শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী, ডিভোর্স আর সমাজের গায়ের ফোস্কা
কানিজ ফাতেমা তনিমা।। “শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারীরাই ডিভোর্সের শীর্ষে” – পত্রিকায় এই ধরনের হাস্যকর হেডলাইন দেখলে সত্যিই আমার মনে প্রশ্ন জাগে এরা কি সত্যিই রিপোর্টার? মানে কতটুকু জ্ঞান বুদ্ধি লাগে ওই জায়গায়টায় পৌঁছতে?
আচ্ছা ডিভোর্সের কারণটা কি? কেন মেয়েটা ডিভোর্স দিলো- তা কি জানার চেষ্টা করেছেন কখনো?
হতেই পারে যৌতুকের কারণে স্বামীর নির্যাতন, না হয় শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, বা হয়তো তারা একত্রে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না, তাদের দাম্পত্য জীবন হুমকির মুখে, তিক্ততার পরিমাণ এতই বেড়ে গেছে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা কিংবা ভালবাসার জায়গাটা ধ্বংস প্রায়। আলোচনার জায়গায়টুকুও আর অবশিষ্ট নেই।
এমন হাজারটা কারণ খুঁজে বের করা যাবে।
কিন্তু শিক্ষিত স্বাবলম্বী হওয়া ডিভোর্সের কারণ – কি পরিমাণ নারীবিদ্বেষী হলে এভাবে বলা যায়!
যে দেশ কিনা স্ত্রী নির্যাতনে বিশ্বে চর্তুথতম, সে দেশে ডিভোর্সের কারণ নাকি নারীর শিক্ষিত আর স্বাবলম্বী হওয়া! কি হাস্যকর ব্যাপার।
এখন কথা হচ্ছে অন্যদের তুলনায় শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়েরাই কেন ডিভোর্সের তালিকায় সংখ্যায় বেশি?
তাই তো?
আমাদের সমাজের রোজকার চিত্র- স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির পায়ের নিচে পিষে গিয়েও বহু নারী সংসার টিকিয়ে রাখছে, ঝাড়ু ঝাঁটা খেয়েও মানিয়ে নিচ্ছে অনেক অনেক নারী। সম্পর্কে না আছে ভালোবাসা, না আছে সম্মান, না আছে শ্রদ্ধা, তবুও মানিয়ে নেন। সহ্য করেন। কারণ তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। তাদের পায়ের নিচে মাটি নাই। তারা কেবল টিকে থাকার জন্য বাঁচে। এ বাঁচাকে কি আদৌ বাঁচা বলে? কিন্তু আমাদের নারীবিদ্বেষী এই সমাজ বরাবরই চেয়ে আসছে নারীরা এমনিভাবে বাঁচুক, নারীরা মানিয়ে নেওয়া শিখুক। এদের কাছে নারী হচ্ছে দোকান থেকে কিনে আনা কাঁচের গ্লাস, যাকে যখন ইচ্ছে করবে সাজিয়ে রাখবে। যখন ইচ্ছে করবে ব্যবহার করবে।যখন ইচ্ছে করবে ভেঙ্গে ফেলবে। পুরুষ ডিভোর্স দিলে- “নিশ্চয়ই মেয়ে খারাপ” আর নারী দিলে – “কামাই করে তো, তাই জামাই লাগে না।”
নারীবিদ্বেষী এই সমাজের কাছে নারী মানেই সমঝোতা, শোষণযোগ্য, নীচু শ্রেণির, অবলা, নিয়ন্ত্রণাধীন, যাকে সব সহ্য করতে হবে মুখ বুঁজে। তাহলেই তুমি নারী। তাই কোনো মেয়ে যখন মানিয়ে না নিয়ে দু’একবার ঠাটিয়ে দিয়ে দেয়, তখন তাদের ইগোতে লাগে।
কোনো শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়েকে নির্যাতন করা অন্যদের তুলনায় খানিকটা কঠিন। কিন্তু তার মানে এই না শিক্ষিত স্বাবলম্বীরা একেবারেই নির্যাতিত হচ্ছে না। স্বাবলম্বী হওয়ার পরেও তারা রেহাই পাচ্ছে না নির্যাতিত হওয়ার থেকে।
তবে তাদের বেলায় হয়তো দেখা যায় মুখ বুঝে সহ্য করা, মানিয়ে নেওয়া, অসম্মানিত হয়ে টিকে থাকা, টিকে থাকার জন্য আকুতি মিনতি – এই বিষয়গুলো তুলনামূলক কম। আর তাতেই ফোস্কা পরছে নারীবিদ্বেষী সমাজের।
কারণ ওটা তো নারীর বৈশিষ্ট্যর মধ্যে পড়ে না। নারী কেন পুরুষের মুখে মুখে তর্ক করবে? নারী বরং পুরুষের দেওয়া বিষকেও অমৃত মনে করে হজম করে নেবে। এটাই নারী৷ এই রূপেই সমাজ আমাদেরকে চায়। এমন পুরুষদের দোষের পাল্লা হালকা করতে নারীর দিকে আঙ্গুল তোলার চিত্র এটা তো নতুন না।
দোষী ঠিক কী কারণে? অর্থাৎ দোষটা কী তা নানা ছলেবলে কৌশলে দমিয়ে রেখে কোনো ফালতু যুক্তি দিয়ে প্রতিবারই আঙ্গুল নারীর দিকেই তোলা হয়। ঠিক ধর্ষণের বেলায় যেমন ধর্ষকের ধর্ষণ করার মতো অপরাধের চেয়ে আমাদের সমাজের কাছে ধর্ষণের শিকার নারী ধর্ষিত হওয়ার আগে কারো সাথে শুয়ে এসেছে কিনা তা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তাকে চারিত্রিক সনদ প্রদানটা মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীবিদ্বেষী এই সমাজ আগে আঙ্গুল তোলে নারীর দিকে, প্রশ্ন তোলে তার চরিত্র নিয়ে। পুরুষ সেই বহুকাল আগে থেকেই নারীকে দেখতে চায় অবলা রূপে, চায় নারীর ভাগ্য লিখতে। আর নারীবিদ্বেষী এই সমাজও নারীকে দেখতে চায় পুরুষের হাতের পুতুল রূপেই। মুখে যতোই নারী-স্বাধীনতার বুলি আউড়াক না কেন, আজও এরা নারীকে কেবল মাংসের টুকরোই মনে করে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]