারী কখনো তার পরিচয়, বিকাশের সহায়ক, সামাজিক ভূমিকা বা অধিকার বলে ভুল করে। Malevolent Paternalism কে মনে করে বিকাশ ও ক্ষমতায়নের উদার ও গ্রহণযোগ্য পন্থা। আর তাই, এখানে দরকার হয় নারীবাদের শিক্ষা।কারণ বেশিরভাগ নারী, এমনকি শিক্ষিতরা জানে না সমাজে তার পরিচয়, ভূমিকা এবং বিকাশের সত্যিকারের পন্থা। ‘নারীবাদ’ নারীর সত্তার প্রকৃত পরিচয় দেয়। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় থেকে নারীবাদের চর্চা না থাকায় সমাজের মার্জিনালাইজড বা অগুরুত্বপূর্ণ নারীকে ভোগবস্তু হিসেবে সাব্যস্ত করে। পুরুষ নারীকে ভোগ সামগ্রীর মত ব্যবহার করে বা কামনা করে। এদিকে, নারী স্বয়ং নিজেকে সচেতন বা অবচেতনভাবে ‘ভোগ-বস্তু’ হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে পুরুষ বা সমাজের অনুগ্রহ কামনা করে অথবা নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয় যেন পুরুষের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দ্বারা সমাজের মূলধারায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে বা টিকে থাকে। এ এক পরাধীন সত্তা। এ কারণে, ‘ভোগ-বস্তু’ যেকোনো বয়সী নারীকে যখন তখন যেকোনো শোষণ ও নির্যাতনের মধ্যে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভয়াবহ যৌন সহিংসতা এবং মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ভিতর দিয়ে যায়। সেই সাথে, সামাজিকতার ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে নারী স্বয়ং অথবা পরিবার এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে না, বরং সচেতন বা অবচেতনভাবে এ অপরাধগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। এমনকি অপরাধকে চিহ্নিত করার মত জ্ঞানও অনেকে রাখে না, বরং মনে করে এটা পুরুষদের অধিকার বা ‘প্রভু’ পুরুষরা এরকম এক-আধটু করতেই পারে।
এদিকে নারী বিকাশের অনুষঙ্গ নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও প্রতিবন্ধকতার মুখে। তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ শীর্ষক সূচকে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১, যা ২০০৬ সালে ছিল ১০৭। জন্মের পর থেকেই নারীকে ‘বোঝা’ হিসেবে চিহ্নিত করা এ সমাজ এখনও মনে করে শিক্ষিত হলেও নারীর প্রধান কাজ বিয়ে, সন্তান লালন-পালন ও গৃহস্থালী কাজ। যার ফলে শিক্ষার চেয়ে বাল্য-বিবাহ দিয়ে ‘বোঝা’ হালকা করার প্রথা এখনও বিদ্যমান। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বাড়ছে বটে, সে অনুপাতে কর্মজীবী শিক্ষিত নারী বাড়ছে না। আর কাজে যোগ দিলেও জৈবিকতা, সমাজ আরোপিত বাস্তবতা এবং কখনো মানসিক ও সামাজিক সহিংসতার শিকার হয়ে একসময় চাকরি ছেড়ে গৃহ সামলানোতে মনোনিবেশ করছে কর্মজীবী নারী এবং একে নিজের পরিচয় বলে মেনে নিচ্ছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও লিঙ্গ-বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারী-নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও, এখনও কোটা বা প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্বই নারীর মূল রাজনৈতিক পরিচয়। সরাসরি নির্বাচন ও ক্ষমতার অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতা নারীর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। রাজনীতিতে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, উগ্র ধর্মীয় নারীবিরোধী আগ্রাসন, অর্থ, প্রতিপত্তি ও পেশীশক্তির চর্চা ও প্রয়োগ এর প্রধান কারণ। রাষ্ট্রও নারী নেতৃত্ব বিকাশে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ছিল যে দলের সর্বস্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় এক-তৃতীয়াংশ নারীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে। সেটা এখনো কার্যকর করা হয়নি। ফলে সর্বোচ্চ পর্যায় ছাড়া কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়নি।
এদেশের নারী-পুরুষের সমতা সৃষ্টিতে সকল অগ্রগতির একটি সাধারণ ও গুরুতর প্রতিবন্ধকতা হলো উগ্রবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী; যারা এ একুশ শতকে এসেও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক পশ্চাৎপদতার সুযোগে মানুষের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে নারীবিরোধী রক্ষণশীলতাকে উসকে দিচ্ছে, যা প্রকারান্তরে নারীর প্রতি ঘৃণ্য আচরণ ও সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। নারী নেতৃত্ব ও বাইরে কাজ করা হারাম এবং প্রাথমিকের পর নারী শিক্ষা অপ্রয়োজনীয়, এ জাতীয় ফতোয়া দিয়ে নারীর অগ্রযাত্রা তো বটেই, বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীন চিন্তার বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকেও রুখে দিতে বদ্ধপরিকর কদর্য পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক এ উগ্রবাদী গোষ্ঠী।
তাহলে আমাদের আলোচিত অগ্রগতি কি মিথ্যে? না, মিথ্যে নয়। টেকসই উন্নয়নের অংশ হিসেবে লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসিত। এ অগ্রগতি নারী উত্তরণের অংশবিশেষ এবং জরুরি। সাথে জরুরি সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা। রাষ্ট্রকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রত্যাশা, সার্বিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক এবং নারীবাদ চর্চা ও প্রয়োগের মাধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্যহীন সুষম, সাম্যবাদী সমাজ উঠুক। লিঙ্গব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটুক। সর্বোপরি স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উন্নত বাংলাদেশ হোক।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]