‘‘তুমি আমাকে একটু ভালোবাসলে, আমি তোমাকে গাড়ি কিনে দেবো”
নাহিদা নিশি।। বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে- “সব মাছই গু খায়, পাঙ্গাশ মাছের নাম হয়।” মেয়েরা হলো সেই পাঙ্গাশ মাছ। অর্থের পেছনে সবাই ছুটলেও দোষ হয় শুধু মেয়েদের। একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে সবাই পুরুষের টাকা-পয়সার হিসাব করতে বসে। প্রেমিকার পিছনে, বউয়ের পিছনে কবে কতো টাকা ইনভেস্ট করছে, সেই হিসাব। কিছুদিন আগে নাসিরের বউ তামিমা’কে সবাই লোভী, বারোভাতারি বলতেছিল, কারণ তামিমা রাকিবের টাকায় পড়াশুনা করে রাকিব’কে ছেড়ে গেছে। রাকিবের টাকায় যেহেতু পড়াশুনা করছে, সেহেতু তামিমার উচিত ছিল আজীবন রাকিবের পায়ের কাছে বসে কৃতজ্ঞতা জানানো। হাজার সমস্যা হলেও তার সাথেই সংসার করা উচিত ছিল। অখচ একটা সম্পর্ক চলাকালীন উভয়পক্ষই বিভিন্নভাবে একে অপরের সাহায্য নেয় কিন্তু মেয়েদের ইনভেস্টমেন্টের হিসাব কেউ করে না।
এমন হাজার হাজার পুরুষ আছে যারা প্রেমিকার টাকায়, বউয়ের টাকায় নিজের পকেট খরচ চালায়। প্রেমিকার টাকায় গাঁজা খায়, ফূর্তি করে। তাছাড়া টাকার বিনিময়ে শরীর পুরুষও বিক্রি করে। কিন্তু এইসব সত্য এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ঢাক পিটিয়ে প্রকাশ করে না। ‘জিগোলো’ কিংবা ‘মেল এসকর্ট’ শব্দগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় ঘটতে দেয় না।
যাই হোক, নারীর রূপ বেচাকেনাই আমাদের সমাজে সত্য। বৈধভাবে হোক কিংবা অবৈধভাবে! পুরুষ নারীর সৌন্দর্য দেখে প্রলুব্ধ হয়, নারীর শরীরের লোভে পড়ে, সুন্দরী নারীর সাথে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে শুতে চায়। তাতে পুরুষের কোনো দোষ হয় না। দোষ হয় প্রলোভনকারী নারীর। নারী হয় মাল্টিপ্লাগ, পতিতা। কারণ সৌন্দর্যকে লুকিয়ে না রাখা দোষের। শরীরকে ঢেকে না রাখা দোষের। কিন্তু নারী যখন পুরুষের অর্থ দেখে প্রলুব্ধ হয়, অর্থের লোভে বিছানায় যায়, তখন আবার প্রলোভনকারীর কোনো দোষ হয় না। দোষ হয় নারীর। কেউ পুরুষকে বলে না, তাদের অর্থবিত্ত লুকিয়ে রাখতে। নারী হয় গোল্ড ডিগার, লোভী, রক্ষিতা। যেন লোভ দেখানো এবং লোভাতুর হওয়া সবকিছুর অধিকার কেবল পুরুষের।
পিতৃতন্ত্র ঠিক করে দেয় নারীর পরিচয়। কে চরিত্রহীন নারী, আর কে অসহায় নারী সেটা নির্ধারণ করে পিতৃতন্ত্রের মোড়লরা! মামুনুল হক যখন তার প্রেমিকা জান্নাতকে আর্থিক সাহায্য করে, তখন সেটা হয় অসহায় নারীর পাশে দাঁড়ানোর মতো সওয়াবের কাজ। জান্নাত’কে বলা হয় অসহায় নারী। তাদের প্রেমের নাম দেয়া হয় ‘মানবিক প্রেম’। কিন্তু আনভীর যখন মুনিয়াকে আর্থিক সাহায্য করে, তখন মুনিয়া হয় রক্ষিতা। প্রেম হয় ব্যবসা।
সুন্দরী নারীর কদর পরিবার থেকে শুরু করে সবখানেই বেশি। পরিবারও নারীর রূপ বিক্রি করে। সেটাকে সমাজ বৈধতা দেয়। যার কারণে মেয়ের গায়ের রং কালো হলে, মেয়ের চেহারা কম সুন্দর হলে, মেয়ের স্বাস্থ্য খারাপ হলে, বাবা-মায়ের কপালে চিন্তার রেখা দেখা যায়। তারা মনে করে, ভালো জামাই পেতে হলে মোটা অঙ্কের যৌতুক দিতে হবে। কোনো রকমে একটা চাকরিজীবী জামাই জোটাতে পারলেই তারা সেটাকে তিন পুরুষের ভাগ্য বলে মনে করে। অন্যদিকে মেয়ে যদি ফর্সা কিংবা তথাকথিত রূপসী হয়, তাহলে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন নিশ্চিন্ত থাকে। তারা ধরেই নেয় যে, এই মেয়ের পেছনে বিসিএস ক্যাডার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা শিল্পপতি ছেলেদের লাইন পড়বে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ও তাই।
গরীব ফ্যামিলির সুন্দরী এক মেয়ের বিয়ে হলো কিছুদিন আগে। প্রেমের বিয়ে। ছেলে প্রচুর পয়সাওয়ালা। এলাকাবাসী এক সপ্তাহ ধরে ছেলের টাকা-পয়সা নিয়ে আলাপ করতে থাকলো। মেয়ে’কে কতো ভরি স্বর্ণ দিলো, বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য মেয়ের বাবা’কে কতো টাকা দিলো, মেয়েটা ঠিক কতোটা ভাগ্যবতী, তার হিসাব চলতে লাগলো। দেখতে সুন্দরী না হলে এই পরিবারের একটা মেয়ে এতো ভালো একটা ছেলে কিছুতেই পেতো না, এটাই সবার বিশ্বাস। কথায় কথায় একজন বলে বসলো ‘‘ধরলে এরকম বোয়াল মাছই ধরো। ট্যাংরা, পুঁটি ধরে জীবন নষ্ট করা কেন!” সাথে সাথে তাকে সাপোর্ট দিলো অন্যরা। আমি বললাম, “ছিপ পেতে বোয়াল মাছের অপেক্ষায় বসে থাকার চেয়ে নিজেই বোয়াল মাছ হয়ে গেলে বেশি ভালো হয় না? আমরা তো ছেলে ধরার ব্যবসায় নামি নাই।” দেখলাম, কথাটা কারোরই পছন্দ হলো না।
এই যে আমাদের বোয়াল মাছ ধরার যে শিক্ষা, এটা কিন্তু আমরা ডিরেক্টলি কিংবা ইন্ডিরেক্টলি পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এদের কাছ থেকেই পেয়ে থাকি। আমরা বুঝতে পারি যে, একটা মেয়ে বিত্তবান কাউকে বিয়ে করার মাধ্যমে যতোটা সহজে আশেপাশের লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, ডজনখানেক ডিগ্রি অর্জন করেও সেটা সম্ভব না। তাছাড়া মেধা, পরিশ্রম, সততা, দিয়ে উপরে উঠতে হলে নারী’কে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ। যার মোড়ে মোড়ে কাঁটা বিছানো। সেই পথ পেরোনোর দম সবার থাকে না বলেই কেউ কেউ রূপ বিক্রি করার মতো সহজ পথ বেছে নেয়। আর এ কারণেই এখানে বই ব্যবসায়ীরা সারাবছর লোকসানে ডুবে থাকলেও গোপনাঙ্গ ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রেতারা রাতারাতি লাখপতি হয়ে যায়।
এভাবে আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, মেধা, পরিশ্রম সবকিছুই টাকার কাছে ছোট হয়ে যায়। ‘অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’ এই সত্যিটা তো পরিবার আর সমাজই আমাদের মনে ও মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অর্থবিত্তহীন কাউকে বিয়ে করলে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ সবখানে অসন্মানিত হতে হয়। পরিবারের মুখে চুনকালি পড়ে! আবার বউ কম সুন্দরী হলে ছেলের বাড়ির লোকজনের ফিসফিসানি শোনা যায়। সবার মুখ কালো হয় যায়। যার ফলে পুরুষ অর্থের লোভ দেখিয়ে রূপ আর শরীরের দিকে এগিয়ে আসে, নারীও রূপের লোভ দেখিয়ে এগিয়ে যায় অর্থের দিকে। যার যেটা প্রয়োজন, সে সেটাই পেতে চায়। যেকোনো উপায়ে।
ছেলেরা মেয়েদের’কে লোভী, গোল্ড ডিগার বলে এতো গালাগালি করে, অথচ তারাই আবার মনে মনে নারীর রূপ, শরীর, প্রেম সবকিছু কিনতে চায়। প্রতিটা ছেলেই টাকার পেছনে দৌঁড়ায়, কারণ তারা বিশ্বাস করে, পকেটে টাকা থাকলে, মেয়েরা রকেটের বেগে ছুটে আসে। স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই ছেলেদের বোঝানো হয় যে, তাদের রোজগারের উপরই নির্ভর করতেছে, কার বউ কতোটা সুন্দরী হবে, কার পিছনে মেয়েদের কিংবা মেয়ের বাবাদের লম্বা লাইন পড়বে! পুরুষের গায়ের রং, চেহারার সৌন্দর্য, হাইট, ওয়েট কোনো কিছুই কোনো ব্যাপার না, যদি পকেটে টাকা-পয়সা থাকে! বিত্তবান পুরুষের চরিত্রের বিবরণ কেউ শুনতে চায় না। কারণ সোনার আংটি বাঁকা হলেও তার দাম কমে না। কারণ চরিত্র ধুয়ে পানি খেলে পেট ভরে না।
একজন ষাটোর্ধ পুরুষ কিছুদিন আগে মেসেজ দিলো, প্রথম মেসেজেটাই এ রকম- ‘‘তুমি আমাকে একটু ভালোবাসলে, আমি তোমাকে গাড়ি কিনে দেবো।” এই যে পুরুষের টাকার দেমাগ, এই যে টাকা দিয়ে মেয়েদের রূপ, শরীর, প্রেম সবকিছু কিনতে চাওয়ার স্পর্ধা, এই সিস্টেম তো নতুন না। যে কেউ নারীর শরীরের দাম হাঁকতে পারে। এক হাজার টাকার বিনিময়ে সেক্সচ্যাট, দশ হাজার টাকার বিনিময়ে শরীর কেনা কিংবা পঞ্চাশ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রেম কেনা, সবই এক। টাকার অঙ্ক আলাদা হলেও অ্যাপ্রোচের ধরণ সবারই এক।
প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেয়ায় কোনো অন্যায় নাই। টাকার জন্য প্রেম করাতেও কোনো অন্যায় নাই। প্রথমটা শুধু প্রেম, পরেরটা ব্যবসা। কিংবা প্রেম এবং ব্যবসা দুটোই। কোনো ব্যবসা যদি অবৈধ হয়, তাহলে তার সাথে জড়িত ক্রেতা, বিক্রেতা উভয়েই সমান অপরাধে অভিযুক্ত হয়। শুধু নারী’কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এই সিস্টেম ভাঙতে হবে। অর্থ আর রূপের পেছনে ছোটার এই সিস্টেম ভাঙতেই হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]