November 2, 2024
কলামফিচার ৩

নিজের অবস্থা দিয়ে সব নারীকে বিচার করবেন না

আঞ্জুমান রোজী।। অধিকাংশ মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করি। তাহলো, নিজেকে বা নিজের অবস্থান দিয়ে অন্যকে কিংবা পুরো জনগোষ্ঠীকে বিচার করা। এই প্রবণতাটা বেশিরভাগ নারীর মধ্যে প্রকট। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে পারিপার্শ্বিক বা সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে মূল্যায়ন বা বিচার করছে। এসব নারীর চোখ নিজস্ব গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে তারা কিছুই দেখে না, ভাবেও না। এদের মধ্যে অনেক নারী শিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং নিজ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। এই শ্রেণির নারীর সঙ্গে কথা বলে লক্ষ্য করেছি, এরাও নিজ অবস্থান দিয়ে সমগ্র নারী সমাজকে বিচার করছে। আমি এদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আজকাল ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ইচ্ছে করে না আর এদের সঙ্গে কোনো তর্কে জড়াই।

বিষয়টা হচ্ছে বাংলাদেশে শতকরা কতভাগ নারী স্বাধীন চিন্তাচেতনায় চলার ক্ষমতা রাখে? যেসব নারী এই ক্ষমতা রাখে না তাদের সামাজিক অবস্থান কেমন? কোন প্রেক্ষিতে নারী মাথা উঁচু করে চলতে পারছে না? জন্ম থেকে নারী কি নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারছে? এ জাতীয় অনেক প্রশ্ন নিয়ে আজ পর্যন্ত লিখে যাচ্ছি। যাতে প্রশ্নগুলো চিহ্নিত করে সমাজের চোখকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারি; বোঝাতে পারি নারী কেন তার ন্যায্য অধিকার নিয়ে এগিয়ে যেতে পারছে না; যেই অধিকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর প্রাপ্য।

নারীর অধিকার আদায়, নারীর স্বাধীনতা অর্জন, এমনকি নারীও যে একজন মানুষ সেই বিষয়ক লেখা লিখতে গিয়ে আমাকে  নারীবাদ নিয়ে পড়তে হচ্ছে, চলে যেতে হচ্ছে দু’শত বছর আগের ইতিহাসে। যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বা কাজ করতে হলে তার ইতিহাসটা জানা জরুরি। কারণ, আজকে নারীদের যে অর্জন তার পেছনে মহীয়সী নারীদের ত্যাগ তিতিক্ষার বিশাল ইতিহাস রয়েছে। আমি তাঁদেরকে স্মরণ করে এবং তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে নারী সংক্রান্ত লেখালেখির কাজ করি। পূর্বসূরিদের কথা মনে না রেখে এগিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। ইতিহাস মনে রাখছে না বলেই তো বাংলাদেশের অবস্থা আজ হযবরল হয়ে আছে। যে কোনো কাজের ভিত্তি তৈরি করতে হলে পূর্বসূরিদের কথা মনে করতেই হবে, সেইসঙ্গে ভাবতে হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা। তাহলেই না পরিবর্তন আসবে!

কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? অধিকাংশ নারী, যারা বিশেষত সোনায় সোহাগা হয়ে বড় হয়, তাদের তো কোনো বাস্তব জ্ঞানই থাকে না। এমনকি যারা চড়াই-উৎরাই করে এক পর্যায়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন তাদেরও লক্ষ্য করে দেখেছি বাস্তব বিবর্জিত কথা বলতে; নারী স্বাধীনতার ইতিহাস জানা তো দূরে থাক। এরা অবশ্য নিজের মুক্তির পথ খুঁজে বের করলেও অন্যকে মুক্তির পথ দেখায় না। এরাই নিজের অবস্থান বা তার অর্জনকে বড় করে তুলে অন্য দুর্বল নারীর অবস্থানকে হেয় করছে, করছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। এরা ভুলে যায় প্রত্যেক নারীর সামাজিক অবস্থান, মানসিক দৃঢ়তা এক নয়, এমনকি তারা শিক্ষিত হলেও অনেক সময় প্রথা ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে এদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

অনেক শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত নারীদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, বর্তমান সময়ে নারী স্বাধীনতা বা নারী অধিকার আদায় নিয়ে এতো কথা বলতে হবে কেন? কেন এখনো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে হবে? তাদের ধারণা বা তাদের ভাষায়- নারী ইচ্ছে করলেই অধিকার আদায় করে নিতে পারে, পারে স্বাধীনতা অর্জন করতে। কিন্তু অধিকাংশ নারী কি সেই ক্ষমতা রাখে? এই বিষয়টা খতিয়ে দেখার মানসিকতা অনেক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত নারীর মধ্যে নেই। যেসব নারী বুক চিতিয়ে বলে, আমি পারলে সে কেন পারে না? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার সামাজিক, পারিবারিক অবস্থানের মতো কি তার অবস্থান? শিশুকাল থেকে আপনি যে সুযোগ পেয়ে বড় হয়েছেন, সেই সুযোগটা কি আর আট-দশটা নারী পাচ্ছে? চোখ খুললেই তো আপনার আশেপাশে, পাড়াপ্রতিবেশি কিংবা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কত ভুক্তভোগী নারী দেখতে পাবেন, তার ইয়ত্তা নেই। এসব নারীদের দুর্বল ভেবে ছোট করার মানসিকতাটাও কোনো সুস্থতার পরিচয় বহন করে না।

আমার যাদের সঙ্গে ওঠাবসা, বোঝাপড়া, তারাই কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশ নয়। সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। আমরা যারা শিক্ষিত, স্বাবলম্বী তাদের সংখ্যা কত বলতে পারেন? দেশের বৃহৎ অংশের নারীই তো অধঃপতিত জীবনযাপন করছে। তাদের অধিকাংশের শিক্ষা নেই; নেই তাদের সামাজিক-পারিবারিক অবস্থান। এমনকি শিক্ষিত অনেক নারী মার খেয়ে খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এসব নারীদের সাইকোলজি বুঝতে হবে তাদের অবস্থান দিয়ে। কেন তারা নিজেদের দুর্বল ভাবছে, সেই বিষয়গুলো চিহ্নিত করে দিতে হবে। সম্ভব হলে পথ দেখিয়ে দিতে হবে, যদি সেই দুর্বল নারীটি মানুষের মতো বাঁচতে চায়। মোটকথা সহায়ক ভূমিকা রাখার মানসিকতা রাখতে হবে।

যে দেশে নারীকে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করে সেই দেশে নারীর সংগ্রামটা একেবারে রুট লেবেল থেকে করা উচিৎ। বুঝতে চেষ্টা করা উচিৎ ঐ সমস্ত দুর্বল নারী কেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না! আমাদের উচিৎ তাদের পাশে যাওয়া, তাদের সঙ্গে কথা বলা, সেইসাথে নিজের ব্যক্তিত্বটা এতোটাই দৃঢ় দেখানো উচিৎ যা দেখে দুর্বল নারীরা শিক্ষা নিতে পারে। আইন অনেক সমস্যার সমাধান দিলেও মানসিক দৃঢ়তা অর্জনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয় এবং চর্চাও করতে হয়। এ কাজটা করানোর জন্য আপনি আমি অর্থাৎ আমরা যারা নিজেদের সচেতন, স্বাবলম্বী ভাবি তারা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারি; জাগিয়ে তুলতে পারি নারী সমাজকে।

এখনো বাংলাদেশের চিত্র আপনার আমার মতো নয়। আমাদের মতো নারীদের তুলে আনার জন্য নারী অধিকার নিয়ে এখনো কথা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে অর্থাৎ নারী স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম এখনো অব্যাহত আছে। যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রতিটি নারী মানুষের মর্যাদা না নিয়ে বাঁচতে পারছে ততদিন এই আন্দোলন চলবেই। সেইসাথে নারীদিবসও পালন হবে। নিজের সবকিছু পাওয়া হয়ে যাওয়া মানেই সামগ্রিকতার প্রশ্নে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়া নয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]