November 22, 2024
মুক্তমত

একটি ‘মানবিক’ সমাজ আর একটু ‘মানবিক’ সাংবাদিকতা!

শামস আবীরুজ্জামান সিয়াম।। আচ্ছা,আপনাদের কি সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে বেড়াতে যাওয়া দম্পতিকে তুলে স্বামীকে বেধে গৃহবধূকে গণধর্ষণের কথা মনে আছে? সেই ঘটনার পর সোশাল মিডিয়ায় “স্বামীর সাথে থেকে স্ত্রী ধর্ষিত হয় কীভাবে, একজন স্বামীর সাথেও স্ত্রী নিরাপদ না” বলে হৈ হৈ রব তুলেছিলেন তথাকথিত সুশীলরা।

তাদের কথা শুনে আমার মাথায় প্রশ্ন এসেছিল, “তাহলে স্বামীর সাথে না থেকে একা ঘুরতে গিয়ে যদি ঐ গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হতো, তাহলে কি উনার জন্য আপনাদের সহানুভূতির পরিমাণ কম হতো! কোনো স্ত্রীর, নারীর নিরাপত্তা কি স্বামীর উপর নির্ভর করে? কিংবা একজন একা নারীর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারের জায়গাটুকু কি সঙ্গীসহ নারীর চাইতে একটু পরিমাণেও কম? আর সেখানে স্বামীর সাথে না গিয়ে একা গেলে কি ধর্ষিত হওয়া তাহলে ন্যায়সঙ্গত?

বহু দিন গেছে, কিন্তু আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। পেতেও চাইনি, উত্তরগুলো আমার জানা।

এই যে পালিয়ে যাওয়া ধর্ষকদের খুঁজে বের করার পর দেশের স্বনামধন্য পত্রপত্রিকা যখন সংবাদ ছাপেন এই মর্মে যে ধর্ষিত হওয়া নারীর সাথে আগে থেকে ধর্ষকদের পরিচয় ছিল, তারা একই গ্রামে থাকতেন। ঐ নারীটির চালচলন ভালো না এবং আচরণ “উগ্র” ধরণের, তারপরও কি আর উত্তর খোঁজার দরকার পড়ে?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষকরা চেনা পরিচিত মানুষরাই হয়ে থাকে। কিন্তু এই যে ধর্ষিত মহিলার ‘চালচলন উগ্র ছিল, আচরণ ভালো ছিল না’র সাথে ‘ধর্ষকদের সাথে একই গ্রামে থাকতেন, ধর্ষকদের সাথে পরিচয়’ ছিল শিরোনামের লাইন আপটা আমাদের এইসব ঘটনায় আমোদ নেয়া সমাজকে একটা উপসংহার টানার সুরাহা দেয় যা হলো ‘ঐ নারীর চরিত্রেই সমস্যা, সে নিজেই ঠিক না তাহলে অমন ত হবেই!’

অবশ্য জানেন এই দেশে সাক্ষ্য আইনের আদলে ধর্ষিত কোনো নারীকে চরিত্রহীন প্রমাণ করতে পারলে স্বীকারোক্তি দেয়া ধর্ষকও রেহাই পেয়ে যায়। মিডিয়া সুগারকোটিং করে চরিত্রহীন প্রমাণ করার জন্য ভিক্টিমের চরিত্রের ময়নাতদন্ত করার সংস্কৃতি এখান হতেই ইনসেনটিভ পায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় আর মূল মিডিয়ার চরিত্র ময়নাতদন্ত করার এই রাস্তা স্বয়ং আমাদের আইন করে দিয়েছে।

গুলশানের ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করেছেন তরুনী মুনিয়া । ওই যে সেই তরুনী, যাকে তথাকথিত মিডিয়া “রক্ষিতা” বলে অভিহিত করে, ‘সে পোশাকের মতো প্রেমিক বদল করতো’ বলে চরিত্রের সার্টিফিকেট তুলে চলেছে, হ্যাঁ আমি তারই কথা বলেছি।

“রক্ষিতা, বেশ্যা, পতিতা”- শব্দগুলোকে আমি কখনোই গালি মনে করিনা, এবং যারা এই শব্দগুলোকে গালি মনে করেন তাদের আমি সবসময় আমার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেই। কিন্তু মিডিয়ার এই শব্দ ব্যবহার করার সাথে আমার তুমুল আপত্তি আছে। মিডিয়ার দ্বারা করা শব্দের এই এই জঘন্য সুগারকোটিং-এ আমার সমস্যা। কারণ “শিল্পপতি-রক্ষিতা” লাইন আপ করে, সুগারকোট করে আমাদের সুশীল সমাজ আত্মহত্যার ভালো মতো একটা জাস্টিফিকেশন তৈরি করে দেন। ওই যে সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার উপসংহার দেখানোর মত যে মেয়েটার তো চরিত্রে সমস্যা আছে। সে শিল্পপতির রক্ষিতা ছিল। পাশাপাশি একের পর এক প্রেমিক পাল্টেছে। মানে পাল্টেছে যখন, মেয়েটি নিঃসন্দেহে ‘চরিত্রহীন’। সে টাকার জন্যই সম্পর্ক করেছে। শিল্পপতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে রক্ষিতার সম্পর্কের ফাইন লাইন টেনে যেকোনো উপসংহার মন মতো টেনে দেয়াটা সহজ হয় তাদের জন্য।

কিন্তু সেখানেই চাপা পড়ে যায় যে একজন চল্লিশোর্ধ্ব বিবাহিত পুরুষ দু’বছর আগে একজন সাধারণ মেয়েকে ক্ষমতা দিয়ে যে মেন্যুপুলেট করেছেন এবং তা থেকেই এই আত্মহত্যার ইন্ধন শুরু হয়, সেই বিষয়টি। একবারের জন্য ধরেও যদি নেই তিনি রক্ষিতা ছিলেন, তাদের মধ্যকার চুক্তি হওয়ার সময় কি অর্থের বিনিময়ে প্রাণের চুক্তি হয়েছিল? তাহলে কি আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায়? যদি তার একাধিক প্রনয়ী থাকে, তাহলে কি তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে দেয়া যায় কিংবা আত্মহত্যায় বাধ্য করা যায়?

কয়েকদিন আগে একজন আলোচিত ব্যক্তির “একটি মানবিক বিবাহের” সিক্রেট যখন ফাঁস হয় তখন যেভাবে মিডিয়া তার পরিচয়সহ সবকিছু ফাঁস করেছিল, শিরোনামের পর শিরোনাম আর খবরের পর খবর আর তদন্ত হয়েছিল; আজকে গুলশানের ঘটনার বেলায় তার অর্ধেকেরও অর্ধেক কি হয়েছে?

মুখ ব্লার করা আর “শিল্পপতি-রক্ষিতা” সুগারকোডিং ছাড়া ন্যূনতম এক্সপোজার ও ফোকাস কি আপনারা দেখেছেন?

“স্বামীর সাথে থেকেও কীভাবে রেইপড হয়, স্বামীর সাথে থেকেও নিরাপদ না”- ধারণা আওড়ানো সমাজে এই সুগার ড্যাডিডের জন্য সুগারকোডিং করে ভিক্টিম ব্লেমিং করা সাংবাদিকতাকে আপনারা কী বলবেন?

একটি ‘মানবিক’ সমাজ আর একটু ‘মানবিক’ সাংবাদিকতা!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]