November 2, 2024
জীবনের গল্প

পারিবারিক বৈষম্য যখন জীবন এলোমেলো করে দেয়

সাবিনা শিরীন রুনা।। ধরে নিন আমি তৃণা, পরিবারের ৪র্থ সন্তান। রোগা শীর্ণকায়। ওর কোন নিজস্ব ভাল লাগা, মন্দ লাগা নেই। খায়-দায় ঘরের এক কোণায় আসবাবপত্রের মতো থাকে। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে বড় ভাই, মেজবোনের প্রাধান্য। পরিবারের যা কিছু ভালো সেটাই ওদের অধিকারে।

বড়ভাই, বোন গান করে দেখে তৃণার ইচ্ছে করে গান শেখার, কথাটা শুনে সকলে হাসাহাসি করে। কুঁজোর আবার চিৎ হয়ে শোবার শখ! তো ভাই -বোন একটু বড় হলে ওদের ফ্যাশন করা ড্রেস দেখে। মা’র কাছে আব্দার করে তারও এমন ড্রেস চাই। শুনে মা বলেন, ‘দাঁড়া,তোর আপা না পরলে তোকে দিতে বলবো।’ তৃণা মেজবোনের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে, ‘আপা, দে না আমাকে তোর কামিজ পরতে।’ যদি দয়া হতো তাহলে কোনও কোনও সময়ে পরতে দিত।

বাড়িতে কখনও কোনও মেহমান আসলে ওরা মেহমানের সামনে যেতো কারণ ওরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো। আমরা খেয়েছি, গিয়েছি না বলে খাইছি, করছি বলতাম, সেজন্য মেহমানের কাছে আমাদের যাওয়া নিষেধ ছিল। গানের টিচার ওদের জন্য, আমাদের জন্য না; হারমোনিয়ামে হাত দেওয়া যাবে না, নাটক চর্চা করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সেরা সন্তান মানে ওরা দু’ভাইবোন।

একে একে সকলেই বড় হয়ে যায়, বাবা স্ট্রোক করে। সব কিছুর ছন্দ পতন। এর মাঝেই মা চিন্তা করেন বড় বোনের বিয়ে দেবেন। সরল সোজা বোনের জন্য একটা মফস্বলের ছেলে খুঁজতে থাকে। যেন আমার বোনকে বুঝে নিতে পারে। তো সে-রকম ছেলে পাওয়া যায় এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। বিয়ে হয়।

এরমধ্যেই বড় ভাই নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করে শহর ছেড়ে চলে যায়। বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পরিবারটা এলোমেলো হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে ভাই তার জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। বাবার সূত্রে চাকরিও যোগার হয়। ভাই এসে তার পছন্দের ছেলের সাথে মেজ বোনের বিয়ে দেয়। তখন আমার মা-বাবা জিরো হয়ে যায়।

রোগা শুকনো বোনের খোঁজ খবর কেউ রাখে না। ও ভীষণ একাকীত্বে ভোগে। সেও এক সময় পালিয়ে বিয়ে করে। ওর কাছে মনে হয় বিশাল কিছু করে দেখিয়েছে।পাড়ায় ছিঃ ছিঃ পড়ে যায়। তাতে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই। অবশ্য ওর এই বিয়েতে তার ভাবীর যোগসাজশ ছিল। মূলত তাকে বাড়ি থেকে সরানো। বিধি বাম। সম্পূর্ণ বেকার ছেলেকে বিয়ে করায় আবারও বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। সে সকলের ফাইফরমাশ খাটে। ভাইয়ের সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব তার উপর পড়ে।

এক সময় সে হাঁপিয়ে ওঠে। পরে তারা শ্বশুরবাড়িতে গ্রামে চলে যায়। এদিকে সেই মেজ বোনের সংসারে টলমল অবস্থা। তার জামাই ঘরমুখো নয়। সব কিছু চিন্তা করে আমাদের তাদের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে শুরু হয় আমার উপর বাল্যকালের মানসিক নির্যাতন। আমার সবকিছুই গ্রাম্য। ওদের অতিথি এলে আমাকে দিয়ে কাজকর্ম করিয়ে নিয়ে লুকিয়ে রাখতো। অতিথি চলে গেলে বের করতো। কেউ কেউ দেখে ফেললে বলতো, ও কিচ্ছু বোঝে না, কাজ পারে না। কিছু শেখাতে গেলে ঝামেলা করে। কিন্তু আমার বোনের হাসব্যান্ড আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ভালবাসতেন আমাদের দু’জনকে। আমার সাথে আমার বোনের আচরণের প্রতিবাদ করতেন সব সময়।

এর মাঝেই আমার বাবার মৃত্যু। মা একা থাকতেন। পারিবারিক ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। পরিবারের সমস্ত ব্যাপারে মেজ বোনের মতামত প্রাধান্য পেতো বাবার জীবিত থাকা অবস্থাতেই। বাবার মৃত্যুর পরেও সেই ব্যবস্থা বহাল ছিল। অন্যান্য ভাই/বোন সেটাই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছে। আজ সকলেই প্রবীণ। যথাক্রমে যার যার জামাই, বউ এসেছে। তারাও এটা মেনে নিয়েছে। আসল কথা – পারিবারিক গড মাদার-মেজো বোন। এক পর্যায়ে ঝামেলা শুরু হয় প্রত্যেকের ছেলেমেয়ে নিয়ে। তারা নতুন প্রজন্ম। তারা এটা মেনে নেয় না। তৃণার মা-বাবাকে মানসিক নির্যাতন করা জামাই-পুত্রবধূদের পক্ষে কথা বলতো মেজ মেয়ে। পরবর্তী প্রজন্ম এর প্রতিবাদ করতো। স্বাভাবিকভাবেই সন্তানদের সর্মথন করতো মা-বাবা। তখন বিরোধ চরমে ওঠে। পরিবার থেকে সমাজে গড়ায় বিষয়টি। শিক্ষিত পরিবারের লজ্জা ওড়ে আকাশে। মেজ মেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে নেশায় আসক্ত ভাইকে পক্ষে নিয়ে মা এবং অন্যান্য ভাই বোনের বিপক্ষে কাদা ছোড়াছুড়ি খেলায় মেতে ওঠে। দুর্বিষহ করে তোলে জীবন। রাস্তায় বের হলেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। তারা এখন বাইরে বের হতে ভয় পায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নোংরা কথার ভয়ে ঘর থেকে বের হতে চায় না। মেজ বোনের কথা – দোষ না করলেও বড় ভাইয়ের এবং তার পা ধরে ক্ষমা চাইলে তোরা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবি।

আরেকটা ভুল তারা করেছে, তাদের বিষয় সম্পত্তি এবং টাকা পয়সার হিসাব, অলঙ্কার ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন পর্যন্ত তাদের মেজ বোনের কাছে রাখত তারা সকলেই। তো বিবাদের সময় ভাই/বোন মিলে তাদের সায়েস্তা করার জন্য সব কিছুই অস্বীকার করে। সব কিছু থেকে তারা বঞ্চিত হয়। কোনও রকম প্রমাণ ছাড়া তারা তাদের বোনের কাছে সবকিছু গচ্ছিত রেখেছিল। আজ তারা নিঃস্ব। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। অকূল পাথারে ভাসছে  ভাই -বোন-মা।

তৃণার মনে হয় তাদের মা-বাবার ভুলের কারণে আজ তাদের  ই অবস্থা। সমাজে মেজ বোন এবং ভাইকে সবাই ভদ্র বিনয়ী হিসাবে জানে। তারা এমন ভদ্র যে বাবা মারা গেলে তাকে দেখতে আসে না, বলে মরা মানুষ দেখে কী হবে! নিজের মায়ের খোঁজ খবর নেয় না বছরের পর বছর। মাকে বলে, শয়তান। আমাদের ভাই বোনকে বলে – মায়ের পাশ থেকে সরে আয়। মা ভালো না। মা যার কাছে থাকবে তার ক্ষতি করবে। সে বোন সমাজ -সংসার কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। সে কীভাবে জীবনযাপন করবে কারো সাথে পরামর্শ করে করে না কিন্তু অন্যে কীভাবে জীবনযাপন করবে সেটা সে নির্ধারণ করবে। একবার বড়বোনের ছেলে বিয়ে করার একদিনের মাথায় বউকে ডিভোর্স করিয়েছে। কারণ বউয়ের চেহারা তার ভাইয়ের পছন্দ হয়নি সে কারণে। মেয়েটির দোষ সে যথার্থ সুন্দরী না। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনার প্রতিবাদ করার ফলে তৃণাকে বিশাল অংকের খেসারত দিতে হয়েছে। আর ভাগ্নার জেল জরিমানা দিতে হয়েছে।

তাকে থামানোর মানুষ এই পৃথিবীতে নেই। তৃণাদের সমস্যা তার বোনের ভিতরের চেহারা না পারছে কাউকে বলতে, না পারছে সমাধান করতে। মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। তার বোন কারো পরোয়া করে না, তার টাকার অভাব নেই। ওর অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই তা সায়েস্তা করার পদ্ধতি জানা আছে। ওকে কেউ জিজ্ঞেস যদি করে তুমি কেনো মা-ভাই বোনের সাথে এমন কর, তখন মিষ্টি হেসে বলবে, ওরা অবুঝ, কথা শোনে না। ছেলেমানুষি করে। ভাইকে জ্বালায়। আমার ভাই শান্তিপ্রিয় মানুষ। সারাজীবন আমি /ভাই পরিবারের জন্য ছায়া হয়ে ছিলাম। ওদের পেলেপুষে লেখাপড়া শিখিয়েছি। আজ সেই ভাই বোন, মা বেঈমানি করছে।

অথচ তাদের বাবা ছিলেন ডাকসাইটে প্রফেসর। অনেক স্বচ্ছলতা ছিল তাদের। খুব চালাকির সাথে অন্যান্য ভাই /বোনকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে রেখেছিল। সহজ সরল বাবা-মা সেটা বুঝতে পারেন নাই আগে। যখন বুঝেছেন তখন আর সময় নেই।

প্রত্যেক বাবা-মা’র উচিৎ সমান অধিকার দিয়ে প্রতিটা সন্তানকে বড় করা। বাবা-মার ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক বৈষম্যের শিকারে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হয়েও অনেক সন্তানের জীবন নড়বড়ে হয়ে যায়।