অবশেষে মিতা জানলেন, জীবনের মানে স্বাধীনতা
নাহিদ শামস্।। আমার টিপ পরা নিয়ে অনেক মন্তব্য, কেউ বলে দেখতে দারুন দেখায়। আবার কেউ বলে টিপের সাইজটা আর একটু ছোট হলে মানাতো।
আমি নিজেও জানিনা আসলে কোনটাতে বেশি মানায়। কখনও বড় পরি, কখনও ছোট। মন খারাপ থাকলে কপালে একটা বিন্দু দিয়েই চললাম। কিন্তু টিপ আমাকে পরতেই হবে।
আমার ভালোলাগা, আমার সাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি কপালে টিপ না থাকে। মানবাধিকার সংস্থার অফিসে আমার ক্লাইন্টরা বলতো ‘টিপ পরা আপা’। শুনতে ভালোই লাগত। লাল, নীল, কালো – পোশাকের সাথে মিলিয়ে।
টিপ নিয়ে আমাকে নেগেটিভ কথাও শুনতে হয়। শুনতে হয়েছে চরম সাম্প্রদায়িক মন্তব্যও। আবার আমার এক নিকটাত্মীয় বলেছিল, ‘ভাবী টিপ না পড়লে হয়না?’ আমার উত্তর ছিল, এটা আমার স্বাধীনতা।
শুরুটা নিজের কথা দিয়ে শুরু করলাম। তবে আজ বলব এমন একজনের কথা, যার সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু কষ্ট পেয়েছিলাম তার মানিয়ে নেবার বন্দি জীবনের গল্প শুনে।
অদ্ভূত সুন্দর আফরিন মিতা। আমি অবাক চোখে তাকে দেখছিলাম। আর কথা শুনছিলাম। জীবনের ৫০ বছর বয়সে এসেও মানুষ কত সুন্দর আর সুন্দর তার মানসিকতা।
মিতা বলছিলেন, ‘আমার জীবনের চাওয়া-পাওয়া আর ভালোলাগা, মন্দলাগা কবেই শেষ হয়ে গেছে। আমাকে মেনে নিতে হবে তার মানিয়ে নিতে হবে এবং হবেই। আমার কী কী মেনে নিতে হবে তার তালিকা অনেক দীর্ঘ। কখন যেন নিজেই দীর্ঘ করে ফেলেছি। বলতে পারি বাধ্য হয়েছি। কখনও নীরব কান্না- যা কেউ দেখেনি। যার দেখার সে না দেখেই ভেবেছে এমনই হয়।’
মিতা বারবার তার অতীত বলবার জন্য অস্থির হয়ে উঠছিলেন। বিয়ে হয়েছিলো বনেদী পরিবারে কি করা যাবে আর কী করা যাবে না এটা বুঝতেই মিতার অনেকটা বছর পেরিয়ে গেছে।
স্বামীর প্রভুত্ব মেনে নিতে হয়েছিলো মিতাকে। পড়ালেখা বিয়ের পরপরই বন্ধ হয়ে গেলো। তিনটি সন্তান জন্ম দিলেন। বনেদী বাড়ীর বউ বলে কথা। বাইরের জগতে পা রাখবার স্বাধীনতা তার ছিলোনা। এমনকি বাড়ির ড্রাইভারের সাথে একা বের হওয়াও নিষেধ ছিলো।
মিতা খুব দুঃসময়ে আমাদের সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। স্বামীর অসহনীয় মানসিক নির্যাতন, সেই সাথে আর্থিক নির্যাতনও ছিলো। মিতা জানতেন না নারীদের জন্য এমন একটি সংস্থা আছে, যেখানে নিজের মনের কথা বলা যায়। চাইলে কিছুটা হলেও প্রতিকার পাওয়া যায়।
মিতা তার শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারেনি। বাইরের পৃথিবীর আলো তার কাছে ছিলো না। ঘর সংসার-স্বামী-সন্তান এই কয়টা শব্দই ছিলো তার জীবনের অলংকার।
সংস্থায় এসে আইনজীবীর মুখোমুখি বসে তার জীবনের না পাওয়াটাই প্রথম বললেন। ধীরে ধীরে তিনি কী চান, তার অধিকার কতটুকু ঐ কথাগুলো তুলে আনলেন।
তিনি আর স্বামীর প্রভুত্ব মানতে পারছেন না। সংসার তিনি চান। তবে শৃংখলে আবদ্ধ জীবন চাননা। এটাও বললেন জীবনের অনেক সময় পার করে এসেছি। জানিনা এ শৃংখল আমি পেরোতে পারবো কিনা। তবে আমি চেষ্টা করবো। অন্তত আমার স্বাধীনতাটা আমি চাই। আমার স্বামীর কাজে গচ্ছিত রয়েছে আমার বিরাট অংকের টাকা, যা সে অঙ্গীকার করছে। এ টাকার সব কাগজপত্র ফেরত চাই।
যখন তার স্বামীকে নিয়ে সংস্থায় বসা হলো, বুঝতে বাকি রইল না, তিনি চিরাচরিত বাঙালী পুরুষদের ধ্যান ধারনায় বিশ্বাসী। দাম্ভিকতা আর পৌরুষত্ব দেখানো একজন ‘ভদ্রলোক’। অগাধ পয়সা আর পরিবারিক পরিচিতিতে তিনি চলেন। স্ত্রী নামক মানুষটি তার কাছে ‘মেয়ে মানুষ’। সেখানে নেই সামান্য শ্রদ্ধা। সংসারের সকল কাজে তার ভূমিকা এবং বক্তব্যই জোরালো হতে হবে। স্ত্রীকে যথেষ্ট বাইরে যেতে দেবার মধ্যে তার বিধিনিষেধ রয়েছে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের বাড়িতেও অনুমতি ছাড়া যাওয়া হবে না।
এ কেমন আজব নিয়ম, যা মিতা মেনে এসেছেন দীর্ঘকাল!
দুটো মানুষ ‘স্বামী-স্ত্রী’, তখন আমার সামনেই চেয়ারে বসা। তার স্বামীর ঔধ্যত্ব দেখে আমি অবাক হয়েছি। মিতাকে একদমই কোন কথা বলতে দিচ্ছিলেন না। তবে সালিশের নিয়ম তাকে বুঝিয়ে বলে কথা শোনাবার মত ক্ষেত্র তৈরি করি।
দীর্ঘ দাম্পত্যের ছোট ছোট অনেক না পাওয়া আর আবদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি ছিলো মিতার একমাত্র প্রত্যাশা।
মিতা খুব নমনীয়ভাবে কয়েকটি কথা তার সম্মুখে বললেন। ‘সে যদি আমাকে সম্মান এবং আর্থিক স্বাধীনতা দেয় তবেই আমি সংসার করবো। তার দাম্ভিকতা এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। তাকে আমার বন্ধু হতে হবে।’
আরো বললেন, ‘আমার সংসারের কোন সিদ্ধান্তেই আমি নিতে পারিনি। এমনকি ছেলেমেয়ের বিয়ের বিষয়েও সে আমাকে গুরুত্ব দেয়নি।’
মিতার স্বামীকে কেন এ সংস্থার মুখোমুখি হতে হলো এ নিয়েও যথেষ্ট রোষানলের শিকার হলেন মিতা। তবে মিতা ভয় পাননি। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দাম্ভিকতা সব জায়গার জন্য নয়।
মিতা শর্তসাপেক্ষে সংসারে ফিরে যান। অন্তত এই দাম্ভিক এবং পুরুষতান্ত্রিক মানুষটি তার সকল অযাচিত কাজ না করবার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেটি লিখিত। এটাই মিতার জয়। দীর্ঘদিনের গ্লানিকর জীবনের মুক্তি। মিতা সেই সাথে ফিরে পান তার নামে গচ্ছিত বড় অংকের টাকাটিও। মাঝে মধ্যেই মিতা আসতেন আমার কাছে। হয়তো ফোনেও বলতেন, ‘আমি ভালো আছি। ৫০ উর্ধ্ব জীবনে এসেও স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি। আমিও একটা মানুষ, এটা বুঝেছি।’
আনন্দে আর খুশিতে তার সৌন্দর্য আরও বেড়ে যেতো। ভালো অনুভূতি আমার মাঝেও দোলা দিতো। একটি পুরুষকে তার ভুল স্বীকার এবং স্ত্রীকে সম্মান করবার মত বিষয়গুলো আচরণে আনতে সহায়তা করতে পেরেছি।
মিতা আপনি ভালো থাকেন সবসময়।
নাহিদ শামস্: আইনজীবী, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন
আলোকচিত্র: ফারহানা আকতার