November 2, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

‘‘সব ধর্মই আমার যোনি নিয়ে চিন্তিত”

মোনা এলটাহাওয়ে একজন মিশরীয়-আমেরিকান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট। মিশর এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজের নানা অসঙ্গতি, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদি তুলে ধরাই মোনার লেখার বৈশিষ্ট্য। “হেডস্কার্ফ এন্ড হাইমেন” নামের বিখ্যাত বইয়ের লেখক মোনা এলটাহাওয়ের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাংবাদিক এলিজাবেথ ডে, যা দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় রূপান্তর করেছেন মাহমুদুল হাসান উৎস।।

আপনার বইটি একই সাথে মেনিফেস্টো ও জীবনের খণ্ডাংশ এবং এতে এমন সব মুসলিম নারীদের সাক্ষ্য দেওয়া আছে, যারা সারাজীবন নির্যাতন সহ্য করেছে। আপনি নারীর উপর যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের ঘটনাও উল্লেখ করেছেন। এসব লেখা কি কঠিন ছিল?

– অবিশ্বাস্যরকম কঠিন ছিল। অনেক সময়, লেখা বন্ধ করে আমাকে ল্যাপটপ থেকে দূরে যেতে হয়েছিল। কারণ এটি আমার জন্যে প্রচণ্ড আঘাতের মতো ছিল; বিশেষত আমার নিজের যৌন নির্যাতনের ঘটনা লেখা। এটা শুধুমাত্র লাঞ্ছনা বা শারীরিক নির্যাতনই নয়, বরং নারীবিদ্বেষীও বটে। তাই, এই বই লেখা মোটেও সহজ ছিল না।

আপনি লিখেছেন যে, টিনেজার হিসেবে নারীবাদে অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন। এটা দিয়ে কী বুঝিয়েছেন?

– যখন আমার বয়স ১৫, তখন আমার পরিবার গ্লাসগো থেকে সৌদি আরবে চলে যায়। ১৫ বছর বয়সী মেয়ের জন্য যেকোনো জায়গায়ই কঠিন; তবে সৌদি আরবের একটি ১৫ বছরের মেয়ে হওয়া….। এমন মনে হয়েছিল, যেন কেউ আমার মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি নষ্ট করে দিয়েছিল। মহিলাদের সাথে কেন এরকম ব্যবহার করা হয়েছিল, আমি জানি না। যুক্তরাজ্যে আমার মা উপার্জনশীল ছিলেন। আমি এবং মা-বাবা একসাথে ছিলাম। কিন্তু সৌদি আরবে আমার মা বন্দী হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি গাড়ি চালাতে পারছিলেন না; সবকিছুর জন্যে আমার বাবার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ধর্মীয় আচরণ এরকমই শ্বাসরুদ্ধকর ছিল। এবং আমি মুসলমান হিসেবে বড় হয়েছি; মুসলমান পরিবার থেকে এসেছি – কিন্তু এটা ছিল অতি ধর্মান্ধতাপূর্ণ। সৌদি আরবের মহিলা হিসেবে আপনার দুটি বিকল্পের একটি হচ্ছে – হয় আপনি আপনার চিন্তাচেতনার বিসর্জন দিবেন – যেটি আমার সাথে ঘটেছিলো – আমি এজন্য গভীরভাবে হতাশ ছিলাম; অন্য বিকল্পটি হচ্ছে আপনি নারীবাদী হবেন।

আপনি নিজের সম্প্রদায়ের নারীবিদ্বেষী কাজকর্ম নিয়ে খোলাখুলি কথা বললে যে ক্ষোভ তৈরি  করতে পারেন – সে সম্পর্কে কি আপনি চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন ছিলেন?

– আমি প্রচুর ঘৃণা পেয়েছি। তবে আমি খুশি কারণ আমার মতামতকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে – তাই ঘৃণা করছে। একজন মহিলা যে কি না নিজের মতামত জানাচ্ছে – এজন্য সে ঘৃণিত ব্যক্তি!

প্রত্যেকটি ধর্মই কি নারীবিদ্বেষী?

– কিছুটা বটেই। প্রত্যেকটা ধর্মই, যদি আপনি তাদের বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখবেন তারা নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা আমার যোনি নিয়ে চিন্তিত এবং আচ্ছন্ন। আমি তাদের বলেছি আমার যোনি থেকে দূরে থাকো- যদি না আমি আমার যোনিকে তোমার জন্যে সম্মতি দেই।

আপনি একটি “দ্বৈত বিপ্লব” এর আহ্বান জানিয়েছেন। এটা আসলে কী? 

– ২০১০ সালে তিউনিসিয়ায় যা ঘটেছিলো তা ছিল একটি রাজনৈতিক বিপ্লব; যা পরিচালিত হয়েছিলো এই মর্মে যে- রাষ্ট্র সকলকে নিপীড়ন করছে। তবে আমি মনে করি নারীরা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছিল যে এই রাষ্ট্র রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে এবং বাড়ির গৃহবধূদেরকেও নিপীড়ন করছে এবং মহিলারা আরও বুঝতে পেরেছিল যে নিপীড়নের ত্রি-ফেক্টর অর্থে রাজনৈতিক বিপ্লব ব্যর্থ হবে- যদি না সোশাল ও সেক্সুয়াল রেভ্যুলেশন না ঘটে।

আপনি ১৫ বছর বয়সে হিজাব পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেন?

– আমি ১৫ বছর বয়সে এটি পরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মা-বাবা বলেছিলেন, আমি ছোট; তাই এটি ১৬ বছর বয়সে পরলাম এবং তারপর খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিলাম – এটি আমার জন্যে নয়। আমার চুলে হাওয়া লাগলে যে শান্তির অনুভব পেতাম, সেটি পাচ্ছিলাম না। আমি যখন কিছু খেতাম তখন, এটি বাঁধার সৃষ্টি করছিল; তাই আমি অনুভব করলাম চাইলেই আমি উদ্বেগমুক্ত হতে পারি।

তাই আপনি ১৯ বছর বয়সে হিজাব পরা বন্ধ করেছিলেন?

– আমি হিজাব পরার সময় লোকেদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম যে, আমার দেহের কোন অংশ আপনাকে দেখাবো তা বেছে নেয়াটা আমার স্বাধীনতা এবং নিজের পথ; যাতে আপনি আমাকে বস্তু বিশেষের সাথে তুলনা করতে না পারেন। তবে এ কাজ করে যাওয়া খুব কঠিন। যদি কোনো লোক আমার মতামত বা কাজ মানতে না পারে তাহলে সমস্যাটি শুধুই তার; আমার নয়।

আপনি মিশরীয় দাঙ্গা পুলিশ দ্বারা নির্মম নির্যাতন এবং হামলার ঘটনা লিখেছেন। যখন এসব ঘটনা ঘটছিল- তখন কি আপনি ভয় পেয়েছিলেন?

– আমি কি ভয় পেয়েছিলাম? (থেমে) প্রথমে আমি ভাবিনি তারা আমার সাথে কিছু করবে। আমি একা একজন নারী ছিলাম, চারজন দাঙ্গা পুলিশ আমার কাছে কী চাইবে? (একটু হেসে) কিন্তু একটি বিষয় ছিল; তারা আমাকে জনশূন্য জায়গায় নিয়ে যৌন নির্যাতন করেছিল এবং আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম; এ সময় একটা কণ্ঠ আমাকে বলেছিল- তুমি যদি এখান থেকে উঠে না যাও, তাহলে মারা পড়বে। আমি আমার দুটি ভাঙা আঙুল নিয়ে তাদের সাথে লড়াই করেছি।

এবং তারপরেই আপনি আপনার চুলগুলো লাল করেছেন এবং ট্যাটু করেছেন?

– হ্যাঁ, আমার আঙুলগুলো তিনমাস প্লাস্টার করা ছিল। একজন লেখক হিসেবে এটি অতিমাত্রায় হতাশাজনক। আগে শব্দগুলো আমার প্রতিবাদের মাধ্যম ছিল; ছিল আমার অস্ত্র। আমি কেবল টাচপ্যাডে একটি আঙুল ব্যবহার করতে পারতাম। তাই, আমি মূলত সারাদিন টুইটারে থাকতাম। আমি ভিকোডিন নামের শক্তিশালী ওষুধের উপর ছিলাম এবং হাড় ঠিক হলে আমার সাথে কী ঘটেছে তা নিশ্চিত হলাম। আমি অনুভব করলাম, আমি কেবল শব্দ নয়; বার্তাও পাঠাতে পারি।

ট্যাটু করার সময় আমি অনেককেই পেলাম যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং নির্যাতনকারীদের তারা জানাতে চায় যে, “যার দেহ, শুধু তারই অধিকার”।

তাই আমার হাতে মিশরীয় এক দেবী, যে কি না প্রতিশোধ এবং যৌনতার দেবী সেখমেট- তার ট্যাটু আছে। আমি এটা এমনভাবে করিয়েছি যে, এটা তাদের (নির্যাতনকারীদের) পাছায় লাথি দেবে এবং বুঝতে সাহায্য করবে। এর মাথা সিংহের কিন্তু দেহ নারীর। আমার বাম বাহুতে আরবি ক্যালিগ্রাফি রয়েছে এবং যে রাস্তায় আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে তার নামও আছে; কারণ সেই রাস্তা যার নাম “মোহাম্মদ মামুদ” রোড – সেটি বিপ্লবের আইকন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর নিচে স্বাধীনতা শব্দটির আরবি ফর্মও রয়েছে।

আর লাল চুল?

– আমি মনে করি, এটি বলছে – “আমি এখানেই আছি ”!

২০১২ সালে “নিউজ উইক” আপনাকে “১৫০ জন নির্ভীক মহিলা” এর একজন হিসেবে নাম দিয়েছে। আপনি কি নিজেকে নির্ভীক বলে মনে করেন?

– আপনি জানবেন যে, আমি কখনোই নিজেকে নির্ভীক কিংবা সাহসী বলে মনে করি না। আমাকে প্রায়শই জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কি মিশরে নিরাপদ বোধ করেছেন”? উত্তরে আমি বলি, মিশরে কেউ’ই নিরাপদ বলে বোধ করে না। ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে বেঁচে থাকাটা যে কারু পক্ষে এক ধরণের প্রতিরোধের উপায়।

আমি কোথাও এক জায়গায় পড়েছিলাম, আপনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-এর ফ্যান?

– বিশাল! নয় বছর বয়স থেকেই আমি, আমার বাবা, ভাই এবং ভাইয়ের চার বাচ্চার সবাই লিভারপুলের ফ্যান।