September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বিয়ে, বয়স ও বাচ্চা

রাকিব খান।। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ম্যাচমেকিং গ্রুপ আছে। সেই গ্রুপে বিভিন্ন জন বিভিন্ন সময় নিজের জন্য, বন্ধুবান্ধবের জন্য বা পরিচিত কারোর জন্য পাত্র-পাত্রী চেয়ে পোস্ট করে থাকেন৷ অনেকে প্রত্যাশানুযায়ী পেয়েও যান। এভাবে পাত্র-পাত্রী খোঁজাখুঁজি করে গ্রুপ থেকে গুটিকয়েক বিয়ে হওয়ার নজিরও আছে।

সেই গ্রুপে এমনই পাত্র খোঁজার একটি পোস্ট আমার চোখে পড়ে সেদিন সকালে। পোস্টটি পাত্রীর হয়ে অন্য আরেকজন গ্রুপে করেছেন এভাবে—

পাত্রীর বয়স ৪২। অবিবাহিত। বিসিএস(স্বাস্থ্য) ক্যাডার। সেই সাথে বিভিন্ন ডাক্তারি ডিগ্রিও করেছেন এবং করছেন।

তিনি নিজের জন্য ৪২-৪৬ বছর বয়সী, অবিবাহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকার, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, বিসিএস ক্যাডার, বেসরকারি উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবী কাউকে খুঁজছেন।

এগুলোর সাথে দুজনেরই বর্ণনায় শ্যামলা, ফর্সা, সুন্দর ইত্যাদি মার্কা আরো কথা ছিল সেদিকে আজ যাচ্ছি না।

তো যেটা হলো আমি সেই পোস্টের কমেন্টগুলো পড়ছিলাম।

কমেন্টগুলোর মধ্যে কিছু কমেন্ট ছিল এমন- পাত্রীর বয়স কেন ৪২? সে কেন ৪২-৪৬ বছর বয়সী পাত্র খুঁজতেছে? তাও আবার অবিবাহিত। এত বছর অবিবাহিত থাকতে যেহেতু পারছে, এখন আর বিয়ে করে কী হবে? এমন অনেক মন্তব্য। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী হলে নাকি সন্তানের জন্য সেটা ভালো নয়- এমন সস্তা উপদেশমার্কা কমেন্টও পাওয়া গেল। বলা বাহুল্য এই সবগুলো মন্তব্যই কিন্তু এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকেই।

কেউ যখন কিছু জানতে চেয়ে পোস্ট করেছে, আপনি সেটা জানলে জানাবেন, আর না জানলে পোস্ট স্কিপ করে যাবেন। তবুও আঙুলের সুড়সুড়ি না কমলে শুভকামনা জানিয়ে কমেন্ট করতে পারেন। কিন্তু অযথা অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করার তো কোনো প্রয়োজন নেই। এমন পোস্ট কোনো ৪২ বছর বয়সী পাত্রের জন্য পাত্রী চেয়ে করা হলে নিশ্চয়ই এত এত কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য আসতো না। তাহলে শুধুমাত্র মেয়ে বলেই কেন তার সাথে এমন আচরণ করছেন! আর এমন মন্তব্য যারা করেছে তারা সবাই ছেলে। বেশ কয়েকজনকে অবশ্য ডিফেন্ড করতেও দেখলাম।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়েও শিক্ষার্থীরা তাদের মনমানসিকতা বদলাতে পারলো না। এরা উদার চিন্তাভাবনা করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লোকজনের মনোভাব যদি এই হয়, তহইলে গ্রামের অবস্থা আরো কী হবে!

অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো যে, বিয়ে করাই মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর সেটা করতে হবে ৩০ এর আগেই। যে যত আগে প্রতিষ্ঠিত তার বিয়েও করা লাগবে আগে- এমন ধারণা পাওয়া গেল। পাত্রীর বয়স কেন বেশি? ৪২ এ কেন বিয়ে করবে? অথচ পাত্রীর মেধার কোনো কথা কেউ বললো না। এগুলো নিয়ে পাত্রীর বা তার পরিবারের মাথাব্যথা না থাকলেও কমেন্টকারী সবার মাথাব্যথা। সে কেন বিয়ে করে নি এটার পিছনে হয়ত তার যৌক্তিক কোন কারণ আছে। অথবা ইচ্ছে করেই করে নি৷ তার অবস্থা পুরোটা না জেনে আমরা এমনিতেই একটা মন্তব্য করে বসি। এরকম অবস্থা আমাদের চারপাশেও বিদ্যমান।

বিয়ে যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। যখন যার ইচ্ছে হবে করবে ইচ্ছে না হলে করবে না। ইচ্ছেটা ২২ বছর বয়সেও আসতে পারে আবার ৪২ বা ৬২ বছর বয়সেও হতে পারে৷ হোক সে নারী বা পুরুষ। অথবা কেউ কখনো বিয়ে না করেও সারাজীবন থাকতে পারে। মেয়েরা হরহামেশাই “অনেক তো পড়াশোনা করলা, বয়স হয়ে যাচ্ছে। এইবার বিয়ে করে নাও। নয়ত পরে ভালো ছেলে পাবা না।” “বেশি শিক্ষিত মেয়ের জন্য পাত্র পাওয়া কষ্টকর” ইত্যাদি ইত্যাদি বচন পাড়া-প্রতিবেশী, আত্নীয়স্বজনদের থেকে সবচেয়ে বেশি শুনে থাকেন। মানে ব্যাপারটা হলো যে, বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। বিয়েই জীবন। অথচ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার আমাদের কোনো অধিকার নাই।

ছেলে অথবা মেয়ে যে কেউ বিয়ে ছাড়াই থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আবার অনেক সময় বিয়ে করছেন না এমন কোনো নারীকে দেখলে তাকে হ্যারাসমেন্ট করার চেষ্টা করা হয়। তার কাছে ঘেষে থাকতে চায় কিছু পুরুষ। মনে করে যে, সে অবিবাহিত মানেই আমার জন্য অ্যাভেইলেবল। আর পাত্তা না পেয়ে প্রত্যাখ্যান হলেই বাজে, নষ্টা ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে দেয়।

আবার কেউ একটু দেরিতে বিয়ে করতে চাইলে তাকে আমরা- বুড়া বয়সে বিয়ে করে কী করবা? কে বিয়ে করবে তোমাকে? আগে কেন করো নাই? এখন কেন করবে?- এসব প্রশ্ন করি। ব্যক্তিগত বিষয়ে এত এত ইন্টারেস্ট আমাদের। মানে একটা সময় বিয়ে করার জন্য চাপ দেবে৷ আবার একটু দেরিতে করলেই নানান কথা বলবে।

ধরলাম কেউ বিয়ে করলো। এরপর চারদিক থেকে আসবে তার বাচ্চা নেবার চাপ। পারলে বিয়ের পরদিনই বাচ্চার আশা করে মানুষজন। অনেকেই আছে যারা ইচ্ছে করেই সন্তান নেয় না৷ সবার সন্তান নিতে হবে এমন তো কোনো কথা নাই। আশেপাশের মানুষজন তাদের বলে, কী ব্যাপার বাচ্চা হয় না কেন? কোনো সমস্যা আছে নাকি? ইত্যাদি নানা প্রকার কানাঘুষা। এইসব মানুষের কথাবার্তা শুনে মনে হয় বিয়ে করে সন্তান জন্ম দেওয়াই মানুষের একমাত্র কাজ। আর কোন কাজ মানুষের থাকতে পারে না৷

সবকিছুতেই মজা করা একটা অসুস্থ ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে আমাদের মাঝে। আর কেউ মেয়ে বলেই তাকে আপনি যা ইচ্ছে তাই বলতে পারেন না। সবার আগে সবাইকে মানুষ ভাবতে শিখুন। সবাই একই রকম হবে, একইভাবে জীবনযাপন করবে এইটা ভাবা যাবে না। মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, পছন্দ, অপছন্দকেও মূল্যায়ন করতে শিখুন। দেখবেন পৃথিবী সুন্দর।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]