যেকোনো মূল্যে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে?
মেহেরুন নূর রহমান।। বিল এবং মেলিন্ডা গেটস এর বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটেছে। দুটো মানুষ একসাথে থাকবে এটা যেমন তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত তেমনি একসাথে না থাকার সিদ্ধান্তও তাদের নিজস্ব। এখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে আমাদের কিছু বলার নেই। আর এই দম্পতির ক্ষেত্রে আসলে তেমন কিছুই বলার নেই যেহেতু তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের আসল কারণ কী, সেটা ঠিকমতো জানা যায়নি বা তারা সেটা জানতে দিতে চায়নি। এটা নিশ্চয়ই তাদের জন্য একটা কঠিন সময়।
মজার বিষয়টি হলো বাংলাদেশের পুরো ফেসবুক কমিউনিটির বুক হাহাকারে ভরে গেল এই বিচ্ছেদের খবর শোনার পর। ‘হায় হায়, এত টাকা-পয়সা থেকে কী লাভ হল যদি বিয়েটাই ভেঙে গেলো!’ নানারকম জাজমেন্টাল কমেন্টস, গুজন, উদ্ভট তথ্য এবং তত্ত্বে ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে। বিল গেটসের নাকি একজন প্রেমিকা ছিল, তার সাথে সে বিয়ের পরও ঘুরে বেড়াত, সেটা নাকি আবার মেলিন্ডা গেটস জানতো। মেলিন্ডা গেটসেরও নাকি প্রেমিক থাকার সম্ভাবনা আছে অর্থাৎ তারা ওপেন রিলেশনশিপ-এ ছিল। বিল গেটস নাকি মেলিন্ডাকে সময় দিতো না, অনেক সম্পদের আড়ালে আসলে তারা একাকী ছিল। মেলিন্ডা নাকি আসলে টাকার লোভেই এ ডিভোর্সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এগুলোর সত্যতা জানার জন্য আমি কোনরকম রিসার্চ করিনি বা করার আগ্রহ বোধ করিনি। আমি শুধু বোঝার চেষ্টা করেছিলাম আমাদের দেশের মানুষের মন মানসিকতা। কত সহজেই কিছু না জেনেই আমরা কারো সম্পর্কে কত নেতিবাচক কমেন্ট করি, কারো সম্পর্কে রায় দিয়ে ফেলি! অন্যের ডিভোর্সের কথা শুনে দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে এমন সব জাজমেন্টাল মন্তব্য করে যাই যেন আমরা সব দাম্পত্য জীবনে সুখের সাগরে ভাসছি আর এতো এতো টাকা পয়সা নিয়েও তারা কত অসুখি!
আমি কিন্তু খুব একটা অবাক হই না এই মন্তব্যগুলো পড়ে। আমাদের সমাজে বিয়ে টিকিয়ে রাখাটা একটা বিশাল ব্যাপার, তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। আপনার যা কিছু অর্জন হোক না কেন, আপনি যদি বিয়ে টিকিয়ে রাখতে না পারেন, আপনার সব অর্জনই ব্যর্থ। ডিভোর্স তাদের জন্য একটা স্টিগমা। এ কারণেই অসংখ্য নারী-পুরুষ অসুখি দাম্পত্য টিকিয়ে একসাথে বসবাস করে বছরের পর বছর এবং সেটাকে নানাভাবে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। আবার অনেকে বছরের পর বছর আলাদা থাকে, যে যার মতো নিজস্ব জীবন যাপন করে কিন্তু ডিভোর্স দেয় না। কিছু পুরুষ আছে যারা ক্রমাগত বিবাহ বহির্ভূত নানারকম সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, এবং এটা এভিডেন্ট যে স্ত্রীদের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা নাই কিন্তু তারপরও তার ডিভোর্স দেবে না। স্ত্রী ডিভোর্স দিতে চাইলে বাধা দেবে, কারণ ডিভোর্স নামক স্টিগমা তারা গায়ে লাগাতে চায় না, সেই সাথে মেইল ইগোও আর একটি বাধা বটে, তবে সে আলোচনা এইখানে নয়।
আর নারীদের কথা কী বলবো! যেখানে নারীদের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো আয় নেই, স্বামীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, তারা নানাভাবে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চায় তা স্বামী যত অত্যাচারই করুক না কেন বা অসৎ হোক না কেন। এমনকি শিক্ষিত ভাল চাকরি করে, স্বাবলম্বী এমন অনেক মেয়েও অসুখি দাম্পত্য টিকিয়ে রাখে নানা টালবাহানায়। এটা যে তারা সবসময় ভালোবাসার কারণে করে তা কিন্তু নয়। প্রথমত তারাও ডিভোর্স নামক স্টিগমা গায়ে লাগাতে চায় না আর দ্বিতীয়ত, ডিভোর্সি মেয়েদের জীবন আমাদের সমাজ নানাভাবে কঠিন করে দেয়, নানা বাধা আসে। অনেক মানসিক জোর না থাকলে সেইসব বাধা মোকাবিলা করা অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে পরে। এছাড়া করুনার দৃষ্টি, তাকে সহজলভ্য ভাবা ইত্যাদি উপরি পাওনা।
আগেই বলেছি আমরা বিয়ে টিকিয়ে রাখাকে জীবনের সফলতার সবচেয়ে বড় একটা কারণ হিসেবে ধরি। সত্যি কথা বলতে, বিয়ে জরুরি কিন্তু এটি টিকে থাকা না থাকা আপনার সফলতাকে ডিফাইন করে না। আমার এই লেখাটা পড়ে ভাবার কোন কারণ নেই যে আমি বিয়েকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবি না, বা বিয়ে টিকিয়ে রাখা জরুরি মনে করি না। দুটি মানুষের দিনরাত একসাথে থাকা সহজ নয়। সেখানে অনেক ধৈর্য্য, সহমর্মিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া এসব অনেক কিছু লাগে। শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক বলে নয়, যে কোন সম্পর্ক সেটা মা-বাবার সাথে সম্পর্ক হোক, বা বন্ধুর সাথে সম্পর্ক হোক বা ভাইবোনদের সাথে সম্পর্ক হোক, সুন্দর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে দু’পক্ষের এফোর্ট ছাড়া সম্ভব নয়। এমনকি আপনার সন্তানের সাথে আপনার সুস্পর্কের জন্য আপনাকে চেষ্টা করে যেতে হবে। অনেক রকম কম্প্রোমাইজ, স্যাক্রিফাইজ করে যেতে হবে। জন্ম দিয়েছেন বলেই যে অটুট বন্ধন হবে এমন কিন্তু নয়।
স্বামী স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই এফোর্ট আরো বেশি দিতে হয় কারণ তারা দুজন দুজনের পার্সোনাল স্পেসের অনেকখানি দখল করে নেয়। এছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর সাথে জড়িয়ে থাকে সন্তানরা। মনে রাখা দরকার আপনার সন্তানরা কিন্তু আকাশ থেকে টুপ করে আপনাদের সংসারে ঢুকে পড়েনি। আপনাদের সিদ্ধান্তেই তারা পৃথিবীতে এসেছে। সুতরাং আপনাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকা দরকার তাদের জন্য যেটা ভালো সেটা করার। এ কারণেই সন্তান আসার পর স্বামী এবং স্ত্রীকে অনেক কম্প্রোমাইজ এবং স্যাক্রিফাইজ করতে হয় কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে। অনেক সময় বাচ্চাদের ভালোর জন্যই হয়তো একটি সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসা দরকার বিশেষত বাবা মায়ের একসাথে থাকা যদি তাদের শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
আসল কথা হলো একটি দাম্পত্যের ভেতর কী চলে আমার বাইরে থেকে সেটা অনুধাবন করতে পারি না, তাই আলটপকা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অনেকে নারীকেই একটি ডিভোর্সের ঘটনা কথা শোনার পর বলতে শোনা যায়- ‘‘এ কারণেই ডিভোর্স দিয়ে দিল? এতো ধৈর্য্য কম? এর চেয়ে কত কষ্ট অন্যেরা সহ্য করে!” আসলে তাদের দোষ নাই। বিয়ে পচতে পচতে দুর্গন্ধ বের না হবার আগ পর্যন্ত আমরা ডিভোর্সের কথা ভাবতে পারি না।
অনেকদিন আগে দেখা একটা সিনেমার কথা মনে পড়ল। সিনেমাটির নাম ছিল প্রাক্তন। যখন মুক্তি পেয়েছিল তখন অনেক আলোচনা হয়েছিল। অনেকেই হয়তো দেখেছেন সিনেমাটি তবে মেমোরি রিফ্রেশের জন্য সংক্ষেপে কাহিনীটা বলছি। একটি ট্রেন জার্নিতে এক এক্স কাপলের দেখা হয়। এক সময় তারা বিবাহিত ছিল। ট্রেনে পুরুষটি তার দ্বিতীয় স্ত্রী-বাচ্চা নিয়ে এবং এক্স স্ত্রীটি একাই যাত্রা করছে। ফ্ল্যাশব্যাকে তাদের দাম্পত্যের যে চিত্রটি দেখানো হয় সেখানে স্বামীটিকে টিপিক্যাল পুরুষতান্ত্রিক হিসেবেই দেখানো হয়েছে। ডমিনেটিং, স্ত্রীকে অহেতুক সন্দেহ করে, বিচ্ছিরি করে ঝগড়া করে। সে তুলনায় মেয়েটি শিক্ষিত, সফিস্টিকেটেড, লাভিং ইত্যাদি। নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে তাদের ডিভোর্স হয়। এতদিন পর তাদের আবার দেখা হলে তারা দুজনই বেশ ইমোশোনাল হয়ে পরে। পুরুষটিকে দেখানো হয় এখন সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে সুখি। দ্বিতীয় স্ত্রীটি অল্প শিক্ষিত ও সংসারসর্বস্ব যে স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখি। দ্বিতীয় স্ত্রীটি লোকটির এক্স স্ত্রীকে (যদিও সে সেটা জানে না) সংসার সুখের জন্য কী করা উচিত, কী রকম স্যাক্রিফাইস করা উচিত এই নিয়ে নানা উপদেশ দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছবিটি মুক্তির পর নানা সমালোচনা শুরু হলো। সবাই বলতে শুরু করল যে এক্স স্ত্রীটিকে দুঃখী দেখানো হয়েছে যেহেতু সে সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে নাই। দ্বিতীয় স্ত্রীটিকে সুখি দেখিয়েছে যেহেতু সে স্যাক্রিফাইসিং এবং সংসারটি টিকিয়ে রেখেছে। স্বামীর দেয়া সব অপমান মাথা পেতে নিয়ে সংসার করে উচিত এটাই নাকি সিনেমাটিতে বোঝানো হয়েছে। সিনেমাটির মেকাররা কী বোঝাতে চেয়েছে সেটার চেয়ে সবাই এমনকি নারীবাদীরাও যেভাবে সিনেমাটিকে ইন্টারপ্রেট করেছিল সেটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল।
আর সবার মতই তারাও ভেবে নিয়েছিল বিয়ে যেহেতু ভেঙে গেছে সুতরাং প্রথম স্ত্রীটির জীবন ব্যর্থ, এবং সে অসুখি। তাদের কাছেও বিয়ে টিকিয়ে রাখাটাই বড়, এ কারণেই কেন দ্বিতীয় স্ত্রীটিকে সুখি দেখিয়েছে এটা তাদের বিরক্ত লেগেছে। মনে রাখা দরকার প্রথম স্ত্রীটিকে কিন্তু অসুখি দেখানো হয়নি। তারও একজন প্রেমময় পার্টনার আছে যা সিনেমার শেষে দেখানো হয়। এটাকে একজন সাহসী নারীর গল্প বলা যেতে পারতো যে একটা অসম্মানজনক দাম্পত্য থেকে বের হয়ে এসেছে। প্রাক্তনকে দেখে ইমোশনাল হয়ে পুরোনো ভালো স্মৃতি মনে করা এই নয় যে সে দুঃখী। সমস্যা আমাদের মগজে, অন্যদের দোষ দিয়ে কী হবে? মুখে মুখে যত কিছুই বলি না কেন, বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে এটা আমাদের রক্তে মিশে আছে, তাই বিয়ে ভাঙা মানেই জীবনের সকল অর্জন ব্যর্থ মনে করা।
কথা হলো বিয়ে টিকিয়ে রাখা জরুরি কিন্তু পচে গেলে দ্রুত বের হয়ে আসা উত্তম, যেটা আমরা অনেকেই সঠিক সময়ে করতে পারি না। মনে রাখা জরুর বিয়ে ভাঙা মানে এই নয় যে আপনি অসফল। আপনি হয়তো পড়াশুনায় খুব ভালো, খুব ভালো জব করেন, আপনার হয়তো খুব ভালো একটা বন্ধু সার্কেল আছে, বাবা-মা, ভাই -বোনের সাথে আপনার খুব সুন্দর সস্পর্ক, আপনার সন্তানেরা সুস্থ, এখন কোনো কারণে যদি আপনার বিয়ে না টেকে তাহলে কি আপনার এতো সব প্রাপ্তি, সাফল্য মলিন হয়ে যাবে? না, এটা হতেই পারে না। আপনার যদি একটা সুখকর দাম্পত্যজীবন থাকে খুব ভালো, কিন্তু কোনো কারনে আপনার বিয়েটা যদি ওয়ার্ক না করে এবং বের হয়ে আসতে হয় তবে নিজেকে ব্যর্থ ভাবার কোন কারণই নাই। কোনো কিছুই জীবনের চেয়ে বড় নয়।
বিল আর মেলিন্ডা গেটসে-এ ফিরে আসি। আমি লন্ডনে যে বহুজাতিক মিডিয়া এবং কমিউনিকেশন কোম্পানিতে কাজ করি সেখানে আরো কিছু অ্যাকাউন্টসের সাথে আমাকে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের জন্য কাজ করতে হয়। যেটাকে সংক্ষেপে BMGF বা Gates Foundaton বলা হয়। কাছ থেকে কাজ করছি বলে জানি কত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে জনকল্যাণের জন্য। এরা জেন্ডার ইকুয়ালিটি, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এরকম অসংখ্য প্রকল্পে পৃথিবী জুড়ে কাজ করে। বিল গেটস মাইক্রোসফ্টের মত সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন যেখানে সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ করছে। তারা তাদের আয়ের বড় অংশটা চ্যারিটির জন্য ব্যয় করেন। এতসব সাফল্য, অর্জন আপনাদের চোখে মূল্যহীন যেহেতু তারা ডিভোর্স নিচ্ছেন? তাদের ডিভোর্স হচ্ছে তাতে আপনাদের কী? মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। তারা যদি ওপেন রিলেশনশিপে থাকতো তাতেই বা আপনার কী? সমাজের ভালোর জন্য নিজের কতটুকু কন্ট্রিবিউশন আছে সেটা ভাবুন অন্যকে সমালোচনা করার আগে। আর কারো ব্যাপারেই কিছু না জেনে উদ্ভট জাজমেন্টাল মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন। একটু শিক্ষিত আর মানুষ হন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]