November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

“এত উড়ে বেড়াইও না; তুমি যে ওর ‘মা’, বুঝা যায় না।”

তানজিয়া রহমান।। কিছুদিন আগে এক আত্মীয় বলেছিল, মায়ের বয়স হয়েছে। এখন রঙিন কাপড়ের পোশাক পরা মানায় না।

কথাটা কানে লেগেছিলো খুব। মনে মনে ভেবেছিলাম আম্মাকে একটা লাল জামা উপহার দেবো। কিছুদিন পরে কথায় কথায় আম্মা বলছিল, ঘিয়ে আর লালের কম্বিনেশনে হাতের কাজের জামার শখ হয়েছে। এরপর আম্মাকে নিজ হাতে নকশা করে একটা থ্রিপিস উপহার দেই। জামার ওড়নাটা দেই গাঢ় লাল আর জামায় রঙিন সুতায় ফুল তুলি। ওড়না লাল দেয়ার কারণ হচ্ছে, যে আম্মার পোশাকের গাঢ় রঙে আপত্তি করেছিলো। সে আম্মার সাথে কথা বলার সময় ভালো করে আম্মুর লাল টুকটুকে ওড়নায় মুড়ানো মুখটা যেন দেখতে পায়।

আমরা প্রায়ই শুনে থাকি মায়েদের এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। মানে একটা গণ্ডিতে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। বাচ্চা হওয়ার পর বলা হয়, “এত উড়ে বেড়াইও না। তোমার বাচ্চা হয়েছে, তুমি আর বাচ্চা না।” “বিশ্রাম? তোমার বাচ্চা আছে!” বাচ্চা স্কুলে গেলে বলা হয়, “নিজেকে পাল্টাও। তুমি যে ওর মা বুঝা যায় না।” বাচ্চা বড় হলে, “তোমাকে সবাই তোমার বাচ্চার বোন ভাবে। তোমাকে এমন একটা লুক দিতে হবে যেন বয়স্ক লাগে।”

আর বাচ্চাকাচ্চার বিয়ে হলে তো কথাই নাই, তখন তো নিজে যে একজন মানুষ, তার যে শখ আহ্লাদ, ভালো লাগা বলে কিছু আছে সেইটা ভুলে যেতে হবে। তখন হালকা রঙের পোশাক, শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ যাই পরুক মাথায় এই বড় ঘোমটা, চুলে খোপা করা ছাড়া আর কিছু করা যাবে না, উঁচু জুতা পরা যাবে না, নিজেকে সাজানো তো যাবে না এমনটাই ভাবে অধিকাংশ মানুষ। তারা সাজ গোজ করা, রঙিন পোশাক পরা চল্লিশোর্ধ্ব মায়েদের দেখলে জ্বলে পুড়ে যায়।

আমার মা নিজেই বাসার কাজ করে, কর্মস্থলে লিফট ব্যবহার করে না, শাকসবজি খায় প্রচুর, পানি খায়, সাজতে পছন্দ করে, তার সিল্কি লম্বা চুলগুলা এখনো কোমড় অব্দি, গিটের ব্যথা নেই, সুস্থ আছে এখনো। তার খাদ্যাভ্যাস, পরিশ্রমের কারণে উনি এখনো ঝলমলে আছেন বলে মনে করি। এতে অনেকের ভালো লাগে না। তারা মাকে জোর করে বয়স্ক ভাব আনতে বলে, তারা মাকে সাজতে না করে, মাকে চুলে পনিটেইল করতে না করে, হালকা রঙা পোশাক পরতে বলে, মেয়েদের সাথে মিলিয়ে পোশাক পরতেও তাদের মানা। মাকে বোরখা পরতে বলা হয়, হিজাব পরতে বলা হয়, শুধু মাথায় ওড়না দেয়া তাদের ভালো লাগে না। মাকে বারবার শুনতে হয় ‘‘তোমার বয়স প্রায় অর্ধশত, তোমার তিনটা মেয়ে আছে, তোমার দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তোমার নাতি আছে, তোমাকে এখন জোর করে বয়স্ক ভাব আনতে হবে। আনতেই হবে।’’

এমন শুধু আমার মা না। মনে হয় প্রায় প্রতিটা মা এসব কথা জীবনে একবার হলেও শুনেছেন। কিন্তু কেন শুনতে হয় এমন কথা? বয়সের কি রঙ আছে? কেন একজনের বয়স দিয়ে তার পোশাক নির্বাচন করা হবে? একজন মা শাশুড়ি হলে কেন তার নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে? ভালো ফিটনেসের জন্য কেন মায়েদের নিয়ে টিটকারি করতে হবে? আপনি বাপু নিজে অনিয়মে জীবন যাপন করে অল্প বয়সে নানা রোগ নিয়ে ঘুরবেন আর সুস্থ মানুষ দেখে হতাশায় যা তা বলবেন তা তো হবে না। নিজে সুস্থ, সতেজ থাকুন আর মন পরিষ্কার করুন।

মা দিবসে সকল মাকে বলতে চাই, নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ করুন, যে পোশাকে আরাম পান তাই পরুন, নিজেকে সাজাতে মন চাইলে সাজান, চুলে ফুল গুজে, হাত ভরা চুড়ি পরে, বাতাসে আচঁল উড়িয়ে দিয়ে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়তে থাকুন। মন আর শরীরের দিকে মনোযোগী হোন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]