November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য লড়াই জারি থাকুক

মাহমুদুল হাসান উৎস।। সৌদি আরবে টিকটক করার অপরাধে হাদিল নামক এক টিনেজ মেয়েকে খুন করা হয়েছে। খুন করেছে মেয়েটারই বড় ভাই। মেয়েটাকে ছুরি দিয়ে কয়েকবার আঘাত করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। হাদিলের ভাইয়ের বিরুদ্ধে তার বোনকে হত্যার অভিযোগ আনা হলেও, তার মা বাবা কোনো অভিযোগ দায়ের করেননি। বরং, তাদের ছেলেকে সসম্মানে ছাড়িয়ে এনেছেন।

বিষয়টা পর্যালোচনা করে দেখবেন, একটা পরিবারে ছেলে মেয়ে খুনখারাবি হলেও মা বাবার মাথাব্যথা নেই। বরং, টিকটক এর মতো সামান্য ভিডিওকে হত্যাযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সন্তান জন্ম দেবার আগে দায়িত্ববোধ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়। সন্তান বাবা মায়ের প্রজেক্ট নয়। বরং, সন্তানও একজন স্বাধীন মানুষ। একজন স্বাধীন মানুষের বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারে না, তার মা বাবাও নয়। এজন্য, সন্তানের উপর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়াটাও একটা অপরাধ। আবার, সন্তানের স্বাধীন ইচ্ছেকে সন্মান না করে তাকে খুন করে মেরে ফেলাটা প্রমাণ করে- আপনি মানুষ নন, আপনি মা বাবা নন; আপনি একটা বন্য পশু, যার কোনো হিতাহিত জ্ঞান বোধ নাই।

সৌদি আরবে মেয়ে শিশু হত্যা করাটা নতুন কোনো বিষয় নয়। ২০০২ সালের ১১ই মার্চ মক্কার একটা বালিকা বিদ্যালয়ে ১৫ জন মেয়েকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। জানা যায়, সেই স্কুলে আগুন লেগেছিল।একটা কক্ষে ১৫ জন মেয়ে ছিল, যারা কি না পর্যাপ্ত ধর্মীয় ড্রেসকোড-এ ছিল না। মানে খুব সম্ভবত তাদের হিজাব নিকাব ছিল না।শুধুমাত্র এই কারণে সৌদির মোরাল পুলিশেরা এই মেয়েদের রুম থেকে বের হতে দেয়নি। তাদেরকে একটা রুমে আটকে রাখা হয়। ফলশ্রুতিতে, ১৫ জন মেয়েকে আগুনে জ্যান্ত পুড়ে মরতে হয়েছিল!

ড্রেসকোড কিংবা টিকটক খুবই সামান্য বিষয়। কিন্তু, এই সামান্য বিষয়গুলোকে অসামান্য হিসেবে চিহ্নিত করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সেই হত্যাকাণ্ডগুলো খুবই নির্মম। খুনখারাবি, আগুনে পোড়ানোসহ কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না।

নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট মোনা এলটাহাওয়ে সৌদি আরব সম্পর্কে একটা বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন। মোনার মা বাবা একটা সময়ে সৌদিতে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন, তখন তার মা একদম বদ্ধ জেলখানার পরিবেশ অনুভব করছিলেন। তার মা ব্রিটেনে উপার্জনশীল ছিলেন। কিন্তু সৌদিতে তার সুযোগ ছিল না। সেইসময়ে একজন নারী হিসেবে গাড়ি চালানোর অনুমতিও ছিল না। ছোটোখাটো যেকোনো কাজের জন্যে মোনার বাবার উপর নির্ভর করতে হতো। এসব ভয়ংকর পরিবেশ এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে মোনা বলেছিলেন, সৌদিতে কোনো নারীকে থাকতে হলে দুটো বিকল্পের একটি গ্রহন করতেই হবে। হয় আপনার চিন্তাশক্তি এবং চিন্তাধারা বিসর্জন দিতে হবে, নয়তো আপনাকে নারীবাদী হতে হবে। হ্যাঁ, আপনাকে নারীবাদী হতে হবে। নিজের অধিকার এবং প্রাপ্ত সম্মানের জন্য আপনাকে সোচ্চার হতেই হবে।

সৌদি আরবের নারীদের জন্যে সহমর্মিতা কিংবা দুঃখপ্রকাশের কোনো শব্দ আমাদের জানা নেই। শুধুমাত্র সৌদিই নয়, আপনি যদি ভারত বা পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনার দিকে তাকান তাহলেও দেখবেন যে, অনার কিলিং নামক এক মধ্যযুগীয় পাষন্ডতা এবং বর্বরতা। সৌদি বা ভারত বা পাকিস্তান নয়, বিশ্বের প্রতিটা দেশেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। যেখানে নিজের মনোভাব প্রকাশের সামান্য সুযোগ নেই, সেখানে আপনাকে প্রতিবাদী এবং যুক্তিতে পরাক্রমী হতেই হবে। আপনার অধিকার, আপনাকেই আদায় করতে হবে।

বাকস্বাধীনতা কিংবা ব্যক্তিস্বাধীনতা এমনি এমনি প্রতিষ্ঠা পায় না। আপনি দেখবেন যে, ইউরোপেও এককালে মানুষের সামান্যতম বাকস্বাধীনতা ছিল না। সেখানেও সৌদি আরবের মতোই অবস্থা ছিল। চার্চের বিরুদ্ধে গিয়ে “পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে”– এই কথা বলার জন্যে বৃদ্ধ গ্যালিলিওকে মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। তাতে কি পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে গেছে? অবশ্যই না।

জিওর্দানো ব্রুণোকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ব্রুণোর অপরাধও গ্যালিলিও-র মতো ছিলো। বিশ্বের প্রথম নারী গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে টুকরো টুকরো করে কাটার পর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, যেমনটা সৌদিতে হাদিলকে তার ভাই হত্যা করেছে। হাইপেশিয়াকে বলা হতো আফ্রোদিতির দেহে প্লেটোর আত্মা। হাইপেশিয়ার অপরাধ ছিলো খ্রিস্টান ধর্ম এবং চার্চের বিরোধিতা করা!

যুগে যুগে হাইপেশিয়া আর হাদিলদের হত্যা করা হয়। হয়তো খুব কম সময়ের জন্যে সত্যকে আড়াল করে মিথ্যাকে সামনে এগিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু, সেটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। হাইপেশিয়ারা ঠিকই আমাদের জন্যে উদাহরণ রেখে যায়। সেই উদাহরণ হচ্ছে যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য বলার সাহস আর স্বাধীনতা। মিথ্যাকে স্বয়ং সক্রেটিস সত্য বলে দাবি করলেও, সেটি মিথ্যাই থাকে। এটাই সত্যের বাস্তবিক চিত্র এবং সৌন্দর্য।

বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার জয় হোক!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]